মাসকাওয়াথ আহসান
অনুজ প্রতিম সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিনের সঙ্গে আমার একটা কাকতালীয় সম্পর্ক আছে। সে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ছেড়ে গেছে; আমি সেখানে যোগদান করেছি; আবার আমি ডয়চেভেলে ছেড়ে এসেছি; সে ওখানে যোগদান করেছে। আমরা দুজনেই সিভিল সার্ভিস ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতায় এসেছি। আমরা দুজনেই সোসাইটি ফর প্রফেশনাল জার্নালিস্টস-এর কোড অফ এথিকস অনুসরণ করি; জার্নালিজমের ম্যাগনাকার্টা হিসেবে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই কোড অফ এথিকস বলে; সাংবাদিক কারো নয়; কেবল সত্যের ও সত্যান্বেষণের।
গত শুক্রবার ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দামকে ডয়চেভেলে টকশোতে ডেকে তাকে কথিত “কঠিন” প্রশ্ন করায়; আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা ফেসবুকে যেরকম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখালেন; একই ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছিলো ২০০৪ সালের অগাস্টে। ডয়চেভেলে আমার করা রিপোর্ট-ইন্টারভিউ-স্পেশাল সিরিজ বিএনপি-জামায়াতের স্বার্থে আঘাত হানায়; দিনকাল পত্রিকায় ঠিক এমন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছাপা হয়েছিলো আমাকে নিয়ে। আজ আওয়ামী লীগের লোকেরা খালেদকে যেমন বিএনপি সমর্থক প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে; ২০০৪ সালে বিএনপি সমর্থক মিডিয়া ঠিক তেমনি আমাকে আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো।
খালেদের ২০২৩ সালের অভিজ্ঞতা আর আমার ২০০২ সালের অভিজ্ঞতা এক জায়গায় করলে; বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংকট; স্বাধীন সাংবাদিকতার ঝুঁকি চোখে পড়ে। বাংলাদেশে এক এগারোর পরিবর্তন না ঘটলে দেশে ফিরে বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোরে যোগদান আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। বিএনপির যারা আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে দিনকাল পত্রিকাকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন; তারা নিজেরা তখন জেলে ছিলেন। সেই সুযোগে আমি মুক্তভাবে আমারই মাতৃভূমিতে ঘুরেছি।
বিএনপির দিনকাল তাদের চিন্তার দৈর্ঘ্য দিয়ে ভেবেছিলো; আমি বোধ হয় তাদের মতো ইউরোপে স্থায়ী হবার জন্য লালায়িত। তারা যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে উঠে এসে দিনকালে সম্পাদক ও প্রতিবেদক হয়েছেন; তা আমি জানি। ফলে তাদের ওপর আমার কোন রাগ নেই। ভাগ্য আমাকে তাদের মতো অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্তরে জন্ম দিলে সত্যিই আমি পশ্চিমে স্থায়ী হয়ে সামাজিক ভাতায় “ভিক্ষুকে”র জীবন যাপন করতাম। বাংলাদেশে যে ভিক্ষুক; সে অনাবাসে গিয়েও ভিক্ষুক। ওয়াইন চেয়ে খায়; পরিশ্রমী প্রবাসী বাংলাদেশীদের অর্ধ শিক্ষিত বেকার সাংঘাতিক ভাই হিসেবে “নিজের জীবনের বাঘ মারার গল্প শোনানোর বিনিময়ে” খাদ্য জোগাড় করে।
কিন্তু আমার বা খালেদের যে পরিশ্রম করে খাওয়া জীনগত। আমরা আমাদের দাদা-দাদী-নানা-নানী-মা-বাবাকে পরিশ্রম করে খেতে দেখেছি। সন্তানের মুখে হালাল অন্ন তুলে দেয়ার ব্যাপারটা রক্তে থাকে। রক্ত কথা বলে।
বিএনপির গালাগালির বিনিময়ে খাদ্য (গাবিখা)-র “রহমত ভাইদের” সেই ২০০৪-এর গালাগালের প্রতি আমি সহানুভূতিশীল। আমি তাদের সন্তানদের সুস্থ জীবন প্রার্থনা করি।
আওয়ামী লীগের গালাগালির বিনিময়ে খাদ্য (গাবিখা)-র এই ২০২৩-এর “সহমত ভাইদের” গালাগালের প্রতি খালেদও সহানুভূতিশীল। কারণ জীবন তাকে নিজ হাতে একটি আনন্দময় কাজের জীবন দিয়েছে। পরিশ্রমী দায়িত্বশীল উচ্চ শিক্ষিত স্ত্রী দিয়েছে। সম্ভাবনাময় স্নিগ্ধ সন্তান দিয়েছে। তার নৈর্ব্যক্তিক সাংবাদিকতার জন্য প্রশংসা দিয়েছে। খালেদ তাই সাংবাদিকতা নৈতিকতায় অবিচল থেকে কন্ঠস্বরহীনদের কন্ঠ দিয়েছে।
