মাসকাওয়াথ আহসান, ১৭ মার্চ, করাচী
পাঞ্জাবি আর পোলাও আমার খুব প্রিয় ছিলো; কিন্তু বিভিন্ন দিবসে পাঞ্জাবি পরে; তেলের বিনিময়ে পোলাও খেয়ে ফেসবুকে দেশপ্রেমের ওয়াজ নসিহত করতে দেখে; পাঞ্জাবি পরা আর পোলাও-বিরিয়ানি খাওয়া প্রায় বাদই দিয়ে দিয়েছি।
গতকাল সাঁঝে করাচীর বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য এফেয়ার্স আতিকুর রহমান ভাই হোয়াটস এপে লেখেন, ভাই পাঞ্জাবি পরি আজ আমরা সবাই নাকি!
মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়েছে কারণ স্ত্রী অফিসের পথে বেরিয়ে গেছে; কাবার্ডের কোথায় যে কী আছে! আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো সে, কী পরবো! বলেছিলাম, এই সিজনে শেষবার ব্লেজার পরি। সেই অনুযায়ী সে হ্যাংগারে শার্ট-প্যান্ট-ব্লেযার টাঙ্গিয়ে রেখে গেছে।
কিন্তু আতিক ভাইয়ের ইচ্ছা পূরণ করতে হবে; খুব নান্দনিক রুচির মানুষ উনি। সুতরাং কাবার্ডগুলোতে তল্লাশি করে পাঞ্জাবি উদ্ধার করা যায় একটা।
এর মাঝে স্ত্রীর ফোন আসে, ড্রাইভার ইমরান আমাকে নামিয়ে দিয়ে দূতাবাসের সামনে অপেক্ষা না করে বাসায় চলে আসতে চায়। কারণ গোয়েন্দারা এসে তাকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে।
কিন্তু আতিক ভাই, ড্রাইভারদের বিশেষ দাওয়াত দেন; উনি তেলে মাথায় তেল নয়; যারা তেল পায়না সমাজে; তাদের সম্মানিত করতে বেশি প্রেফার করেন।
ইমরানকে দূতাবাসে যাবার পথে জিজ্ঞেস করলাম, প্রবলেম কী!
ইমরান বললো, গোয়েন্দারা ওকে জিজ্ঞেস করে, ভেতরে কী দেখলে বলো!
সমাধান হলো, আমাকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় এসে অপেক্ষা করবে। আমি ফোন করলে আবার যাবে। যাতে গোয়েন্দারা তাকে বাগে না পায়। ওকে ওরা জিজ্ঞেস করে, তোমার সাহেব এতো ঘন ঘন বাংলাদেশ দূতাবাসে আসেন কেন!
আমি সাহেব নই; তবু পাকিস্তানের ফর্সা জামা পরা-চশমা পরা লোকদের খুব সাহেব সাজার শখ। তাদের স্ত্রীরাও বলেন আদর করে, আমার সাহেব! অনেকটা মেরা সুলতান টাইপের ব্যাপার। যদিও আমার স্ত্রী আমাকে পাভেল বলে ডাকে।
দূতাবাসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন দিয়ে জাতির জনকের জন্মদিন পালন শুরু হলো। এই পর্বের পরে জাতিসংঘ কর্মকর্তা আহসান হাবীব ভাই বললেন, স্কুলে প্রতিদিন পতাকা উত্তোলন আর শপথ গ্রহণ পর্বে; মনে হতো; কেন প্রতিদিন রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই রিচুয়াল করতে হয়।
অথচ এখন জাতীয় পতাকা উত্তোলন পর্বে হৃদয়ে শিহরণ জাগে; বয়স কীভাবে বদলে দেয় মানুষের মন।
