মাসকাওয়াথ আহসান
১৯৮৫ সালে এসএসসি পাস করে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হই। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে পাঁচিল টপকালেই কলেজ। ইতিহাসে রাজশাহী কলেজ তৈরিই হয়েছিলো কলেজিয়েটের ছাত্রদের জন্য; ফলে এই কলেজটা আমাদের; এমন একটা দেহভঙ্গি নিয়ে শুরু করলাম কলেজ জীবন। এসএসসি পরীক্ষা দেবার পর নানাবাড়ি আড়ানিতে গিয়ে নানার সঙ্গে দীর্ঘসময় কাটিয়ে এসেছি। নানা বলে দিয়েছেন, এইসব ক্লিশে সমাজের চক্করে পড়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দরকার নাই। ক্রিয়েটিভ কাজ করতে হবে আর্টস এন্ড ক্রাফটস নিয়ে।
রাজশাহী ল্যাবরেটরি স্কুল-সিরোইল স্কুল থেকে সেখানকার ফার্স্ট বয় লাবু ও কর্ণেল এসেছে। লাবু কবি ও আঁকিয়ে। কর্নেল গায়ক; বাঁশী বাজায়। আমাদের তিনজনের কন্ঠে সেই গান, উই ডোন্ট নিড নো এডুকেশান। হেলেনাবাদ স্কুলের ফার্স্ট গার্ল জাবীন একমাত্র সিনসিয়ার স্টুডেন্ট। নিয়মিত ক্লাস করে। ওকে ক্লাস করতে দেখলে গিলটি ফিলিংস আসতো। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম; জাবীনের ক্লাস নোট দেখে; প্র্যাকটিক্যাল খাতা তৈরিতে ওর সাহায্য নিয়ে পার হয়ে যাওয়া যাবে কলেজের পাঁচিল।
রাজশাহী কলেজে আগের ব্যাচের মেডিকেল-ইঞ্জিয়ারিং-এ চান্স পাওয়া সফল বড় ভাইয়েরা ঘুরতে আসেন। সবাই আঙ্গুল তুলে দেখায়, ভালো ছাত্র এমন হয়। আম্মার বান্ধবী রুবি আন্টি বাংলা পড়াতেন। তিনি একদিন ধরে বললেন, ছোট বেলায় কী হেলদি হ্যান্ডসাম বাচ্চা ছিলে; রোদে রোদে ঘুরে একী হাল হয়েছে তোমার!
কলেজে এসে আম্মার বান্ধবীর শাসনে পড়ে যাওয়া মানে বাসাটাই কলেজে এসে পড়া। সুতরাং কলেজে গেরিলা এক্টিভিটজ শুরু করতে হলো। লাবু অত্যন্ত ভদ্র ছেলে ছিলো। কিন্তু কর্ণেল আর আমি ভদ্রতার নিকুচি করে মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত হয়ে পড়লাম।
একমাত্র ইংরেজি ক্লাসে অকুন্ঠ প্রশংসা করতেন শাহনাজ ম্যাডাম; ইংরেজিতে স্পিচ দিইয়ে আমার কনফিডেন্স বাড়িয়ে দিলেন একদিন। জাবীন ক্লাস শেষে বললো, বাহ; বেশ স্পিচ দিলে তো। অন্য ক্লাসেও ভালো করতে পারো; যদি একটু এটেনশান দাও। ক্লাসমেট হয়েও জাবীন কথা বলতো স্টুডেন্ট কাউন্সিলরের ভঙ্গিতে।
