মাসকাওয়াথ আহসানঃ
ফেসবুকে আমার দুই অনুজ প্রতিম আছে; এরা আমার অপ্রিয় সব পোস্ট দেয়; কিন্তু আমার কাছে প্রিয় তারা। কারণ এদের একজন কবি, আরেকজন ফিল্মমেকার। অত্যন্ত সৃজনশীল দুই তরুণ। বাস্তব জীবনে তারা অত্যন্ত কার্টিয়াস। কিন্তু ফেসবুকে তাদের স্টেটাস পড়লে যে কেউ তাদের কর্কশ ভাববে।
আসলে সমাজ অনুকূল নয় কবিতা বা চলচ্চিত্রের জন্য। আর প্রতিভাবান তরুণের প্রতিভা বিকাশের পথ রুদ্ধ হলে; সে তেতো হতে থাকবেই। নবারুণ ভট্টাচার্য কিংবা হুমায়ূন আজাদ যে কারণে সবসময় তেতো ছিলেন।
বাইরে থেকে যারা হুমায়ূন আজাদের মন্তব্য শুনে তাকে তেতো ভাবেন; স্যারের সঙ্গে ব্যক্তিগত মেলামেশা থেকে তাদের একটু বলে রাখি, ছাত্রদের সঙ্গে মেলামেশায় হুমায়ূন আজাদ ছিলেন; অত্যন্ত কোমল ও শিষ্টাচারসম্পন্ন মানুষ।
এ কারণে কারো ফেসবুক পোস্ট পড়ে তার সম্পর্কে অনুসিদ্ধান্ত টানা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পণ্ডশ্রম।
ঈদের ছুটির তৃতীয় দিনে অত্যন্ত ঝরঝরে মুডে আটঘন্টা ঘুমিয়ে উঠতেই; ওয়ার্ল্ড ট্যালেন্ট ইকোনোমি ফোরামের প্রধান ড শরিফ রানা কুয়ালালামপুর থেকে ফোন করলো। সে অভিযোগ করলো, ইন্টারন্যাশনাল থিংক ট্যাংক গ্রুপের একটি জরুরি বৈঠক আমি মিস করেছি। কারণ অনেক ফোন করেও আমাকে পাওয়া যায়নি। অথচ ইউক্রেন সংক্রান্ত এই বৈঠকের প্রস্তাব বোধ হয় আমিই রেখেছিলাম। রানা অনুজ প্রতিম সাবেক বিতার্কিক ও একাডেমিশিয়ান। ওকে বুঝিয়ে বললাম, ঈদ উপলক্ষে গৃহের কারাধ্যক্ষ সতত মিডিয়া কমিটমেন্টে না যেতে বাধ্য করেছিলো।
রানার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে কখনো কোন কিছুতে বিরক্ত হয়না। ফলে এই ছেলে যে জীবনে সাবস্ট্যানশিয়াল কিছু করবে তা লিখে দেয়া যায়। পৃথিবীর যে কোন কৃতি মানুষকে রানা আমন্ত্রণ জানিয়ে ওয়ার্ল্ড ট্যালেন্ট ইকোনোমি ফোরামে আনতে পারে। ও বিস্মিত হয়, বাংলাদেশের কৃতি মানুষদের ভি আইপি মানস দেখে। তারা কোন কিছু না বুঝেই যে কোন আলোচনায় না করে দেন। রানা টেসলার সঙ্গে কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় তাকে পাত্তাই দেয়নি।
এমনটা কিন্তু ঢাকায় অহোরহো হয়। সৈয়দ মুজতবা আলী জীবনের শেষ কটি বছর ঢাকায় ছিলেন; তাকে কেউ পাত্তা দেয়নি। এর কারণ ঢাকার নানা রকম আলোগুলো তাদের ক্লাস্টার “আমরা আর মামুরা”-কে পৃথিবীর দৈর্ঘ্য ও পরিধি বলে মনে করে। আমি খুব সচেতন ভাবে কোন সংস্কৃতির গুচ্ছগ্রামে পাত্তা তুলতে চেষ্টা করিনা। কারণ একটা লোক ইন্টেরেস্টিং না হলে তার সঙ্গে কথা বলতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। এইজন্য বোরিং লোক সফল হলেও তাকে আমি এড়িয়ে চলি। রানাকেও ওটাই শেখানোর চেষ্টা করছি।
বিতর্কের অনুজ প্রতিমরা সতত পলিটিক্যালি কারেক্ট। তারা ফেসবুকে কাউকে নিয়ে সুইপিং কমেন্ট করেনা। এর কারণ ওরা শিখেছে বিতর্কে সুইপিং কমেন্ট করলে নম্বর কাটা যায়। জীবন-চর্যায় অনায়াসে এই সু অভ্যাস এসে যায়।
অভিভাবকেরা সবসময় ভাবেন, কী করলে তার বাচ্চাটা মানুষের মতো মানুষ হবে। আমি পরামর্শ রাখি বিতর্ক শেখাতে। তাহলে সমাজ যুক্তিবোধ সম্পন্ন হবে। তখন আর রাষ্ট্র নিয়ে সকাল-দুপুর কাঁদতে বা অভিযোগ করতে হবে না।
