মুনির রানাঃ মাঝে মাঝেই বিশ্ব ধ্বংস সংক্রান্ত নানারকম গুজব শোনা যায়। আগে কোথাও এক ছাগলের তিন মাথা- এরকম খবরে দুনিয়া ধ্বংসের গুজব চাউর হতো। ওসব খবর মানুষের সয়ে গেছে। এখন মহাকাশ যুগ। ফলে একই রেখায় চাঁদ সূর্য পৃথিবী ইত্যাদি চলে এসেছে কিংবা পৃথিবীর সাথে কোন গ্রহাণুর বিপদজনক নৈকট্যের আশংকায় বিশ্বধ্বংসের গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
এ ধরণের আশংকাকে মূলধন করে বিস্তর সাহিত্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এ বাবদে পরশুরামের গগন-চটি বাংলাসাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ সংযোজন। কিন্তু বিশ্বধ্বংস আসলে কবে হবে? শিল্পসাহিত্যে এর উত্তর খোঁজা বাতুলতা। হাদিসের বইগুলোতে এর বেশ কিছু লক্ষণ দেয়া থাকলেও কোরআনের আলোকে সেগুলি ধোপে টেকে না। কোরআনের আলোকে কেয়ামতের ধারণাটিকে বিচার করলে দেখা যাবে এ বাবদে আমাদের ধারণায় সম্ভবত আরো কিছু গলদ আছে।
১. কেয়ামত বলতে আমরা অনেকেই সাধারণত যেদিন বিশ্ব ধ্বংস হবে সেদিনটির কথা বুঝে থাকি। কিন্তু কোরআনের কেয়ামত (আরবীতে ক্বিয়ামাহ/ক্বিয়ামাতি) সংক্রান্ত আয়াতগুলি পাঠ করলে মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, কেয়ামত বলতে মূলত পুনর্জন্ম ও শেষ বিচারের দিনকেই বোঝায়। কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক- ২:১১৩ সুতরাং যে বিষয়ে তাহারা মতভেদ করিত কিয়ামতের (আরবী ক্বিয়ামাতি) দিন আল্লাহ উহার মীমাংসা করিবেন।
৩:১৮৫ কিয়ামতের (আরবী ক্বিয়ামাতি) দিন তোমাদেরকে তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় দেওয়া হইবে।
৫:৩৬ যাহারা কুফরি করিয়াছে, কিয়ামতের (আরবী ক্বিয়ামাতি) দিন শাস্তি হইতে মুক্তির জন্য পণস্বরুপ দুনিয়ার যাহা কিছু আছে, যদি তাহাদের সমস্তই থাকে এবং তাহার সঙ্গে সমপরিমাণ আরও থাকে, তবু তাহাদের নিকট হইতে তাহা গৃহিত হইবে না।
১৭:১৩ প্রত্যেক মানুষের কর্ম আমি তাহার গ্রীবালগ্ন করিয়া দিয়াছি এবং কিয়ামতের (আরবী ক্বিয়ামাতি) দিন আমি তাহার জন্য বাহির করিব এক কিতাব, যাহা সে পাইবে উন্মুক্ত।
২১:৪৭ এবং কিয়ামতের (আরবী ক্বিয়ামাতি) দিনে আমি স্থাপন করিব ন্যায় বিচারের মানদন্ড।
২৯:১৩ আর উহারা যে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, কিয়ামতের (আরবী ক্বিয়ামাতি) দিনে অবশ্যই সে সম্পর্কে উহাদেরকে প্রশ্ন করা হইবে।
৩৯:৩১ অতঃপর কিয়ামত (আরবী ক্বিয়ামাতি) দিবসে তোমরা তো পরষ্পর তোমাদের প্রতিপালকের সম্মুখে বাক-বিতন্ডা করিবে।
