লুৎফুল কবির রনি: কবি হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের রাড়িখাল গ্রামে। তিনি বড় হয়েছেন রাড়িখালের প্রকৃতির সান্নিধ্যে। জীবনে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যখন সত্যকে বাস্তবতার আয়নায় উপলব্ধি করতে শিখেছেন-ঠিক তখন থেকেই তিনি বর্জন করেছিলেন এই তথাকথিত সমাজব্যবস্থার সব আঁধার।
হাজার বছর ধরে ব্যাপকভাবে মহামারী আকারে প্রচলিত চিরাচরিত সব প্রথা ও বিশ্বাসের ভিত্তিকে তিনি গ্রহণ করেননি। জীবন, জগৎ ও মানুষকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন স্বাধীনচেতা মানবতাবাদী হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক হয়ে নিজের মধ্যে জন্ম দিয়েছিলেন প্রগতিমুখী মুক্তচিন্তার নিজস্ব দর্শনের।
তিনি অনুধাবন করেছিলেন, তিনি কীভাবে বেঁচে আছেন একটি চরম রাহুগ্রস্ত অন্যদের সময়ে। কী সেই সময়? কারা নিয়েছিল এর দখল? শোনা যাক তার জবানিতে-
‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙুলের দাগ,
আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবাণু,
আমার বিশ্বাসে ছিল অন্যদের ব্যাপক দূষণ।
আমি জন্মেছিলাম আমি বেড়ে উঠেছিলাম
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি পোশাক পরতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি চুল আঁচড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি কথা বলতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো।
তারা আমাকে তাদের মতো করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিল,
তারা আমাকে তাদের মতো করে হাঁটার আদেশ দিয়েছিল,
তারা আমাকে তাদের মতো করে পোশাক পরার নির্দেশ দিয়েছিল,
তারা আমাকে বাধ্য করেছিল তাদের মতো করে চুল আঁচড়াতে,
তারা আমার মুখে গুঁজে দিয়েছিল তাদের দূষিত কথামালা।
’দীর্ঘ এই কবিতাটি তিনি শেষ করেছেন এই বলে-
‘আমার হৃদয় যা নিবেদন করতে চেয়েছিল, তা নিবেদন করতে পারেনি।
তখনো আমার সময় আসেনি।
আমার কর্ণকুহর যে-সুর শুনতে চেয়েছিল, তা শুনতে পায়নি।
তখনো আমার সময় আসেনি।
আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিল, তার ছোঁয়া পায়নি।
তখনো আমার সময় আসেনি।
আমি যে পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাইনি।
তখনো আমার সময় আসেনি। তখনো আমার সময় আসেনি।
আমি বেঁচে ছিলামঅন্যদের সময়ে।
’”রাষ্ট্রের কাছে কবিতার কোনো মূল্য নেই-রাষ্ট্র কোথাও কবির জন্য কোনো পদ রাখে না, কিন্তু দশতলা দালান খুবই মূল্যবান; তবে একটি দশতলা দালানের মালিক হওয়ার চেয়ে অনেক কঠিন ‘অবসরের গান’ লেখা। জীবনানন্দ অবশ্য ওই কবিতাটির বদলে একটি একতলা দালান বানাতে পারলে ট্রামলাইনের পাশে একটু সাবধানে হাঁটতেন। তবে জীবনানন্দ ছাড়া কেউ ওই কবিতাটি লিখতে পারতেন না; দশতলার মালিক অনেকেই হ’তে পারেন, যাঁদের ঠিক যোগাযোগটি আছে, কিন্তু কোনো যোগাযোগের ফলেই ওটি লেখা সম্ভব না।” -হুমায়ুন আজাদ
আদতে নিজেকে ভাবতেন কবি।কবিতামগ্ন মানুষ ছিলেন তিনি। সারা জীবন যা কিছু করেছেন, তার সবার আগে রেখেছেন কবিতা। কবি পরিচয়ের প্রতিই ছিলেন সবচেয়ে দুর্বল। কবিতা সম্পাদনা ও বাছাইয়ের কাজ ছিল প্রিয়। রবীন্দ্রনাথের প্রধান কবিতা বা আধুনিক কবিতার সংকলন তার নমুনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’র সংকলন করে তিনি এক হুলুস্থুল করে গেছেন, যার আলোচনা এখনো বিরাজমান। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আধুনিক বাংলা কবিতার মূল্যায়ন যেন হুমায়ুন আজাদের সংকলনকে আদর্শ ধরে করা—হয় তার পক্ষে নয়তো বিপক্ষে। যাঁদের তিনি তাঁর সংকলনে স্থান দেননি, তাঁদের মধ্যে আল মাহমুদসহ আমার একাধিক পছন্দের কবি রয়েছেন। হুমায়ুন আজাদ তাঁদের আধুনিক হিসেবে অস্বীকারও করছেন, এমন নয়। কিন্তু তিনি তাঁদের নিচ্ছেন না, নিতে পারছেন না। এর কারণ কী?