কুরান তেলওয়াত, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী-পররাষ্ট্রমন্ত্রী-পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ হলো। সংক্ষিপ্ত, সুন্দর, ঝরঝরে গদ্যের বাণী; অপ্রয়োজনীয় বিশেষণ নেই; টান টান সম্পাদকীয়-র ঢঙ্গে লেখা। আতিক ভাই, আমাকে লিখিত কপি পড়তে দেন। ফলে গতকাল প্রথম বারের মতো সন্তুষ্ট হলাম। বুঝলাম তথ্য সার্ভিসের অনুজ প্রতিমেরা ভালো বাণী ড্রাফট করছে; নির্মেদ গদ্য লিখছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী অবশ্যই নিজেই লিখেছেন এই বাণী; কারণ আমি তাদের চিন্তার ও গদ্যের সঙ্গে অনেক দিন ধরে পরিচিত।
শিশু-কিশোর-কিশোরীদের আবৃত্তি পর্বটি ছিলো নিঁখুত। ওদের করা বঙ্গবন্ধুর স্কেচগুলোও অসম্ভব সুন্দর। বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মটি হীরক সম্ভাবনাময়; আজ লিখে রাখলাম; মিলিয়ে নিয়েন।
আমার বক্তব্য নিয়ে লিখতে চাইনা। কারণ আমি হচ্ছি বক্তৃতা মোল্লা বা সাধু। সারাজীবন এই একটা জিনিসই পারি। বিভিন্ন যায়গায় বক্তৃতার বিনিময়ে খাদ্য জোগাড় করি। পীর-পুরুতদের মতো লাগে খাওয়ার পর্বে। হোস্ট যখন ওয়াজ নসিহত বা মন্ত্রপাঠ ভালো হবার মুগ্ধতায়, পাতে একটু বেশি দই রসগোল্লা দেন।
আহসান হাবীব ভাইয়ের বক্তব্য ছিলো ছোট কিন্তু সুন্দর। উনি অভিভাবকদের বললেন, বাসায় ফোন এলে তা এভয়েড করতে আমরা যে বাচ্চাকে বলি; যাও বলো; আব্বু-আম্মু বাসায় নাই; এইভাবে আমরা মিথ্যা শেখাই। এ কারণে আশাব্যঞ্জক সততা সমাজে অনুপস্থিত। বঙ্গবন্ধুর সততার সাহস বিষয়টি প্রতিভাত হলো উনার বক্তব্যে। উনার অভিভাবকেরা সততা শিক্ষা দেয়াতেই উনি আজ স্মরণীয়।
আতিক ভাই; লিখিত বক্তব্য না দিয়ে একটা দাবি তুললেন, আমরা যেন নিজের সন্তান আর অধিকার বঞ্চিত অন্য শিশুদের সমানভাবে ভালোবাসতে শিখি। আত্মকেন্দ্রিক থাকলে; শুধু নিজের সন্তান নিয়ে ভাবলে; সুষম সমাজ গড়তে পারবো না আমরা। জাতির জনক নিজের সন্তান নিয়ে পড়ে থাকেননি; অধিকার বঞ্চিতের সন্তানের সুন্দর আগামীর জন্য জীবনব্যাপী লড়াই করেছেন।
উপস্থিত শিশু-কিশোর-তরুণ আর অভিভাবকদের চোখে মুখে আত্মবোধনের আশাজাগানিয়া অভিব্যক্তি চোখে পড়লো।
এরপর বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে ডিএফপি নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হলো। এইখানে তথ্য সার্ভিসের অনুজ প্রতিমদের পারফরমেন্সে একটু হতাশ হলাম। একই প্রামাণ্যচিত্র বানিয়ে বসে থাকা কেন। ১৭ মার্চ সামনে রেখে দশ মিনিটের নতুন একটি প্রামাণ্যচিত্র বানাতে; সাতদিনের বেশি লাগার কথা নয়। নিজের কর্মজীবনকে কর্মমুখর না রাখলে আর জীবনের আনন্দ কোথায়!
