কাকন রেজা : বেশ কিছুদিন আগে লিখেছিলাম ‘স্যার সিনড্রম’ নিয়ে। কদিন আগেও গণমাধ্যমে দেখলাম এক ‘স্যার’ এর ‘ক্রসফায়ার’ ভক্তি। প্রিয়জন ‘ই-সাউথ এশিয়া’র প্রধান সম্পাদক মাসকাওয়াথ আহসান তা নিয়ে লিখলেনও। উনার স্যাটায়ার বরাবরই চমৎকার। তার ‘স্যার ডাক শোনার আকুতি’তে সিনড্রমের বিষয়টি চমৎকার ভাবে উঠে এসেছে।
কদিন আগেই সংস্কৃতি বিষয়ক একটি লেখায় বলেছিলাম জেনেটিকস নিয়ে। জেনেটিকসের সাথে ‘স্যার সিনড্রম’ বিষয়টিও যুক্ত তাই আবার বলা। বলেছিলাম, নিম্নবর্ণের যারা এক সময় মুসলমান হয়েছিলেন, তাদের কিছু লোকের মধ্যে হলেও আর্য চিন্তা প্রচ্ছন্নভাবে ছিলো। ছিলো জাতপাতের বিষয়। তারা যে উঁচু জাতের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলো, তারই প্রতিশোধস্পৃহা ধরে রেখেছে তাদের জিন। সাম্যের ছায়াতলে এসেও তাদের কেউ কেউ প্রতিহিংসার সেই ধারা বিস্মৃত হয়নি। জেনেটিকস বিজ্ঞান, একে অস্বীকার করার উপায় নেই। জিনগত বৈশিষ্ট্য পরম্পরায় বহন করবে এটাই স্বাভাবিক। সেই জেনেটিক প্রতিশোধস্পৃহারই পোশাকি নাম ‘স্যার সিনড্রম’। যার দ্বারা মাঝেমধ্যেই আক্রান্ত হন আমাদের স্যারগণ।
মাঝখানে বাঁটে পড়েন আমাদের আমজনতা। এক সময় জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে রায়ত বা প্রজা ছাতি মাথায়, জুতা পায়ে হেঁটে যেতে পারতো না। এটা ছিলো বেয়াদবি। জমিদাররা এই বেয়াদবির বিপরীতে প্রজাদের শাস্তি দিয়ে নিজেদের প্রতাপ জাহির করতেন। এক ধরণের স্যাডিস্ট আনন্দ যাকে বলে। জমিদারদের এমন স্যাডিজমের শিকার কোনো কোনো প্রজাদের মনেও জমিদার হওয়ার বাসনা জেগে উঠতো। তারাও ভাবতো, যদি একদিন জমিদার হই সব সুদে-আসলে শোধ করে নেব। জমিদারদের কাল শেষ, কিন্তু জিন তো ধরে রেখেছে সেই ইচ্ছা। তাই যখন সুযোগ পায় তখন সেই সুপ্ত ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
অতীতের জমিদার পরিণত হয় হালের স্যার-এ। আর সেই পরিণত হওয়া ‘স্যার’ তার স্যাডিস্টিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করেন নিরীহ জনতার উপর। কখনো জেলে দেয়া কখনো বা ক্রসফায়ারের বাসনা সেই প্রক্রিয়ারই প্রকাশ। মানুষ পশুও বটে। কথাটি চিরন্তন সত্য। মানুষ নিজের বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা পাশবিকতাকে ঢেকে রাখতে পারে বলেই তারা মানুষ। এভাবে সঠিক পরিবেশ থাকলে ‘স্যার সিনড্রম’ও ঢাকা থাকে। কিন্তু পরিবেশ যখন বেঠিক হয়ে ওঠে তখন ‘সিনড্রম’ আর চাপা থাকে না, প্রকাশিত হয়।
তারই নজির আমরা গণমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই দেখতে পাই। পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এক যুগ আগের কথা মনে হয়ে গেলো। আমার ছোট্ট জেলা শহরকে উদাহরণ হিসেবে সামনে রেখেই বলি। সে সময় সরকারি কর্মকর্তা ডিসি-এসপি যারাই আসতেন, তারা প্রথমেই শহরের রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা জানতেন। রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী তথা লেখক-সাংবাদিক যারা আছেন তাদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন। আর সে অনুযায়ী কখনো নিজেরাই এসব মানুষদের সাথে যোগাযোগ করতেন। প্রয়োজনে পরামর্শ করতেন। সে সময়গুলোতে এই ‘স্যার সিনড্রম’ এর উৎকট প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়নি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে এখন কেন এমনটা হয়। এমনটা হয় মূলত শৃঙ্খলাজনিত কারণে। প্রশাসনিক কাঠামোতে যদি শৃঙ্খলার চাইতে প্রভাব বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে তাহলে প্রশাসনিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক সময় তা ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়া কাঠামোতে মনের গোপন ইচ্ছাগুলো পূরণের খায়েশ জাগে। জিনের ভেতর থাকা ‘স্যার সিনড্রম’ জাগ্রত হয়। ভাঙা বোতলের দৈত্যের মতন তখন তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ওঠে। যা ভয়াবহ ধরণের বিপজ্জনক। এবং তা আমজনতার জন্য তো বটেই রাষ্ট্রের জন্যও।