কারণটি জানার জন্য চোখ রাখা যাক তাঁর নিজের ভাষ্যে, ‘এখানে সক্রিয় অজস্র কবিযশোপ্রার্থীর মধ্যে তাঁদেরই নিয়েছি, যাঁরা কবি; তবে কয়েকজনকে নিই নি, সেটা আমাদের সময়ের শোচনীয় দুর্ভাগ্য—সৈয়দ আলী আহসান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন ও আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা নিই নি, আমি নিতে পারি না, কেননা তাঁরা সামরিক একনায়কত্ব ও মৌলবাদে দীক্ষা গ্রহণ ক’রে মানুষ ও কবিতা ও আধুনিকতার বিপক্ষে চ’লে গেছেন। এ-সংকলনটিকে আমি ভবিষ্যতের জন্যে রেখে যেতে চাই, এক শতক পর আমার মতো কেউ এটি বিচার করবেন।আধুনিক কবি ও কবিতা শনাক্তিতে আমি কতোটা ব্যর্থ হয়েছি।’নিজের বুঝের প্রতি তাঁর এমন আত্মবিশ্বাস আদতে মুগ্ধতা জাগানিয়াই।
আশার কথা আমি বলি না, কেননা আশা করার মতো কিছু দেখতে পাই না; খুব গভীরে ডুব দিয়ে আশার নুড়ি খুঁজি অনেক, মুঠোতে একটি নুড়িও ওঠে না। আশার কথা না বলার একটি দার্শনিক কারণও রয়েছে;- আশাকে আমার বেশ স্থূল ব্যাপার বলে মনে হয়, হতাশাকে মনে হয় গভীর ও সত্য। মানুষের চরম পরিণতি তো হতাশা; যেখানে কবরে বা আগুনে সমাপ্তি সব কিছুর, ধ্বংসই শেষ কথা, সেখানে আশাকে খুবই হাস্যকর মনে হয়। আশা প্রতারণা করে, হতাশা করে না। আমাদের এখানে আশার ফেরিঅয়ালার অভাব নেই, আর সারা পৃথিবীতেই সময় বুঝে আশার ফেরিঅলার বড়োবড়ো দোকান খুলে বসে।
-জলপাই রঙের অন্ধকার- হুমায়ুন আজাদ
“আমাকে অনেকেই বলতো যে, আপনি খুব সাহসী; কিন্তু আমি বলতাম যে, আমি কখনোই সাহসী নই -আমি আঠারো তলা দালান থেকে লাফ দেই না -আমি বন্দুকের গুলির মুখে গিয়ে দাঁড়াইনা – আমি সত্য প্রকাশ করি, যেদেশে সত্য প্রকাশ করাই সাহসের পরিচায়ক সেদেশ যে কী শোচনীয় পর্যায়ে নেমে গেছে সেটা আমাদের বোঝা উচিত।”– আমার নতুন জন্ম (হুমায়ুন আজাদ)
সহকর্মীরা যখন বন্ধুরা যখন ধংসস্তুপের ওপর বসে উপভোগ করছেন তাঁদের অতীত কীর্তি , সিসিফাসের মতো পাথর ঠেলে চলেছেন আমৃত্যু।
সত্যিই ত একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্য ,এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য মরে যেতে প্রস্তুত আপাদমস্তক বাঙালি প্রিয় হুমায়ূন আজাদ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতম মানুষটি কথা ,কাজে ,লেখায় মানুষের আত্মিক বোধ জাগিয়ে গেছেন , যাবেন । আর মানুষের না বলা কথা, সামাজিক অনাচারকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন কি নির্ভীকতায় ।হুমায়ুন আজাদ নেই মানে আমাদের সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন ।
হুমায়ূন আজাদ নেই মানে ভীরু , কাপুরুষ কবি সাহিত্যিকদের দলে দলে দলীয় শ্লোগান দাতার ভূমিকায় । হুমায়ুন আজাদ যখন লিখতে শুরু করেছেন অথবা তার আরও খানিক আগে থেকেও যদি দেখা যায়, দেখা যাবে দেশে চলছে ধর্মের নৈতিকতা আর সেনা-দেশপ্রেমের শাসন। সেটা পাকিস্তান পর্ব থেকে শুরু করে ১৯৯০–এর গণ–আন্দোলনের ভেতর দিয়ে এরশাদের পতন পর্যন্ত এবং এরপরেও পরিবর্তন বিশেষ হয়নি, উর্দির দৃশ্যমানতা কিছুটা হ্রাস পাওয়া ছাড়া। কিন্তু এই যে মানুষের ওপর অত্যাচার চলছে আইয়ুব