কাকন রেজাঃ পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মার্কিনপন্থী নির্বোধ কিছু অ্যাকটিভিস্ট ছাড়া রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন খুব বেশি যুদ্ধবিরোধী মনোভাব গড়ে তুলতে পারেনি।’ না, এটা আমার কথা নয়। ১৫ মার্চ দৈনিক প্রথম আলো’র মতামত কলামের একটি লিখা। যিনি লিখেছেন তার পরিচিতি হিসেবে বলা হয়েছে তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
প্রথম আলো এ লিখাটি প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। কারণ, কাগজটি সবধরণের লেখাকেই জায়গা করে দিচ্ছে। এটাই হওয়া উচিত। তবে ছোট্ট একটা কিন্তু রয়ে যায়। ফিকশন, ম্যাজিক রিয়েলিজম, হাইপোথিসিস নির্ভর লেখা, এক কথায় মনগড়া লেখার বিষয়টাকে মাথায় রাখা উচিত। ব্যক্তিগত ব্লগ হলে অবশ্য কথা ছিলো না। একজন মানুষ তার মত চিন্তা প্রচার করতেই পারেন, তবে তা যদি প্রচারণার জায়গায় পৌঁছায় তবেই মুশকিল। কলাম কোনো ফিকশন নয়, ননফিকশন, নির্জলা; এখানেই সাহিত্য আর সাংবাদিকতার পার্থক্যটা সুস্পষ্ট এবং বিশ্লেষণেরও।
রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের ব্যাপারে আসি। এক্ষেত্রে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা চিন, তুরস্ক আর ইরান। যে রামজ্ঞানী ভদ্রলোক অন্যদের নির্বোধ বললেন, তার এটা অজানা থাকার কথা নয়, বিশ্লেষক বলে কথা, তাও আবার আলু-পটল বিষয়ক নয়, রাজনৈতিক বিশ্লেষক। এটাও তার জানার কথা তুরস্কের কর্তৃত্ববাদী শাসক এরদোয়ানও রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরোধীতা করেছেন। জার্মান চ্যান্সেলরের সাথে আলোচনায় এরদোয়ানের মূল সুরটা ছিল রাশিয়ার বিরোধিতার। সেজন্য তিনি চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস’র প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো তুরস্ক ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে।
ইরানের প্রশ্নে বলি। এটাও ১৫ মার্চের খবর। রাশিয়ার সাথে আলোচনার জন্য মস্কোর যাবার প্রাক্কালে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান বলেছেন, ইরান ইউক্রেন যুদ্ধের বিপক্ষে। চিনও কৌশলগত কারণে রাশিয়ার এই আগ্রাসনকে সরাসরি সমর্থন করেনি। তবে মিয়ানমারের সামরিকজান্তা রাশিয়াকে সরাসরি সমর্থন করেছেন। সম্ভবত রাজনৈতিক বিশ্লেষক সে রামজ্ঞানী ভদ্রলোকের চিন্তা ওই লেভেলেরই। রতনে রতন চিনে বলে কথা।
সারাবিশ্বের যতগুলো সভ্য রাষ্ট্র আছে। যাদের নাগরিকদের কথা বলার অধিকার আছে। যেসব রাষ্ট্র নিজ দেশের মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করেছে বা করার চেষ্টা করছে, এ ধরণের সকল দেশই ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। অবরোধ দিয়েছে এবং সে অবরোধের পরিসর ও গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। রামজ্ঞানী বিশ্লেষক ভদ্রলোক বলেছেন, যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ নাকি তেমন হয়নি। অন্য জায়গার কথা বাদ দিলাম, খোদ রাশিয়াতেই যুদ্ধ বিরোধী বিক্ষোভের কারণে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অবশ্য ফ্যাসিজমের বরপুত্র পুতিনের দেশে এমনিতেই কথা বলার অপরাধে মানুষকে জেলে পোরা হয়।
রামজ্ঞানী ভদ্রলোক পশ্চিমা গণমাধ্যমের দোষ দিয়েছেন। তারা নাকি অ্যামেরিকার পক্ষে কথা বলছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের দোষ রয়েছে। রয়েছে তাদের নিজস্ব এজেন্ডা। ইসলাফোবিয়ার প্রচার যার প্রমাণ। কিন্তু তারপরেও পশ্চিমা মিডিয়াতে কথা বলার সুযোগ রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর অভ্যন্তরে কী ঘটছে তা জানার সুযোগ রয়েছে। ট্রাম্প সমর্থকরা হোয়াইট হাউজে হামলা চালিয়েছে তা জানিয়েছে পশ্চিমা মিডিয়াই।
বিপরীতে রাশিয়ার মিডিয়ার অবস্থা কী? যে কাউকে প্রশ্ন করলে জানি তোতলাবেন। ভাষা ও বাক্যের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করবেন। কিন্তু সমন্বয় করা আর হয়ে উঠবে না। উঠার স্পেসটা নেই বলে। যেখানে মত প্রকাশের স্পেস নেই, সেখানে এই প্রশ্নের উত্তরেরও কোনো স্পেস থাকার কথা নয়। জানি না, রাজনৈতিক বিশ্লেষক হতে গেলে একটা পিএইচডি ডিগ্রি খুব বেশি দরকার কিনা। অবশ্য দেশের পিএইচডি নিয়ে যে আলোচনা রয়েছে, তার উপর ভরসা করা কঠিন কাজ। আর বাইরে থেকে যারা পিএইচডি’টা করে আসেন তাদের অনেকের ভগবানও দশচক্রে ভুত হয়ে যায়। সুতরাং পদ এবং পদবি যোগ করতে হলে, যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হয়।
অন্যকে নির্বোধ বলার আগে নিজের বোধ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হয়। বুঝতে হয় সাহিত্য ও সাংবাদিকতার পার্থক্য। মিথ ও রিয়েলিটির বৈপরীত্য। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন পুরো মুসলমান ধর্মজাতিটাকেই আলাদা পরিচয় এনে দিয়েছিলো। সশস্ত্র হতে হয়েছিলো তাদের। এ কথাটা অনেকেই ভুলে যান। সোভিয়েতের চরিত্রটাই ছিলো কর্তৃত্ববাদীতার। আর কর্তৃত্ববাদী শাসন কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। স্তালিনের ভূপাতিত মূর্তি অন্তত তাই বলে। সাদ্দাম ও গাদ্দাফির প্রশ্নেও একই কথা। মতবাদ যাই হোক, সেই মতে যদি কর্তৃত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, সেই মাথাটাই একসময় থাকে না। ইতিহাস ও সময় তার সাক্ষি।
কাকন রেজাঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামনিস্ট