মাসকাওয়াথ আহসান
বগুড়ার ছিপছিপে গড়নের অখ্যাত পরিবারের ছেলেটা টিভির কেবল অপারেটর হিসেবে স্বপ্ন দেখতো নায়ক হবার। কেবল দেখানো চলচ্চিত্রের শুভ নায়কের মতো অশুভের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্যের জয় দেখার স্বপ্নের আকুল হতো। স্বপ্ন ছিলো তার নায়ক হবার। কিন্তু আমাদের বর্ণবাদী সমাজে নায়ক হতে গেলে গাত্রবর্ণ ফর্সা হতে হয়; লাল্টু মার্কা নাহলে ফেয়ার এন্ড লাভলি মেখে ফর্সা হওয়া কল্পনার আর্য নায়িকারা নায়কের প্রেম গ্রহণ করেনা।
তবু ইন্টারনেট এসে ঢাকার শোবিজের কল্পনার আর্য মন্দিরের কতৃত্ব কমে এলে; কেন্দ্র ও প্রান্তের ধূসর বিভাজন অর্থহীন দেখালে; হিরো আলম নায়ক হয়; নিজের বানানো চলচ্চিত্রে।
তা দেখে আমাদের এক পুরুষে শিক্ষিত জিনস টি-শার্ট পরা বাতেন; নিজের নাম পথিকৃত বাতেন রেখে; কিংবা টপস জিনস পরে কপালে কপালকুন্ডলার মতো টিপ দেয়া আকলিমা নদী; হাহাহাহাহা করে হাসতে শুরু করে। ঐ যারা গ্লোরিয়া জিনসে কফি খেয়ে জাতে উঠছে; তাদের জাতে ওঠার সিঁড়ি হয়; হিরোকে দেখে হাসা!
ফেসবুকে হিরোকে নিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলেই জুটে যায় এলিটের সার্টিফিকেট। তখন আবার সংস্কৃতির এক ব্রান্মণ পুরোহিত ফতোয়া দিয়ে বসেন, রুচিটা ঠিকই ছিলো শাহবাগের হারমোনিয়ামে; ছায়ানটের রবীন্দ্র প্রাসাদে; বেইলি রোডের এলিট থিয়েটারে। কিন্তু এই ইন্টারনেটে হিরো আলম এসে “রুচির দুর্ভিক্ষ” এলো!
ছ্যা ছ্যা পড়ে গেলো সবুজ লুঙ্গি খুলে পার্টির টাকায় জিনস টি শার্ট পরা সহমত ভাই কিংবা খসখসে ধুতি খুলে নক্সী পাঞ্জাবি রেশমি ধুতি পরা সহব্রত দাদামহলে। গোলটেবিলে দুর্বাদাস চঞ্চল হয়ে উঠে বললেন, এ তো মেনে নেয়া যায় না। দলিতের বড্ড বাড় বেড়েছে; নট নটী জোগাড় করে ইন্টারনেটে বড্ড রুচিহীন ভিডিও কইচ্চে।
সবাই মিলে দলিত হিরো আলমের কপালে ছ্যাকা দিলে; পুলিশের সংগীতজ্ঞ তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে, রবীন্দ্রনাথ জমিদার ছিলো; তুই গরীবের পোলা তার গান গেয়েছিস কোন সাহসে। আর হিরোরা থাকে বড় বড় গৃহে; তুই ভাঙ্গাঘরে চান্দের আলো হইতে চাইলে কিন্তু খবর আছে; মুচলেকা দিয়ে যা, নিজেকে হিরো বলবি না; রবীন্দ্র রাজার গান গাইবি না!
কিন্তু হিরো যে ঐ কেবল টিভিতে নায়কের উত্থানের অগ্নিপথ দেখেছে; একদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে খোলনলচে বদলে দেয়ার অনিল স্বপ্ন দেখেছে। সুতরাং বগুড়ার উপনির্বাচনে দাঁড়িয়ে যায়। অত্যন্ত আইন মানা নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করলে সে আদালতে যায়। আদালত কী ভেবে জানিনা তাকে নির্বাচনে লড়ার সুযোগ দেয়। সেই নির্বাচনেও হিরো ২০ হাজার ভোট পেয়ে জিতে যাবার উপক্রম হলে; উন্নয়নের অংশীদার মহাজোটের এক অপরিচিত মশাল নেতা জাদুবাস্তবতার বিজয় পায়। হিরো হেরে যায়; দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে, আমি অশিক্ষিত হিরো এমপি হলে যদি আমাকে স্যার বলতে হয়; তাই রিটার্নিং অফিসারেরা ছলচাতুরী করে আমাকে হারিয়ে দিলো।
বৃটিশেরা সাঁওতাল যুবক সিধু ও কানু ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দ্রোহী হলে; তীর ধনুক বাগিয়ে ধরলে; বৃটিশ রাক্ষস গুলি করে তাদের বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলো।
সেই সিধু কিংবা কানুর জাতিস্মর কী আজকের হিরো আলম; যাকে শিকারের চেষ্টা করছে বৃটিশ-পাকিস্তানের উপনিবেশের প্রেতায়িত আত্মা; আজকের স্বদেশী উপনিবেশের ভূতের নাচনগুলো।
ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নেয় হিরো। আমরা তার সাক্ষাতকার নিলাম দ্য এডিটর ওয়েব শোতে! ক্ষমতাসীন সরকারের হেভিওয়েট প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত; যে ফেসবুকে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বন্ধু পরিচয় দিয়ে অন্তরঙ্গ ছবি শেয়ার করে; সেই ক্ষমতা করিডোরে সানগ্লাস দুলিয়ে ঘোরা; টকশোতে প্রবীণ সাংবাদিক, শিক্ষক, প্রতিপক্ষের রাজনীতিককে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে যে এলান করে সরকারি বয়ান! তার বিরুদ্ধে ইলেকশন করার সাহস আসে কোত্থেকে!