এরপর শিশুদের নিয়ে কেক কাটলেন, মিসেস আতিক, ফারজানা রহমান। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। ফলে আমার ডিপার্টমেন্টের ছোট বোন। এতো উষ্ণ আচরণ তার শিশুদের সঙ্গে; অতিথিদের সঙ্গে যে শিষ্টাচার; মনটা আনন্দে ভরে যায়। বিসিএস কর্মকর্তা আর তার শিক্ষিতা স্ত্রীর বাংলাদেশ হাউজের হোস্ট হিসেবে অমল সুন্দর সাঁঝ রচনা; মুগ্ধতা এনে দেয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই শখ বইপড়া। আতিক ভাই, বাচ্চাদের পুরস্কার দেবার জন্য বেছে এমন সব বই উপহার সংগ্রহ করেছেন; যা পড়লে ওদের মানস গঠনে সহায়ক হবে।
বঙ্গবন্ধু কর্ণারে দুর্লভ সব আলোকচিত্র। আহসান হাবীব ভাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বললেন, কী গাটস; কী অনায়াস মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ইনডিভিজুয়াল ম্যাটার করে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে।
নৈশভোজ শুরু হবার আগেই আতিক ভাই জিজ্ঞেস করলেন, ভাই ইমরান সাহেব কী এসেছেন! আমি ফোন করতেই দশমিনিটের মাঝে এসে পড়লো ইমরান।
আতিক ভাইয়ের স্ত্রী খাবার সময় ধরলেন, ভাবী এলে ভালো লাগে; উনি এলেন না যে ভাই।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ওপর অনাস্থা প্রস্তাব আসায়; নিউজরুমে এখন খবরের সুনামি; শিফট ইন চার্জ হওয়ায় সে আসতে পারেনি। অথচ শাড়ি বের করে রেখেছিলো আসার জন্য। কিন্তু অফিসে যেতে হলো শেষ পর্যন্ত।
এরপর আতিক ভাইয়ের স্ত্রী ফারজানা আমার একটু ক্লাস নিলেন, ভাবি তো বাড়ির কাজ সবই করেন। তারপর অফিস।
আহসান হাবীব ভাই বললেন, মাসকাওয়াথের গোলগাল ব্যাপারটা থেকে আঁচ করা যায় বেশ।
বেশ একটা হাসাহাসি হলো। আমি অলসতাকে শিল্পে পরিণত করায়; এই কায়িক পরিশ্রম না করার খোঁটায় আর লজ্জা পাই না। শৈশব থেকে এই খোঁটা শুনতে শুনতে ঠ্যাঁটা হয়ে গেছি।
অতিথিদের মাঝে রাজশাহীর মেয়ে বনানী ছিলো; পৃথিবীটা কত ছোট; সে আমার কলেজ সময়ের বন্ধু মৃদুলার ছোট বোন। মৃদুলা ছিলো আমাদের বন্ধু ফেরদৌসীর বেস্ট ফ্রেন্ড। সেইসূত্রে মৃদুলার সঙ্গে খাতির জমানোর জন্য, সেজেগুঁজে ওদের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের বাসায় যেতে তো হতোই।
এরপর বনানী যা বললো, তা আমার আনন্দময় সাঁঝটাকে ভারি করে তুললো। কভিড নাইন্টিন মৃদুলাকে কেড়ে নিয়েছে। বনানী মোবাইল ফোনে লন্ডনে মৃদুলার কবর দেখালো।
আল্লার বিচার বিবেচনা মাঝে মাঝে বুঝতে কষ্ট হয়। মৃদুলার মতো এতো মানবিক-পরোপকারী-সুদর্শনা; কবিতার মতো মেয়েটিকে কেন কেড়ে নিতে হবে! আমাদের মতো লোকেদের কী চোখে পড়ে না খোদার; নিয়ে গেলেই পারে; যন্ত্রণা জুড়িয়ে যায় জীবনের।
মারাত্মক বাজে মন মেজাজ নিয়ে বের হতেই দেখি ইমরান গাড়ির ড্রাইভিং সিটে; আর জানালার কাছে দুই গোয়েন্দা। দশ মিনিট ধরে জীবনের ঝাড়া ঝাড়লাম দুজনকে। জিজ্ঞেস করলাম, আমি বাংলাদেশ এমব্যাসিতে আসবো না তো কী রাশান এমব্যাসিতে যাবো! এইখানে বাংলা বলতে আসি; রাশান এমব্যাসিতে গিয়ে কী রুশ ভাষা বলবো! এখানে অনুষ্ঠান শেষে বাংলাদেশি খাবার দেয়; আমি কী সেটা না খেতে এসে রুশ দূতাবাসে রাশান খাবার খেতে যাবো!
অনেক গরম কথার শেষে; রুশ বিষয়ক জোকসে ওরা খুবই মজা পায়; বলে, আতিক সাব খুব ভালো মানুষ; আমাদের জন্যও বাংলাদেশি খাবার পাঠান। খুবই টেস্ট স্যার। আর কোনদিন স্যার আপনার ড্রাইভারকে বিরক্ত করবো না। শুধু একটাই অনুরোধ, পাকিস্তানে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান কমানোর জন্য একটু লেখালেখি করেন প্লিজ; লিখলে আজকাল কাজ হয় স্যার; ফেসবুক আসার পর। আর সহ্য হয় না; এই বৈষম্যের জীবন। আমি দুই গোয়েন্দাকে কথা দিলাম, লিখে ছাল-চামড়া তুলে নেবো, থাগস অফ পাকিস্তানের।
মাসকাওয়াথ আহসানঃ সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