লুৎফুল কবির রনি:
“হলিউড এমন একটি স্থান যেখানে হাজার ডলার ব্যায় করা হয় কেবল একটি চুমুর পেছনে অথচ হৃদয়ের জন্য, ভালোবাসার জন্য একটি কড়িও ব্যায় করা হয় না।”
-মেরলিন মনরো
মনরোকে হলিউডের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ নায়িকা বললেও অনেকে আপত্তি করবেন না। ভুবনমোহিনী হাসির মায়াজালে তাঁর সময়কার তরুণদের হৃদয়ে ঝড় তুলেছিলেন তিনি। হয়েছিলেন অনেক তরুণের দীর্ঘশ্বাসের কারণ। তাঁদের সেই দীর্ঘশ্বাস আরও দীর্ঘ হয়েছিল সাফল্যের উত্তুঙ্গ সময়ে এ তারকার জীবনের আলো নিভে যাওয়ায়।
মেরিলিন মনরো যেন রূপকথার গল্পের এক দুখিনি রাজকুমারী। খ্যাতি, যশ, প্রতিপত্তি—সবই তাঁর হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন দুঃখের এক ছবি রাখা ছিল তাঁর জীবনে। সে দুঃখের বোঝা বইতে না পেরেই হয়তো নিজেই নিভিয়ে দিয়েছিলেন নিজের আলো। কে জানত, তাঁর ভুবনজয়ী হাসির আড়ালে লুকিয়ে ছিল অস্ফুট হাজারো কান্নার শব্দ।
১৯২৬ সালে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস জেনারেল হাসপাতালে জন্ম নেয়া দরিদ্র নর্মা জিন এর মেরিলিন মনরো হয়ে ওঠা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। বহুপ্রেম, গোপন অভিসার, নগ্নতা, যৌনতা, বহুবিবাহ, ড্রাগস এবং মর্মান্তিক মৃত্যু কী নেই সেখানে!
তবে আছে মানবিক চেতনার অসাধারণ সব দৃষ্টান্তও।
মানসিক রোগূ মায়ের অবহেলা, অনাথ আশ্রমে জীবনযাপন, অন্যের কাছে বেড়ে ওঠা নর্মা জিন যে জগদ্বিখ্যাত চিত্রতারকা মেরিলিন মনরো হয়ে ওঠবে তা হয়তো কেউই কল্পনা করেনি তখন।
গত শতকের পঞ্চাশের দশক এবং ষাটের দশকের শুরুর দু-বছর সারা বিশ্বের তরুণরা হয়তো একটা বিষয়ে বিভক্ত ছিল না। তা হচ্ছে মেরিলিন মনরোর প্রতি তীব্র আবেদন।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, তার ভাই রবার্ট কেনেডি এবং গায়ক ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা সহ মনরোর সরাসরি প্রেমিক বা শয্যাসঙ্গীর তালিকা লিখে শেষ করা যাবে না। বিখ্যাত নাট্যকার আর্থার মিলার, বেসবল খেলোয়াড় ডিমাগিয়ো, রবার্ট স্ল্যাটজার সহ আরো কয়েকজনকে বিয়ে করেছিলেন তিনি।
তিনি ছিলেন সেইসময়ের সিনেমা-তারকাদের মধ্যে বিস্ময়কর সেক্স-সিম্বল।
ভীষণ কাঠখড় পুড়িয়ে শীর্ষ অবস্থানে এসেছিলেন তিনি। প্রথম দিকে খুবই ছোটখাটো চরিত্র পেতেও নিজের দেহ-বিনিময়ের ঘটনাও ঘটেছে। বিস্ময়কর আরেকটি সত্য হচ্ছে শুরুর দিকে হলিউড পরিচালক বা আমেরিকার সিনেমা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা মনরোর দৈহিক সৌন্দর্যর ঘাটতি নিয়েও হাসিঠাট্টা করতেন।
