মাসকাওয়াথ আহসান
ওপেনহাইমার দেখে এলাম। খ্রিস্টোফার নোলান নিজেকে অতিক্রম করেছেন নির্দেশক হিসেবে। রাজনীতিবিদদের পাল্লায় পড়ে বুদ্ধিজীবী তার মেধা সরকারি প্রকল্পে নিয়োগ করলে; বুদ্ধিজীবীকে যে অনুশোচনা ও ভিলেজ পলিটিক্সের বেদনায় পুড়তে হয়; তা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই মুভির কাহিনী বিন্যাস।
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কোন সরকারি চক্করে না পড়ে “নির্দলীয়” সুশীল হিসেবে যে নির্মল জীবন যাপন করেছেন; তা তুলে ধরা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। আইনস্টাইন ওপেনহাইমারকে সাবধান করেছিলেন; পারমানবিক বোমা তৈরির নেতিবাচক ফলাফলের ব্যাপারে। কিন্তু উচ্চাভিলাষ আর নতুন কিছু করার তাড়না থেকে ওপেনহাইমার সভ্যতা বিনাশী কর্মযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
হলিউডের ছবি এর ইতিহাস নির্ভর গল্পে এমেরিকার রাজনৈতিক নেতাদের খলতাকে নির্ভুলভাবে চিত্রায়িত করার স্বাধীনতা উপভোগ করে। গণতন্ত্র ও সভ্যতার সৌন্দর্য্য এখানে। শিল্পের ও সৃজনশীলতার স্বাধীন বিকাশের পথে কখনো বাধা হয় না রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান।
এই চলচ্চিত্রের প্রতিটি দৃশ্য প্রতিটি সংলাপ দর্শকের গভীর মনোযোগ দাবী করে। ওপেনহাইমারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী রাজনীতিক লুইস স্ট্রাস ও বিজ্ঞানী সহকর্মীর মুখাবয়বের খলতার চিহ্ন; হলিউডের কাস্টিং-এর মুন্সীয়ানা ফুটিয়ে তুলেছে। ইঁদুর থেকে হোয়াইট টাইগার হয়ে ওঠার স্পষ্ট ছাপ ঐ দুই ষড়যন্ত্রী চরিত্রের মাঝে নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। ওপেন হাইমারের চিন্তাজগতে ঐ দুটি চরিত্র কোন গুরুত্ববহন না করলেও অযাচিতভাবে তারা ঈর্ষান্বিত হয়ে হাইমারকে ফাঁসিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে।
তাদের অভিযোগটাও ক্লিশে, ওপেনহাইমার আমেরিকার প্রতি অনুগত নন, সোভিয়েত ইউনিয়নের “এজেন্ট”। বুদ্ধিজীবী ও স্বাধীনচেতা মানুষের বিরুদ্ধে ঊনমানুষদের পট করে তোলা এই “যন্ত্র ঐ একটাই ষড়যন্ত্রে”র ভাঙ্গা রেকর্ড; অনুন্নত দেশগুলোর সাবহিউম্যান পলিটিশিয়ানরা আজো বাজিয়ে চলেছে। যথারীতি ওপেনহাইমারের “বেড রুমের কাসুন্দি” নিয়েও হাজির হয় কলতলার “গান্ধা কইরা দিমু” গোত্রের লোকগুলো। হিংসুটে স্ট্রাস তার দুই ইঞ্চির চিন্তার গজফিতায় মিথ্যা গুজব আর ফালতু অভিযোগ তুলে হাইমারের মতো বড় বিজ্ঞানীর ক্রেডিবিলিটি নষ্ট করার চেষ্টা করে। যথারীতি ব্যর্থ হয়; নিজেই হোয়াইট টাইগার থেকে ইঁদুরে রুপান্তরিত হয়।
ওপেনহাইমারের বাম রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ; প্রেমের ইতিউতি; টিএস এলিয়টের “ওয়েস্ট ল্যান্ড” গ্রন্থ পাঠ; সংগীতের মাঝে গণিতের সংহতি খুঁজে ফেরা; হিরোশিমা-নাগাসাকির নিধনযজ্ঞের খলনায়ক হিসেবে আত্মদহন; ষড়যন্ত্রমূলক ক্যাঙ্গারু কোর্টে জিজ্ঞাসাবাদের সময় বিজ্ঞানী হয়েও বিতর্কের যে মনোভঙ্গি; তা একজন খলনায়কের প্রতিও দর্শকের খানিকটা সহানুভূতি তৈরি করে।
ওপেনহাইমারের চিন্তাজগতে “ভগবদ্গীতা “র প্রভাব সম্পর্কে আরো কিছুটা পাঠের আগ্রহ তৈরি করেছে এই চলচ্চিত্র।
বামপন্থীদের আড্ডায় দেখা হওয়া বান্ধবি জাঁ তাতলকের সঙ্গে সেটল করতে পারলে কী ওপেনহাইমারের জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো; নাকি যে স্ত্রী কীটি তাকে আশাভঙ্গের দিনগুলোতে সঙ্গ দিলো; সেই জীবনটিই যথার্থ; এরকম একটা চিন্তার দোলাচল তৈরি হয়। জীবন তো আসলে কখনোই নিখুঁত হয় না; বিশেষ করে কোন ভাবালুতাগ্রস্ত বিজ্ঞানীর বা ক্রিয়েটিভ মানুষের জীবন।
তবে “রাজনীতিকে”-র পাল্লায় পড়লে জীবনটা ওপেনহাইমার; তাদের এড়িয়ে সুশীল থাকলে জীবনটা আইনস্টাইন; এই একটা সলিড শিক্ষা সিনেমা থেকে নিয়ে ফেরা গেছে।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া