গণভবনের “প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছি” অনুষ্ঠানের বিদূষকেরা কিংবা বাতাবি লেবু বাগানের মিডিয়া যখন গণশত্রু; সরকারকে তেলাঞ্জলির বিনিময়ে খাদ্য (তেবিখা) প্রকল্পে এই স্তাবকেরা যখন প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে; বাংলাদেশের জনমানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে ফ্যাসিজমের নির্লজ্জ সারিন্দা হয়ে বাজছে খামবাদিকেরা; খালেদ তখন জনমানুষের পক্ষে নিরাপোষ এক কন্ঠস্বর।
বিগত বিএনপি-জামায়াত আমলে খালেদ সংবাদপত্রে ঋজু সাংবাদিকতা করেছে। আইনের শাসন হীনতা, মানবাধিকার হীনতা, দুর্নীতি, দুঃশাসন নিয়ে নির্ভীকভাবে রিপোর্ট করেছে। তখন সে আওয়ামী লীগের অন্নে লালিত সাংবাদিকদের প্রিয়পাত্র ছিলো। এমনকী দেশে থাকতেও সে যখন ইনডিপেন্ডেন্ট টিভিতে স্বাধীনভাবে কাজ করেছে; তখনও আওয়ামী লীগের আপ্পিরা পার্টিতে দেখা হলে, “বড় হা” করে খা-লে-দ ভাই বলে ডাক দিয়ে দূর থেকে দৌড়ে এসেছে।
কিন্তু ডয়চেভেলেতে যাবার পর একই খালেদ যখন স্বাধীন সাংবাদিকতা করেছে; প্রশ্নহীন বাংলাদেশে প্রশ্নের সংস্কৃতি চালু রেখেছে ইউরোপের হৃদয় থেকে; তখন আওয়ামী লীগের সারিন্দারা বড্ড নাখোশ হয়েছে।
চার্টার্ড বিমানে করে যে চাটার দল ইউরোপে যায় সরকারের সমভিব্যহারে; তারা যখন খালেদকে মুক্ত সাংবাদিক হিসেবে দেখেছে; একইরকম হাসিখুশী খালেদের দেখা মিলেছে ইউরোপে; তখন নিজের মনের মধ্যে ঝড় উঠেছে দাস সাংবাদিক লীগের। মনে মনে ভাগ্যকে গালি দিয়েছে তারা। “ইভিল আইজ” দিয়ে চোখ টিপে দিয়েছে ফেসবুক সুইপার লীগকে, যা খালিদের দরজায় এক পাত্র মল ঢেলে দিয়ে আয়, তোকে সরকারি টাকায় শিভাস খাওয়াবো।
এই যে সুইপার লীগ; যারা ভিন্নমতকে বিএনপি ট্যাগিং করে; এটা এদের জীনগত। এদের দাদা বৃটিশ বিরোধী সৎ মানুষদের সন্ত্রাসী বলে ট্যাগ করে; সাহেবের বাসার লেফট ওভার খেতো; সাহেবের আদরের কুকুর টমির পাশে বসে। সুতরাং নাতিও ফ্যাসিজম বিরোধী সৎ মানুষকে “বিএনপি” বলে ট্যাগ করার পর; আওয়ামী লীগের নতুন সাহেব; লুন্ঠনের পয়সায় যে জমিদার হয়েছে বছর দশেক হলো; তার বাড়ির বেড়াল মিনির পাশে বসে লেফট ওভার খায়। এ হচ্ছে লেফট ওভার খাওয়ার বংশধারা।
এই যে যারা যুক্তি-বুদ্ধিতে কাউকে ঘায়েল করা না গেলে নিজের কল্পনার থার্ড রেট “বেড রুমের গল্প” ফাঁদে; এদের দাদি ছিলো গোবরডাঙ্গার ফুচকি বেগম। মানুষের বাসায় ফুচকি দিয়ে এসে কলতলার পাশের দেয়ালে গোবরের ঘুটে দিতে দিতে বলতো, জানিস কী হয়েছে, আনিস মাস্টারের বউ গেছে বাপের বাড়ি; আর মাস্টার দেখলাম তার উঠোনে “ঢেমনি” নাচাচ্ছে; ছি ছি ছি ছি”। কৃমিতে পেট ফোলা সফেদা-জরিনা-পাপিয়ার থুতু উতপাদিত হয় গীবতের রিফ্লেক্সে। এমন কী, মাতবর সাহেবের বাঁধা মেয়ে মানুষ তখন বিচারকের মতো রায় দেয়, আনিস মাস্টর দুঃশ্চরিত্র। দ্যাটস আওয়ার কালচারাল হেরিটেজ। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি।
এই সংস্কৃতির ধারক-বাহকেরা রবীন্দ্র-নজরুল পদাবলী নিয়ে সংস্কৃতি এলাকায় পোগোতিচিলের ভং ধরে। টিভিতে রুচির গজদন্তের মিনার হয়ে জাতিকে বড্ড রুচি চানাচুর বিতরণ করে। আর টকশোতে সেন্টমার্টিনের এক যে বোকা শেয়ালে; লাগলে ক্ষিদে উন্নয়ন এঁকে দেয়ালে; চাটতে থাকে আপন মনে খেয়ালে।
চোরের খনি লুটের টাকা লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না; এমেরিকার ভিসা স্যাংশনের দাবড়ানি খেয়ে; পাপিয়ার আসরের খদ্দের তালিকায় যাদের নাম প্লাটিনাম অক্ষরে লেখা আছে; উন্নয়নের মিথ্যাবাদী রাখালেরা বাঘের ক্ষপ্পরে পড়ে ইয়া নফসি ইয়া নফসি করছে। আর এদিকে তাদের নির্বোধ সহমত ভাই, সহব্রত দাদা, পিউ-পাপিয়া আপ্পিরা, বাপের বেটা সাদ্দামের “সততার’ পোস্টার ঝুলিয়ে কিংবদন্তীর সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দীনকে শিকারের চেষ্টা করে চলেছে গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে।
ঐ যে জোনাথন সুইফটের গালিভারস ট্রাভেলসের লিলিপুটিয়ানরা যেমন গালিভরকে সুতো দিয়ে বেঁধে কয়েকদিন তার দিকে টুথ পিকের মতো তীর ছুঁড়েছিলো।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া