অথচ একটা সময়ে মনরো হয়ে উঠলেন সারাবিশ্বের সৌন্দর্যের দেবী। হয়ে উঠলেন ব্যবসাসফল সিনেমার নির্ভরশীল অভিনেত্রী। মূলত ১৯৪৬ সালে “টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স” এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মেরিলিন সাফল্যের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখেন।
১৯৫০ সালের আগে মনরো তেমন একটা নজর কাড়তে পারেননি। ১৯৫৩ সালে নায়াগ্রা ছবি দিয়ে স্বপ্নপূরণ হয় তাঁর। এই ছবি তাঁকে রাতারাতি তারকাখ্যাতি এনে দেয়।
এরপর একে একে রিলিজ হয় জেন্টেলম্যান প্রেফার ব্লন্ডস, হাউ টু ম্যারি আ মিলিওনিয়ার, দেয়ার’জ নো বিজনেস লাইক শো বিজনেস, দি সেভেন ইয়ার ইচ ও বাস স্টপ-এর মতো সফল সিনেমা।
‘দি সেভেন ইয়ার ইচ’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৫ সালে। তারই একটি দৃশ্য শুধু বিখ্যাতই হয়নি, কালজয়ী হয়ে গিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। দৃশ্যে দেখা গিয়েছিল, আচমকা সাবওয়ের সামনের একটি ঝাঁঝরি থেকে উঠে এল দমকা হাওয়া, সেই হাওয়ায় অনেকখানি উঠে যাওয়া স্কার্টটি হেসে কোনও মতে দু’হাত দিয়ে সামলে নিচ্ছেন মেরিলিন।
দিনে দিনে নিজেকে তৈরি করেছেন আরো দক্ষ অভিনেত্রী রূপে। বই পড়তেন নিয়মিত। নানান বই। রাজনৈতিক বইও।
মানবিক রাজনীতির প্রতি সমর্থন ছিল। আর্থার মিলারের সাথে প্রেমপর্বের সময়ে সমাজতন্ত্রের প্রতিও তার মুগ্ধতা দেখা যায়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে কেনেডি সম্পর্কে মেরিলিনের আশ্চর্য বিচক্ষণ এবং চিন্তাশীল মন্তব্য পাওয়া যায়। এক সাংবাদিককে কেনেডি সম্পর্কে মনরো বলেছিলেন -” ওই মানুষটি একদিন লিংকনের সমগোত্রীয় হয়ে উঠবে।”
মৃত্যুর আগ পর্যন্তও বিশ্বাস করতেন জন এফ কেনেডি একদিন তাকে বিয়ে করবেন। কখনো কখনো রবার্ট কেনেডিকেও বিয়ে করার কথা কাছের কাউকে কাউকে বলতেন।
অথচ জন এফ কেনেডি এবং তার ভাই রবার্ট কেনেডি মেরিলিন মনরোর দৈহিক সঙ্গ ছাড়া আর কোনো স্বীকৃতির কথা কখনোই ভাবেননি। তারা মেরিলিনের সাথে যৌনতা উপভোগ করে ঠিকই ফিরে গেছেন নিজ নিজ স্ত্রীদের কাছে।
মেরিলিন মনরো পড়ে মনে হয়েছে আমৃত্যু আর্থার মিলারের প্রতিই মনরোর তীব্র ভালবাসা ছিল। অথচ সেই সময়েও মনরো অন্য পুরুষের শয্যাসঙ্গী হয়েছিলেন।
অস্থির ছিলেন। অশান্ত ছিলেন। একটা পর্যায়ে ঘুমের ওষুধ খেতে শুরু করেন। শেষে এলএসডিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। আজকের ইয়াবার পূর্বসূরি ছিল এলএসডি। ৩৬ বছরের জীবনে ৪৮ বার বাসস্থান পরিবর্তন করেছিলেন।