হিরো আত্মবিশ্বাসীর ভঙ্গিতে বললো, স্বপ্ন না থাকলে আর কী থাকে! সংসদে তো বড় বড় মানুষের বড় বড় কথা। ছোট খাট মানুষের কথা বলার জন্য আমার মতো একজন ছোট খাট মানুষ গেলে তো ভালো। আমি তো ছোট খাট মানুষের জীবনের সমস্যাগুলোর কথা জানি। বড়লোকেরা তো ছোট খাটো মানুষের খবরও রাখে না! তাই কী যেন সব বলে সংসদে।
প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার ভয় করেনা ক্ষমতার এতো বড় বুলডোজারের সামনে দাঁড়াতে? হিরো স্মিত মুখে বলেছিলো, শুরুতেই ভয় করলে তো আশা শেষ হয়ে যায়। আমি ভয় পাইনা। আমি তো বন্ধু ও শত্রুদের ভালোবাসা জিততে চাই। ঐ যে সামনে অভিজাত এলাকা দেখছেন ঢাকা-১৭-তে; এর পিছে অনেক বড় বস্তি; যেখানকার মানুষের ভালোমন্দের খবর কেউ জানেনা। কিন্তু আমি তাদের খবর রাখি; আমি যে তাদের দুঃখ বুঝি।
হিরো সাহস করে নির্বাচনী প্রচারণায় নামলে; প্রথমে নারী দুর্বৃত্তরা তার ওপর হামলা চালায়। সেই হামলা থেকে হিরোর আত্মরক্ষার ভঙ্গির ভিডিও দেখিয়ে টিভি টকশোর রুচিশীল সহমতেল সঞ্চালিকা বলে, আপনি নিজেই তো দেখছি হাত তুলেছেন ওদের গায়ে!
এই টিভিগুলো নেসেসারি ইলিউশানে হিরোকে “খারাপ” তকমা দেয়ার বৃথা চেষ্টা করে। কারণ মিথ্যার বেসাতি করে সহমতেল টিভি টকশোগুলো বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।
নির্বাচনের দিনে সরকারি প্রার্থী কালো চশমা আর সাদা পোশাকের টিভি বাইটে ভোটের পরিবেশে খুশি প্রকাশ করেন; জিতবেন এমন কথাও বলেন। জয় বাংলা বলে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে এগিয়ে চলে বিজয়ীর এন্টোরাজ।
আর হিরো আলমকে তখন তাড়া করে বেড়াচ্ছে দুবৃত্তরা। দেশের সেরা দৈনিকগুলোরও সাহস নেই; এই দুবৃত্তদের পরিচয় প্রকাশ করার; যারা হিরোকে মাটিতে ফেলে পিটিয়েছে। এ যেন সেই শতবর্ষের ইতিহাসের ফিরে ফিরে আসা; জমিদারের কোটাল পুত্ররা নির্দয়ভাবে পেটাচ্ছে দ্রোহী যুবককে; তাকে মনে করিয়ে দিতে; সে নিতান্ত প্রজা; রাজতন্ত্রের মুল্লুকে সে নেহাত উলুখাগড়া।
সিধু ও কানু কী ভিড়ের মধ্যে থেকে দেজাভূঁ দেখেছিলো; যে দৃশ্য বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের উপায়হীনতার মর্মান্তিক দৃশ্য; শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন; আর ভীতির বিষাদ সিন্ধুতে; আর যেন “হিরো আলমের” মতো ছোট খাট মানুষের ঈশ্বরেরা ভোটে না দাঁড়ায়। ভোট বাস করে ঈশ্বরের গৃহে; গণতন্ত্র সেখানে রুপালি হাঁস হয়ে চরে রাজসরোবরে।
গরীবের ছেলে হিরো আলমকে পিটিয়ে দাও; আর যেন হিরো আলমেরা নির্বাচনে দাঁড়ানোর সাহস না করে। ঈশ্বর আর তার ভদ্রপল্লীর তালুকে ঢাকা-১৭-র বস্তি যেন প্রজা হিসেবে নিজের আওকাতটা চিনে নেয়; রাস্তায় গড়াগড়ি খেয়ে নির্যাতন হজম করা হিরো আলমের আওকাত। রাস্তার পাশের প্রজা-ঘাসের সবুজ আর দ্রোহীর শরীর থেকে বের হয়ে আসা লালরক্ত যেন ফিস ফিস করে গায়, আমার সোনার বাংলা; আমি তোমায় ভালোবাসি।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া