মাসকাওয়াথ আহসান
বস্টনের সিটি সেন্টারে ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা যেখানে জীবন উতসবে মাতে; সেইখানে সানগ্লাস পরে কেমিকেল আলী লুকিয়ে লুকিয়ে স্বল্পবসনা পুষ্পের রেণু মাখছিলো। দু’একটি বিড়ালাক্ষী বিধুমুখি আড় চোখে তাকিয়ে দূর থেকে, হেই স্টকার গো ব্যাক টু ইওর জাঙ্গল; বলে চলে যায়। সানগ্লাস খুলে কেমিকেল আলী বিড় বিড় করে উত্তর দেয়, স্নব কোথাকার; কী হয় একটু আফ্রোদিতির দেহবল্লরীর শিল্প খাঁজে চোখ পাতলে; ক্ষয়ে যাচ্ছে না তো তোমাদের সৌন্দর্য্যের আনাতালিয়া।
হঠাত চোখে পড়ে যুবরাজ উদয় হোসেন বসে কফি খাচ্ছে ছাতার নীচের রোদ ক্যাফেতে। কেমিকেল দৌড়ে গিয়ে সালাম দেয়। অদৃশ্য সাবানে হাত কচলায়; তার চোখে মুখে আকুতি, আমারে নিবা মাঝি!
উদয় হেসে বলে, দাঁড়িয়ে কেন কেমিকেল; বোসো; এটা তো বাগদাদ নয়; এটা বস্টন; এখানে বাদশাহ-ফকির; টাঙ্গার মালিক-টাঙ্গাওয়ালা সবাই সমান। এটা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ।
এরপর থেকে কেমিকেল হাতে আকাশের চাঁদ নিয়ে ঘুরে; তিকরিতে কৃষকের বাড়ি বাড়ি সাইকেলে চড়ে ঘুরে ঘুরে বীজ-সার-পরামর্শ বিতরণ করতে করতে বাবার নামই পড়ে গিয়েছিলো সাইকেল আলী। টানাটানির সংসারে কেমিকেলের মন বসতো না পড়ালেখায়। মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিলে তাইগ্রিস নদীতে পুঁটি মাছ ধরতে ধরে কেমিকেল স্কুলের পাঁচিল টপকায় পুঁটিমারা জুনিয়র হাইস্কুল থেকে। এরপর মাত্র ৩৫ ইরাকি দিনার হাতে নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে বাগদাদে এসে মার্কিন দূতাবাসে আরো সব ধনীর আবাসে ফুলের বুকেই পৌঁছে দেবার কাজ নেয়। সারাদিন সাইকেলে করে ফুলের ডালি ডেলিভারি করা; রাতে টোফেল-জি আর ই মুখস্ত করা।
সাহেবদের ফুল দিতে দিতে কেমিকেল ভাগ্যের ধাক্কায় পৌঁছে যায় মার্কিন মুল্লুকে। একটা অনাম্নী বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনে ক্লাস; রাতে রেস্তোরার প্লেট গ্লাস; ঘষতে ঘষতে জিভ বেরিয়ে গেলে; দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, কী হতো তিকরিতে সাইকেল আলীর কাজটা শিখে নিলে; তবু তো ঈদের দিনে মায়ের হাতের যবের রুটির সঙ্গে গোশত খেয়ে এক চিলতে ছাদে নিঃশ্চিন্তে ঘুমানো যেতো।
ভাগ্যের দ্বিতীয় ধাক্কায় কেমিকেল আলী উদয় হোসেনের ছায়াসঙ্গী হয়ে; ডিসকোতে শরাব এনে দেয়া; ড্রাংক ড্রাইভিং-এ যুবরাজের মামলার বদলী আসামী হিসেবে ক’টাদিন জেলে কাটানো; আরো কতো স্যাক্রিফাইসের ইতিউতি তার প্রবাস জীবনে। কিন্তু চিঠিতে মাকে অনায়াসে লেখা যায়, হাতের মুঠোর আকাশের চাঁদ আম্মা, আমরা আর মিসকিন নই; রাজার ছেলের আশীর্বাদে সাদা বাঘ; আম্মা জানো, আমি এখন স্পোর্টস কারে চড়ি; খুশিজল খেয়ে হালুম করি।
বাগদাদে সেই ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগানে আরো সব ইঁদুরগুলো আক্ষেপ করে; কোথাকার কোন কেমিকেল আজ ইঁদুর থেকে সাদা বাঘ হয়ে হালুম করছে; আর আমরা এখনো গোলাপের ঝাড়ে চিঁ চিঁ করছি।