আমার খালাত ভাই রনি এসে, উইলিয়াম গোল্ডিং-এর লর্ড অফ দ্য ফ্লায়েজের ইন্টেলেকচুয়াল পেগির মতো উপদেশ দিতো। পাভেল খালা জানলে কিন্তু বিপদ হবে। প্লিজ একটু ক্লাস করো। ভদ্র হয়ে চলো। বুদ্ধি করলাম এই রনিটাকেই দলে ভেড়াতে হবে। আমাদের থিয়েটার দলের প্রধান আকর্ষণ হয়ে পড়লো সে। ছোটন, দোলন, শরিফ আর মনিমুলের অভিনয়ও সাড়া ফেলে দেয় কলেজে। আমি নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখতে শুরু করলাম; চাইকোভস্কি–বেতোফেন-বাখের ইন্সট্রুমেন্ট শুনতে শুনতে; ডিরেকশন দেবার হাতে খড়ি হলো। থিয়েটারের প্রাণপুরুষ কর্ণেল ছিলো অলরাউন্ডার। এর মধ্যে কর্ণেলের বুদ্ধিতে একটা দেয়াল পত্রিকা হলো।ওর হাতের লেখা-আঁকা ছবি সবই সুন্দর।
কলেজ অডিটোরিয়ামের নীচতলায় লাইব্রেরির সামনে দেয়ালিকা টাঙ্গিয়ে দিলে; শিক্ষকদের অনেকে সম্পাদক হিসেবে শুভেচ্ছা জানালেন। লেকচার থিয়েটারের লাল দালানের পাশে ক্লাসের জন্য অপেক্ষারত জাবীন বললো, এরকম গুড ওয়ার্ক নিয়ে থাকলেই পারো।
ঐ সময় আমরা আসলে প্রতিষ্ঠানের পরিয়ে দেয়া গুড বয়ের মেডেলটা প্রত্যাখ্যান করেছি। স্ট্যান্ড করা ছাত্র এই তকমাটা অসহ্য লাগতো। এসব ইঁদুর দৌড় থেকে দূরে; দার্শনিক লিটনের বাসায় বসে ওর গান শুনতে শুনতে আমরা; পুরো কলেজকে উত্যক্ত করার মতো নববর্ষের খেতাব রচনা করলাম। কর্নেল আকর্ষণীয় খেতাব দিতো। রনি ছিলো সেন্সর বোর্ড। আজেবাজে শব্দ বাদ দিয়ে দিতো। এই খেতাব দেয়ার সেশানে কোন ফিমেল ফ্রেন্ডের খেতাবটা সফট করে দেবার প্রস্তাব দিতে মন চাইলেও তা করিনি। কারণ আমাদের গেরিলা আর্ট ওয়ার্কের অনেকেই সন্দেহ করতো আমাকে।
মুখে এন্টি গুড স্টুডেন্ট হলেও ভেতরে গুড স্টুডেন্ট কীনা; কেন সাইকেলে করে বান্ধবির বাসায় যাই; কারণ “আমরা” তো প্রেম বিদ্বেষী; কেবল দ্রোহের মানুষ। আমি জানতাম কালচারাল ট্রুপে নারী অংশ গ্রহণ লাগবে। তাই জাবীন,শায়লা, মিতালী, লাইসা, স্বাতী, ফেরদৌসীর বাসায় যেতাম তাদের মায়েদের আশ্বস্ত করতে; কলেজে খলনায়কের ইমেজ তৈরি হলেও আমরা আসলে কালচারাল এক্টিভিস্ট। নারী বন্ধুদের মায়েরা আমাকে পছন্দ করতেন। এটা আমার জীবনে প্রেম-বিয়ে ইত্যাদিতে অনেক কাজ দিয়েছে জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে। আর ছাত্রজীবনে প্রেম ছিলো কালচারাল এক্টিভিজম, লেখালেখি, থিয়েটার, বিতর্ক। ফলে অন্যদের মতো স্বাভাবিক যে প্রেমের অনুভূতি; তা মনে আসার স্পেস এন্ড টাইম কিছুই পায়নি। আর এন্টি রোমান্টিক আম্মার প্যানপটিক ওয়াচ টাওয়ার সবদিকে চোখ রাখতো। রাজশাহী জুড়ে উনার আত্মীয়-বন্ধু। তাই নারী বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশাটাও ছিলো গেরিলা কায়দায়।
লাবুটা কবিতা আর রোমান্টিসিজমের চক্করে একটু আলাদা হয়ে গেলো। কেবল কালচারাল শোতে সে হেলাল হাফিজের “কষ্ট নেবে কষ্ট” পাঠ করতে আসতো। আর সঙ্গে নিয়ে আসতো ওর আবৃত্তির নারী বন্ধু রিনিকে; জীবনানন্দের হাওয়া রাত পড়তে।