৪১:৪০ শ্রেষ্ঠ কে? যে ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হইবে সে, না কি যে কিয়ামতের (আরবী ক্বিয়ামাতি) দিনে নিরাপদে থাকিবে সে? পক্ষান্তরে বিশ্ব ধ্বংসের দিনটিকে কোরআনে সেই দিন বা সেই সময় (আরবী সাআ‘তু) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আরবীতে ক্বিয়ামাতি শব্দটি না থাকলেও প্রচলিত ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেকেই আরবী সাআ’তু (সেই দিন বা সময়) এর অনুবাদে কিয়ামত শব্দটিই ব্যবহার করেছেন, যা সঠিক বলে মনে হয় না। কারণ এখানে আরবী সাআ’তু দিয়ে পুনর্জন্ম বা বিচার দিবসের কথা বলা হয়নি, বরং বিশ্ব ধ্বংসের বার্তাই দেয়া হয়েছে।
কয়েকটি উদাহরণ: ৬:৩১(৩১) … এমনকি অকস্মাত্ তাহাদের নিকট যখন কিয়ামত (আরবী সাআ‘তু) উপস্থিত হইবে তখন তাহারা বলিবে হায় ইহাকে আমরা যে অবহেলা করিয়াছি তজ্জন্য আক্ষেপ! ৭:৩৪(৩২)… যখন তাহাদের সময় (আরবী সা’আতু) আসিবে তখন তাহারা মৃত্যুকাল বিলম্ব করিতে পারিবে না, ত্বরাও করিতে পারিবে না। ১২:১০৭(১০৭) তবে কি তাহারা আল্লাহর সর্বগ্রাসী শাস্তি হইতে অথবা তাহাদের অজ্ঞাতসারে কিয়ামতের (আরবী সা’আতু) আকস্মিক উপস্থিতি হইতে নিরাপদ? ২২:১(১) হে মানুষ! ভয় কর তোমাদের প্রতিপালককে; কিয়ামতের (আরবী সা’আতি) প্রকম্পন এক ভয়ংকর ব্যাপার। ৫৪:১(১) কিয়ামত (আরবী সা’আতু) নিকটবর্তী হইয়াছে আর চন্দ্র বিদীর্ণ হইয়াছে।
২. কোরআনে বিশ্ব ধ্বংসের দিনটির নানারকম বর্ণনা আছে। কিন্তু কবে এটি সংঘটিত হবে বা এর আগে কী কী লক্ষন দেখা দেবে সে ব্যাপারে কোনরকম আভাস দেওয়া হয়নি। বরং এটিকে গোপন রাখাই আল্লাহর উদ্দেশ্য। এটি আচমকা এসে পড়বে – এরকমটাই বলা আছে কোরআনে। তারপরও মানুষ এ নিয়ে নানারকম অনুমানে লিপ্ত হয়। হাদিসের বইগুলিতে এ নিয়ে নবীজীর (সাঃ) জবানীতে বিস্তর কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে।
যেমন কেয়ামতের আগে দাজ্জাল আসবে, হারজ (হত্যাকান্ড) বাড়বে, সম্পদের এমন সয়লাব শুরু হবে যে সম্পদের মালিক তার সাদাকা কে গ্রহণ করবে তা নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মানের প্রতিযোগিতা শুরু হবে। সূর্য পশ্চিম দিক দিয়ে উঠবে এবং সকলে তা দেখবে। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বুখারি শরীফ, দশম খন্ড, নং ৬৬৩৬) হিজাযের যমীন থেকে এমন আগুন বের হবে, যা বুসরার উটগুলোর গর্দান আলোকিত করে দেবে।
(৬৬৩৩) কাহতান গোত্র থেকে এমন এক লোক বের হবে যে মানুষকে লাঠি দিয়ে তাড়িয়ে দেবে।
(৬৬৩২) যুলখালাসার পাশে দাওস গোত্রীয় রমণীদের নিতম্ব দোলায়িত হবে। (৬৬৩১) ইত্যাদি ইত্যাদি।
অথচ কোরআনে পরিস্কার করেই বলা আছে, কেয়ামতের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে। কবে কেয়ামত হবে তার ধারণা নবীজীর (সাঃ) এরও নেই। এবং এ নিয়ে গবেষণা করতেও নিরুত্সাহিত করা হয়েছে। ৭:১৮৭(১৮৬) তাহারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে কিয়ামত (আরবী সা’আতু) কখন ঘটিবে? বল, এ বিষয়ের জ্ঞান শুধু আমার প্রতিপালকেরই আছে। শুধু তিনিই উহা