কেমিকেল আলী ঘোষণা করে, তার পরিবারের গর্বিত ইতিহাস আছে; তার বাবা সাইকেল আলী; কুয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরাকি সেনাদের ট্রেঞ্চে ট্রেঞ্চে রুটি আর খেজুর পৌঁছে দিতো। সাইকেল আলী ইরাকের মুক্তিযোদ্ধা। তিকরিতে বাড়ির সামনে সাদা পাথরে কালো অক্ষরে লেখা হয়, সাইকেল আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা।
সাদ্দামের প্রাসাদে উদয় তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। স্নুকার টেবিলে খুশিজলের মজমা বসিয়ে বলে, কেমিকেল, তোমাকে গোয়েবলস হতে হবে। আমি যেসব কথা বললে তা পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট হবে; তুমি সেসব বলবে ইরাকি সরকারি ও তরকারি টিভিতে।
কেমিকেল আলী টের পায়না; উদয় ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স পড়েছিলো; ডার্টি জব করাতে হয় নিম্নবর্গের লোক দিয়ে। তারপর লোকজন নিম্নবর্গের ডার্টি ওয়ার্কারকে ন্যাস্টি বলে গালি দিতে শুরু করলে; দ্য প্রিন্স আসেন জনগণের রক্ষা কর্তা হিসেবে। স্যাভিয়ার প্রিন্সকে দেখে নতুন আশায় বুক বাঁধে প্রজারা। যারা ঈশ্বর অথবা রাজার স্বপ্ন নিয়ে উঞ্ছজীবন যাপন করে পোকামাকড়ের মতো।
কেমিকেল আলী টিভিতে আঙ্গুল উঁচিয়ে চুল ঝাঁকিয়ে গলা ভাঁজিয়ে পুঁটি মাছ ধরে; আর লাস্যময়ী টিভি হোস্ট আনন্দে গদ গদ হয়ে সেগুলো মুঠোয় নেয়। ভিন্নমত পোষণকারী বয়েসী সাংবাদিক, রাজনীতিক, শিক্ষক সবাইকে কেমিকেল আলী বলতে থাকে, আপনি থামেন, আপনি তো কিছুই জানেন না; আপনি তো দেখছি বুশের সমর্থক; ইরাকে কেন; এমেরিকা চলে যান না কেন? আপনি ভুল বলছেন; ঠিকটা শুধু আমি জানি; আমার কথা শুনুন; শুধু আমি বলবো; আর আপনারা শুনবেন।
ইরাকি ভাষার সঙ্গে প্রতিটি শব্দে ড় ড় করে ইংরেজির অনুপ্রাশ এনে কেমিকেল বড় বড় করে তুলে ধরে, আমি এমেরিকা ফেরত।
বাগদাদের তুমুল কফিশপে, পাঁচতারা হোটেলের ইরাবতী পিউ পাপিয়ার আসরে সাদ্দামের ধেড়ে ইঁদুরদের হার্টথ্রব হয়ে পড়ে হোয়াইট টাইগার কেমিকেল আলী! বসরা থেকে আসা মুদি দোকানি শাহালম শুধু একটা সেলফি তুলে; বসরা ফিরে মুদি দোকানে টাঙ্গিয়ে রাখে হোয়াইট টাইগারের ছবি। বসরার লোকেরা ভয় পেয়ে যায়। শাহালম তখন কেমিকেলকে অনুকরণ করে গাল ফুলিয়ে সাদা বাঘের মতো হালুম করে।
উদয়ের বন্ধু বলে সাদ্দাম হোসেনকে আংকেল ডেকে নিজের পৃথুল দেহের মেদের প্রাচীরের মধ্যিখানে একটা গজদন্তের মিনার তৈরি করে কেমিকেল আলী। ফোন করে সাইকেল আলীকে বলে, আব্বা হুজুর ঐসব ঝোলাঝাফপু পরে মসজিদে যাওয়া বন্ধ করেন। সাদ্দাম আংকেলের মতো স্যুট পরে ঘুরেন, যেটা এমেরিকা থেকে এনে দিয়েছি। সাইকেল আলী বিমর্ষ বদনে বলেন, এতো গরমের মধ্যে স্যুট।
আপনি তো বোঝেন না। চুপ করেন। আমি জানি। আমাকে বলতে দেন; আমি সব জানি! আমি বলবো আপনি শুনবেন।
সাইকেল আলী তার অসুস্থ স্ত্রীকে বলেন, তোমার ছেলে আমাকে ফোন করে করে রাজকীয় ধারাপাত শেখায়। আরে গাধা! রাজার ছেলের বন্ধু হলেই কী রাজা হওয়া যায়! ইরানের শাহের ছেলের বন্ধুরা; যারা একসময় ইঁদুর থেকে মোটা সাদাবাঘ হয়েছিলো; তারা শাহের পতনের পরে আবার শুকিয়ে ইঁদুর হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কেমিকেল আলীকে এই তিকরিতের ইঁদুরের গর্তেই লুকাতে হবে; আমি বলে রাখলাম।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া