আমি আজকের দিনটাকে পালন করছি কার্লমার্কসের জন্মদিন হিসেবে। আর আমার অনুজ প্রতিম কবি ও চলচ্চিত্রকার আজকের দিনটিকে শাপলার “কান ধরা দিবস” হিসেবে উদযাপন করছে। অধিকার বঞ্চিত টুপি পরা কয়েকটি কিশোর কান ধরে বসে আছে এলিট ফোর্সের হারকিউলিসের নির্দেশে। সেই ছবি শেয়ার করে পুলক লাভ করেছে আমার অনুজপ্রতিমদ্বয়।
আমি খুব ছোটবেলায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-মুসলিম-ইহুদিদের পালন করা ধর্মগুলো সম্পর্কে তুলনামূলক ধর্ম ও নৈতিকতা বিষয়ে পড়েছি আমার আব্বার এনে দেয়া বইপুস্তকের আলোয়। আব্বা আমাকে ডারউইনও পড়িয়েছেন। আমার ছেলেকেও আব্বা এগুলো পড়িয়েছেন। মানে তিনি তাঁর নাতি পর্যন্ত যাতে যৌক্তিক মানুষ হয়; সে চেষ্টাটুকু করে গেছেন। আমার কবি ও অনুজপ্রতিমের পরিবারও বিদ্যানুরাগী; তাদের বাবাদের চিনি আমি; বিশিষ্ট ভদ্রলোক তারা। কিন্তু এইদুটো ছেলে শাহবাগে এমন সময় পৌঁছেছে; যখন আমরা আমাদের প্রিয় মুক্তাঙ্গণ ছেড়ে বিভিন্ন গন্তব্যে চলে গেছি। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের বিচরণের ক্ষেত্রটিতে পাঞ্জাবি পরে প্রগতিশীল হয়ে ঘুরতে শুরু করেছে, ইউনিভার্সিটি ড্রপ আউট, দূরবর্তী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। যাদের কাছে প্রগতিশীলতা হচ্ছে অন্ধের হাতিদর্শন। আমার অনুজপ্রতিমদ্বয় এই অন্ধদের সঙ্গে মিশে পরিবার থেকে শিখে আসা ইনক্লুসিভ সোসাইটির শিক্ষা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
ফার্স্ট জেনারেশন ইউরোপ প্রবাসী কিছু ছেলে-মেয়ে নিজেদের ফরাসি রেনেসাঁর আইকন হিসেবে ফেসবুকে ডিসপ্লে করেছে। আমি ইউরোপে এদের দূর থেকে দেখেছি। মিশিনি। আমি মিশতাম অন্য দেশী-অন্য ভাষীদের সঙ্গে আর আমার মাতৃভূমির শ্রমিক শ্রেণীর আলোর মানুষের সঙ্গে। বাংলাদেশে নব্য শিক্ষিত কিছু অনুজ প্রতিম আমাকে একবার বলেছিলো, আপনি শ্রমিকদের সঙ্গে এতো কেন মেশেন! আমি উত্তর দিয়েছিলাম, কারণ তারা বাংলাদেশের সম্পন্ন কৃষক পরিবারের ছেলে; এই অনাবাসে তারা কাজ সেরে দিন শেষে শাওয়ার নিয়ে; পরিচ্ছন্ন পোষাক পরে, বাংলাদেশ কালচারাল সেন্টারে গান শুনতে ও গাইতে আসেন। অন্যদিকে নব্য শিক্ষিতরা তাদের ওভারকোট ধোয় না; তাতে দেশী মশলার গন্ধ জমাট বেঁধে থাকে। আমি আসলে শ্রমিক শ্রেণীর কিংবা অধিকার বঞ্চিত মানুষের অপমান সহ্য করতে পারিনা।
কার্ল মার্কসে আত্মস্থ করেছি, খুব অল্প বয়সে।
তাই ফেসবুকে কাউকে যখন দেখি নব্য ধনী বা নব্য শিক্ষিত হয়ে শ্রমিকশ্রেণীকে নিয়ে উপহাস করছে; তখন নিতান্ত বাধ্য হয়ে রম্যরচনায় উপহাস করি নিও প্রগ্রেসিভ ও নিও এফ্লুয়েন্টদের। কারণ নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে।
পৃথিবীতে পুরোপুরি সাম্য আসার ভাবনা ইউটোপিয়া। কারো টাকা বেশি, কারো টাকা কম, কারো ভালোবাসা বেশি, কারো ভালোবাসা কম থাকবেই। কিন্তু আমি দাবি করি মানসিক সাম্য, যেখানে প্রতিটি মানুষ সমান সম্মান পাবে, প্রতিটি অধিকার বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াবে সমাজ, প্রতিটি ভালোবাসাহীন মানুষের পাশে দাঁড়াবো আমরা।