মূলত সারাজীবনই উত্তর অধিকার সূত্রে মা গ্ল্যাডিস পার্ল মনরো থেকে পাওয়া মানসিক রোগ তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। মৃত্যুর দুবছর আগে থেকেই পরিচালকদের শিডিউল ফাঁসিয়ে নানান হয়রানি করতেন। নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক ঘন্টা পরে শুটিং স্পটে হাজির হয়ে প্রযোজকের আর্থিক ক্ষতির কারণ হতেন। একেকটি সিনেমা শেষ করতে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক বেশি লাগতো মনরোর খামখেয়ালী আচরণের কারণে। বদমেজাজি বা একগুঁয়ে আচরণ করতেন সে সময়ে। একজন সহশিল্পী তার চুলের রঙে রঙ করেছিল বলে শুটিং ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন কয়েকদিন। পরে সেই শিল্পী বাধ্য হয়েছিলেন চুলের রঙ পরিবর্তন করতে। অথচ সবাই জানতো মোটেই মনরোর চুলের রঙের মত ছিল না সেই শিল্পীর চুলের রঙ। নেশা তখন সর্বোচ্চ মাত্রায় চলছিল। রূপালি পর্দায় গ্লামার-গার্ল হাসছেন, উচ্ছ্বসিত হচ্ছেন অথচ একা হলেই সবার অলক্ষ্যে কাঁদছেন, বেদনায় ভেঙ্গে পড়ছেন এবং নিঃশব্দে অশ্রু ঝরাচ্ছেন।
বাড়িতে প্রায়ই নগ্ন থাকতেন। নগ্নতা নিয়ে তার যুক্তিও ছিল। সেইসময়ে ভোগ, লাইফ, কসমোপলিটান সহ বিখ্যাত পত্রিকাগুলো তার নগ্ন-ছবি ছাপিয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। সাংবাদিকরা সবসময় ওতপেতে থাকতো মনরোর খোলামেলা ছবি তোলার অভিপ্রায়ে। বিস্ময়কর সত্য হচ্ছে মর্গের রক্ষীকে মদের বোতল ঘুষ দিয়ে দুজন ধূর্ত ফটো-সাংবাদিক মর্গের ভল্ট খুলে সাদা চাদরে ঢাকা মনরোর লাশ অনাবৃত করে ছবি তুলেছিল। যদিও তারা নাকি বিখ্যাত চিত্রনায়িকার মৃতদেহ দেখে মর্মাহত হয়েছিল। আরো বিস্ময়কর হচ্ছে লাশের সেই নগ্ন ছবিও “লাইফ” ম্যাগাজিন ছেপেছিল।
নগ্নতা বিষয়ে মনরো বলেছেন- ” স্রষ্টা প্রাণীদের যে আকার যেভাবে সৃষ্টি করেছেন সেই আকারে ছবি তুলতে কিংবা আঁকতে দিলে অনেক মানুষ নিন্দে করে। কিন্তু সত্যিকারের আর্ট তো যা সত্য যা স্বাভাবিক তারই প্রতিফলন।”
বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করতেন। একজন দরিদ্র ভক্তকে নিজের পুত্রের মর্যাদা দিয়েছিলেন। সারাজীবন তার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। নিজের সব স্বামীদের আগের সংসারের সন্তানদের প্রতি মেরিলিন সবসময় ছিলেন মমত্বময়ী। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনিয়ম অন্যায়ে যথা সম্ভব প্রতিবাদ করতেন।
আর্থার মিলারকে কমিউনিস্ট হিসেবে সনাক্ত করে আমেরিকা যখন শাস্তি দেয়ার জন্য উন্মুখ তখন মনরো তার পাশে ছিলেন। মৃত্যুর আগে যে উইল করেছেন সেখানে ডা. মেরিয়্যানের মাধ্যমে মানসিক রোগ চিকিৎসার জন্য অর্থদান করে গেছেন।
মানবিক অনেক বিষয়েই মনরো সারাজীবন সম্পৃক্ত রেখেছিলেন নিজেকে।
সারাজীবন খুঁজে বেড়িয়েছেন জন্মদাতাকে। কখনো জানতে পারেননি সত্যিকার বাবা কে। এই দুঃখ তার মানসিক অসুস্থতাকে আরো উস্কে দিয়েছিল।
মাতৃত্বের অপ্রাপ্তিও জীবনের শেষের দিকে তীব্র বেদনা দিয়েছিল তাকে। মা হওয়ার জন্য খুবই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
আর্থার মিলারের ঔরসে বারবার ভ্রূণ নষ্ট হওয়া মনরোকে দারুণভাবে বেদনা দিয়েছিল। মূলত কিশোরী বয়সে একবার সহ বারবার গর্ভপাত তার শারিরীক নানান ত্রুটি তৈরী করেছিল।