এই যে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী, লেখক-সাংবাদিক, শিল্পী, পরিবেশকর্মীদের সাথে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ঝামেলা বাঁধছে যার ফলে সরকারকে পর্যন্ত চরম পর্যায়ের বিব্রত হতে হচ্ছে। এর কারণ হলো সেই প্রভাব। আগে যেমন সমাজকে মানিয়ে চলতে হতো সরকারি কর্মকর্তাদের; হালসময়ে শুধু প্রভাবশালীদের মানালেই অনেকটাই চলে যায়। আর না মানাতে পারলে পুরোটাই ভোগে যায়। হয় চাকরি নিয়ে টানাটানি হয়, না হয় সোজা আলাপে বদলি। সুতরাং সেই হ্যাপায় কেউ পড়তে চায় না বলেই কর্মকর্তাদের কাছে সামাজিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীদের প্রয়োজন কমে গেছে।
বরং এসব সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি অংশ যারা প্রভাবের জোরে ‘স্যার সিনড্রম’-এ ভোগেন তারা সামাজিক নেতৃবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবী তথা লেখক-সাংবাদিকসহ অন্যান্যদের উল্টো একহাত দেখে নিতে চান। ওই যে, ‘ষাঁড় নাচে খুঁটির জোরে অবস্থা’ আর কী। যার ফলেই ঝামেলার সৃষ্টি হয়।
না, শুধু ‘স্যার সিনড্রম’ওয়ালাদের কথাই বলছি না, এই সিনড্রম জাগ্রত করার দায় আমাদের সামাজিক নেতৃবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবীদেরও আছে। সম্প্রতি একটা খেলারমাঠ নিয়ে সৃষ্ট আন্দোলনে একজন পরিবেশকর্মী এবং তার সন্তানকে থানা হাজতে আটকে রাখা হলো। একজন অপ্রাপ্তবয়স্ককে থানা হাজতে আটকে রাখা আইন এবং মানবিকতার খেলাপ। আর এই খেলাপ শাস্তিযোগ্য। কিন্তু শাস্তি হবে না। কেন হবে না, সে কথা বলতে গেলেই অনেকে মন খারাপ করবেন।
যিনি পরিবেশকর্মী তার টাইমলাইনে গিয়ে দেখুন সাম্প্রতিক কোন ঘটনায় তার প্রতিবাদ রয়েছে। যা রয়েছে তা ‘পিক এন্ড চুজ’ টাইপ প্রতিবাদ। আপনি যখন একটা অন্যায়ে নিরব থাকবেন, তখন আরেকটা অন্যায়ের প্রতিবাদে অনমনীয় হওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। নিজের ভেতর থেকেই সেই নৈতিক সমর্থনটা আপনি পাবেন না। অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে আমাদের কিছু সামাজিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীদের নিজের ভেতর এই নৈতিক সমর্থনের শক্ত ভিত গড়ে ওঠেনি।
সঙ্গতই তাদের স্যারদের সিনড্রমে মাথা নিচু করতে হয়, গোপনে আপোস করতে হয়। মুশকিল হলো গোপন কথাটি রবে না গোপনে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন। গোপন না থাকার ফল হলো আমজনতার আস্থা হারানো। আমজনতা নেতৃবৃন্দের উপর আস্থা হারায়। ডাকলে আর তাদের পাশে পাওয়া যায় না। আমজনতাকে তখন অনেকেই দোষারোপ করেন। কী লাভ করে, আমজনতার উপায় নেই বলে তারা চুপ করে থাকে, কিন্তু তারা সবই বোঝে। বোঝে কারা তাদের মাথা গুনে-গুনে বেচে। কার মার বড় গলা এবং সে কোন পর্যায়ের চোর বা চোরের মা তাও তারা বোঝে।
লেখা লম্বা হচ্ছে। শেষ কথা হলো, দক্ষিণ এশিয়ার ‘স্যার সিনড্রম’ এর ভূত সহজে তাড়ানো যাবে না। যতদিন না আমাদের সামাজিক নেতৃবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবী সমাজের নৈতিক ভিতটা শক্ত না হয়। শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।
একটা ভূত বিষয়ক গল্প দিয়েই শেষ করি। তিন বন্ধুর বাড়ি ফিরতে গভীর রাত হয়ে গেছে। ফিরতে হলে পুরানো কবরস্থানের মধ্যে দিয়ে ফিরতে হবে। তিন বন্ধুর মধ্যে একজন মুসলিম, একজন হিন্দু, অপরজন নাস্তিক। রাতে কবরস্থানের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। মানুষ তো মাতৃজঠর থেকেই ভয়টা সাথে করে নিয়ে এসেছে। আস্তিক আর নাস্তিক যাই হোক না কেন, ভয়টা মানুষের স্বভাবজাত। সুতরাং কবরস্থানের ভেতর দিয়ে যাবার সময় তিনজনই ভয় পাচ্ছে। মুসলিম যে বন্ধু আল্লাহ ভরসা করে সুরা ইয়াসিন পড়তে পড়তে কোনমতে কবরস্থান পাড়ি দিলো। হিন্দু বন্ধুও গায়ত্রী মন্ত্র জপতে জপতে পার হয়ে হয়ে গেলো। তাদের ভরসা ছিলো সুরা আর মন্ত্রের উপর, ফলে নৈতিক জোরটাও ছিলো।
মুশকিল হলো নাস্তিক বন্ধুর। সে মনে করে আল্লাহ, ভগবান, ভূত-প্রেত কিছু নেই। কিন্তু ওই যে স্বভাবজাত ভয় সেটা তাকে তাড়া করছে, অন্য বন্ধুদের নয় ভরসা করার একটা কিছু ছিলো, তার তো তাও নেই। উপায় কী, উপায়ের মধ্যে হলো, সেই বন্ধুর রাতে বাড়ি ফেরা হলো না। বিপদ পাড়ি দিতে নৈতিক জোরটা দরকার, লাগে।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক। kakanreza@gmail.com