খান থেকে এরশাদ পর্যন্ত—এ সময়ই তাঁর বেড়ে ওঠা ও বিকাশ। এ সময় ধর্মের নামে পাকিস্তানি শাসন থেকে রাষ্ট্রধর্ম বা একে ব্যবহার করে যে হরেক পদের ‘নখরামি’ হয়েছে, মানুষের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এ জন্যই তিনি ধর্মান্ধতা ও সেনাশাসনের প্রতি বিরক্ত ছিলেন। হয়তো এসব কারণেই তিনি আঁকড়ে ছিলেন ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট থেকে প্রাপ্ত আধুনিকতাকে।হুমায়ুন আজাদ মৃত্যুকে মহিমা দানকারী প্রতিবাদী এক মহাপুরুষ বেচে থাকবেন বর্ণমালায় , বাঙ্গালিত্বে।
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৪-ফাগুনের আগুনঝরা সন্ধ্যারাতে হুমায়ুন আজাদ রক্তাক্ত হয়েছিলেন খেজুর খোরমার স্বপ্নে বিভোরদের চাপাতির কোপে। লাল নীল দীপাবলী’র শহরে ফুলের গন্ধে ঘুম না আসা রাতে আজও তুমি প্রেরণার শুদ্ধ নাম!একজন হুমায়ূন আজাদ জন্মই পূর্ণতা পেয়েছে বাংলা সাহিত্য আর একমাত্র ,আমি আবার ও বলছি বাঙালির শুদ্ধতম নারীবাদীর নাম হুমায়ূন আজাদ।
সরকার বাহাদুর, বাঙলা একাডেমির মহান পা চাটা দালাল আপনাদের ভাগ্য ভাল ফুলার রোডে আর এখন হুমায়ুন আজাদ থাকেন না।
হুমায়ুন আজাদ ছিলেন,আছেন আমাদের সঙ্গে, বেঁচেই ছিলেন, বেহাত-হয়ে-যাওয়া আমাদের স্বপ্নের কোনো ভূখণ্ডের শেষ প্রতিভূ হয়ে। যে-স্বপ্নভূখণ্ডটা আমাদের সৃজনে ও যাপনে ছিল ভিত্তি হবার কথা, আলু-ছোলা-বাখরখানি বেচতে বেচতে বেহাত হয়ে গেছে সেইটা, আমরা এখন হরষে গাই হাওয়াগানা, নাচি হাওয়ার নাচ, হাওয়ায় বাঁচি হাওয়ায় হাঁচি, হাওয়াবাদ্য বাজায়ে হই হাওয়ায় পুরস্কৃত। অথচ হুমায়ুন আজাদতো কখনো চ্যুত হন নাই। হুমায়ুন আজাদ আগুন তো কখনো নেভে নাই। যারা ঝাঁকে মিশে গেছে, হ্যান্ডশেইক করেছে আপসের, তারা দূর থেকে হুমায়ুন আজাদকে দেখেছে এবং বিনতমস্তকে গেয়েছে সুমনের গান : “পুড়ুক আগুনে আমার কান্না-হাসি/তোমাকেই আমি তোমাকেই ভালোবাসি।”
এত বছর পরও হুমায়ুন আজাদের নাম শুনলেই ধর্মান্ধ মৌলবাদীগোষ্ঠীরা ভয়ে কেঁপে ওঠে। মৃত হুমায়ুন আজাদ জীবিত হুমায়ুন আজাদের থেকে অনেক শক্তিশালী।
কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন-
‘মুর্খেরা ভেবেছে তুমি অস্ত্রাঘাতে নিষ্প্রাণ হলেই
নিভে যাবে তোমার সৃষ্টির আলোমালা,
অথচ জানে না ওরা সর্বদা সজীব তুমি, অমর তোমার
প্রোজ্জ্বল রচনাবলি। তোমার শরীর
কোনওকালে মৃত্তিকায় বিলুপ্ত হলেও
যুগ যুগ জ্বলজ্বলে রয়ে যাবে বাংলার দালান,
কুটিরে, নদীর ঢেউয়ে। দেশপ্রেমী প্রতিটি প্রাণের
আসনে হে কবি হুমায়ুন তুমি আজ অধিরাজ’।
দিন এমন হচ্ছে, হুমায়ুন আজাদের নাম নেওয়াও যেন বিপদের। দালাল শিক্ষক, পা চাটা ভিসি, দলীয় লেখকরা সবাই–ই শোচনীয়ভাবে এক সেন্সর-সেলফ সেন্সরের গহ্বরে ঢুকে গেছে। পক্ষান্তরে হুমায়ুন আজাদ সেই জাল ভেদ করতেই সারা জীবন ব্যয় করেছেন। যেমন তিনি বুঝেছেন, সেই পদ্ধতিতে। তাঁর সব সবলতা ও দুর্বলতা নিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন, অনুপ্রাণিত করবেন আমাদের। শুভ জন্মদিন স্যার“ ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।”
লুৎফুল কবির রনিঃ লেখক ও আর্ট ক্রিটিক