কালচারাল শো, থিয়েটারের মাঝ দিয়ে আমাদের সারকেলটি কলেজে সেলিব্রেটি হয়ে ওঠায়; বাঁদরামি বৃদ্ধি পায়। গানের শিল্পী গালিব হিতোপদেশ দিতো কালচারাল ব্রিগেডটাকে সামলে রাখতে। কিন্তু আমি ফ্রি উইল এজেন্ট; কাউকে ডিসিপ্লিনড করা আমার পছন্দের নয়। ডিসিপ্লিন চাইতাম পারফর্মিং আর্টে।
কিন্তু যে যাই অনাসৃষ্টি করে; অভিযোগ যায় আমার নামে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে। কিন্তু কোন একশান হয়না। প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে শুনানিতে অংশ নিতে গেলে উনি বলেন, তুমি চুনির নাতি; তোমার নানি অসম্ভব সুন্দরী ছিলো; নীল চোখ ছিলো তার; আর চাঁদপানা মুখখানা। রুপপুরে আমাদের প্রতিবেশী ছিলো। চৌধুরী বাড়ির এই অপরুপা মেয়েটির বিয়ে হয়ে সে আড়ানী চলে যায়। আর দেখা হয়নি।
ইন্টেরেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে; জাবীনের নানা বাড়িও আমার নানীর বাপের বাড়ির পাশে। আর কর্নেলের ভাই রেলে কাজ করায়; পাকশীতে থেকেছে ওরা। জাবীন বুঝতে পারেনি কেন, প্রিন্সিপাল স্যার কেন, পাভেলের ব্যাপারে এতো কোমল। এরকম ছয় ফুট হাইটের জাঁদরেল গম্ভীর লোক কেন আমাকে দেখলেই নস্টালজিক হয়ে পড়েন।
শুনানি শেষে প্রিন্সিপ্যালের চেম্বার থেকে বেরিয়ে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় কর্নেল বললো, দ্যাখ বজ্রকঠোর মানুষ তার তারুণ্যের ভালোলাগার স্মৃতির কারণে কেমন কোমল হয়ে যান। আমি জানি কর্নেলের তখন মোহন বাঁশী বাজাতে ইচ্ছা করছিলো।
আমি নানা বাড়িতে গিয়ে নানীকে বললাম, প্রিন্সিপাল স্যারের কথা। নানীর কোন বিচলন নেই। শুধু বললেন, ভালো ছাত্র ছিলো। ভালো তো তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে উনার।
আমি ভাবলাম এই দক্ষিণ এশিয়ার পুরুষেরা কতো রোমান্টিক; যুগে যুগে তারা কবিতায় গানে নীরবতায় স্মৃতিমেদুরতায় কতো প্লেটোনিক প্রেমের ছবি এঁকেছেন। অথচ রক্ষণশীল পরিবারের রুপবতী মেয়েরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেনি। বিবাহোত্তর প্রেমকেই স্বাভাবিক বলে জেনেছে।
আর নানাও সেইযুগে থিয়েটার করতেন; লংপ্লে রেকর্ডে গান শুনতেন, প্রচুর বই পড়তেন; নানীকে নিয়ে রাজশাহীর অলকা হলে নিয়মিত ছবি দেখতেন; টাকা-পয়সা খোলাম কুচির মতো ওড়াতেন।ফলে নানীর বিবাহোত্তর প্রেম যে আনন্দপ্রদ ছিলো; এটা তাদের সঙ্গে বসে আড্ডার সময় ঢের খেয়াল করেছি। নানীর ছিলো অসম্ভব সেন্স অফ হিউমার। নানার যে কোন আলোচনায়; এমন ফোড়ন কাটতেন যে আমি হাসতে হাসতে নানীর পক্ষ নিয়ে নিতাম তাদের প্রাত্যহিক যুক্তিতর্কে।
মাসকাওয়াথ আহসান, লেখক, সাংবাদিক