এভাবেই নানান অনিয়ম আর হতাশায় মনরো নেশায় ডুবে গিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের আগস্ট মাসের পঞ্চম দিন, মেরিলিন মনরোকে লস অ্যাঞ্জেলেসের ব্র্যান্টউডের বিলাসবহুল বাড়িতে একাকী মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবনে মৃত্যু হয় এই রূপকুমারীর। সেই পাগল করা দিনের ভক্তকুলের অনেকে জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসেও দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন মনরোর জন্য। এখনো প্রশ্ন উঠে, কেন আত্মহত্যা করবেন মনরো! তিনি তো খ্যাতির শীর্ষে ছিলেন তখন। আবার তাঁকে হত্যাই বা করবে কে? কীসের শত্রুতা তাঁর সঙ্গে? সবই রহস্যাবৃত।
তার মৃত্যু নিয়েও ছড়িয়ে পড়েছিল নানান কাহিনি। হত্যা না আত্মহত্যা না অতিরিক্ত নেশা সহ নানান রহস্যঘন গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল। উচ্চারিত হয়েছে রবার্ট কেনেডির নামও। যেহেতু তিনি মনরোকে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গোপন বিষয় জানাতেন তাই অভিযোগ উঠেছিল সেকারণেই হয়তো নায়িকা তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। তবে এসবের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত আমেরিকান চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, সংগীত শিল্পী ও মডেল মেরিলিন মনরো মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ক্যালিফোর্নিয়ায় তার নিজ রুমে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়, অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন। এখানেই ইতি ঘটে বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত এই চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, সংগীত শিল্পী ও মডেল মেরিলিন মনরো অধ্যায়ের।
মৃত্যুর সময় মনরো প্রায় ১.৬ মিলিয়ন ডলার রেখে যান। আর রেখে যান লাখ লাখ অন্ধ ভক্ত। মেরিলিন মনরোকে মানুয কত ভালোবাসত তা বলে বুঝানোর কিছু নেই। মনরোর মৃত্যুর পর শুধু আমেরিকাতেই আত্মহত্যার হার ১২% বেড়ে গিয়েছিল। আর রেখে যান লাখ লাখ অন্ধ ভক্ত।
মৃত্যুর ৫২ বছর পরেও মনরোকে নিয়ে হইচই থামেনি।
আজও পৃথিবীর মানুষের কাছে বিষন্ন-সুন্দরী মেরিলিন মনরোর আবেদন রয়ে গেছে। এখনো তার মুভি তার জীবন মানুষের তীব্র আগ্রহের বিষয়।
তার মৃত্যুর সাতান্ন বছর পর আজ আমিও বিস্মিত তার জীবন পাঠে। এভাবেই হয়ত মনরো-বিস্ময় চলতে থাকবে যুগের পর যুগ।
মেরিলিন মনরো জীবন থেকে শিখেছিলেন- রূপবতী মেয়েদের বন্ধু থাকেনা, থাকে একদল চাটুকার।
শুভ জন্মদিন দু:খিনী রাজকন্যা, ভালোবাসায় স্মরণ করছি।
১ জুন, ২০২২
লুৎফুল কবির রনিঃ লেখক, আর্ট ক্রিটিক