যথাসময়ে প্রকাশ করিবেন; উহা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে একটি ভয়ংকর ঘটনা হইবে। আকস্মিকভাবেই উহা তোমাদের উপর আসিবে। তুমি এই বিষয়ে সবিশেষ অবহিত মনে করিয়া তাহারা তোমাকে প্রশ্ন করে। বল, এই বিষয়ের জ্ঞান শুধু আল্লাহর আছে, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না। ২০:১৫(১৫) কিয়ামত (আরবী সা’আতা) অবশ্যম্ভাবী। আমি উহা গোপন রাখিতে চাহি যাহাতে প্রত্যেকেই নিজ কর্ম অনুযায়ী ফল লাভ করিতে পারে।
৩১:৩৪(৩৪) কিয়ামতের (আরবী সা’আতি) জ্ঞান কেবল আল্লাহর নিকট রহিয়াছে।.. ৩৩:৬৩(৬৩) লোকে তোমাকে কিয়ামত (আরবী সা’আতি) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বল, ইহার জ্ঞান কেবল আল্লাহরই আছে। তুমি ইহা কি করিয়া জানিবে? সম্ভবত কিয়ামত (আরবী সা’আতা) শীঘ্রই হইয়া যাইতে পারে। ৪১:৪৭(৪৭) কেয়ামতের (আরবী সা’আতি) জ্ঞান কেবল আল্লাহতেই ন্যস্ত। ৪৩:৮৫(৮৫) কিয়ামতের (আরবী সা’আতি) জ্ঞান কেবল তাহারই নিকট আছে।
৭৯:৪২-৪৪(৪২-৪৪) উহারা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে কিয়ামত (আরবী সা’আতি) সম্পর্কে, উহা কখন ঘটিবে? ইহার আলোচনার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? ইহার পরম জ্ঞান আছে তোমার প্রতিপালকের নিকট। ৪২:১৮(১৭) …জানিয়া রাখ, কিয়ামত (আরবী সা’আতি) সম্পর্কে যাহারা বাক-বিতন্ডা করে তাহারা ঘোর বিভ্রান্তিতে রহিয়াছে। নবী যে ভবিষ্যৎ জানতেন না সে বিষয়ে কোরআনে একাধিকবার বলা হয়েছে। (৪৬:৯, ৭:১৮৮ ইত্যাদি)। এমনকি একটি হাদিসেও ৩১:৩৪ আয়াত উদ্ধৃত করে নবীজীর ভবিষ্যৎ না জানার বিষয়টি হযরত আয়েশা বেশ জোর দিয়েই বলেন, যে লোক বলে যে নবী জানেন আগামীকাল কী ঘটবে, সে লোক মিথ্যাবাদী।(বুখারি শরিফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, অষ্টম খন্ড, ৪৪৯১।)
কোরআনকে আল্লাহ বলেছেন বিস্তারিত গ্রন্থ, (৬:১১৪) দি বেস্ট হাদিস (৩৯:২৩)। সুতরাং কোরআনের এইসব স্পষ্ট আয়াতের বিপরীতে বিভিন্ন সেকেন্ডারি সোর্স তথা হাদিস বা আমাদের নানারকম অনুমানের মূল্য কতটুকু সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। ৪১:৩ এক কিতাব, বিশদভাবে (আরবী ফুসিলাত) বিবৃত হইয়াছে ইহার আয়াতসমূহ, আরবী ভাষায় কুরআন, জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য। ১১:১ আলিম লাম রা। এই কিতাব প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞের নিকট হইতে; ইহার আয়াতসমূহ সুষ্পষ্ট, সুবিন্যস্ত ও পরে বিশদভাবে বিবৃত। ৪৫:৬ এইগুলি আল্লাহর আয়াত, যাহা আমি তোমার নিকট তিলাওয়াত করিতেছি যথাযথভাবে। সুতরাং আল্লাহর এবং তাঁহার আয়াতের পরিবর্তে উহারা আর কোন বাণীতে (আরবী হাদিস) বিশ্বাসী করিবে?
মুনির রানাঃ সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক