মাসকাওয়াথ আহসান
ফেসবুকে অসংখ্যবার নুরু ও হিরো আলমকে ছোট করে কথা বলেছেন আমাদের সমাজের মানুষ। বাংলাদেশের মতো রেসিজম পৃথিবীর আর কোথাও নেই। গোটা পৃথিবী অতীতের রেসিজমের ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ দিনকে দিন আরো রেসিস্ট হচ্ছে।
নুরু ও হিরো আলমকে যারা অবজ্ঞা করেন; ছোট করেন; তাদেরকে চিহ্নিত করে; তাদের শেকড়ের খোঁজ নিয়েছি।বাংলাদেশ ছোট দেশ; আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে যে কোন মানুষের জন্মভিটা-পূর্ব পুরুষ-জীবন চর্যা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
আমি একজন এমন রেসিস্ট খুঁজে পাইনি; যার শেকড় নুরু কিংবা হিরো আলমের চেয়ে শক্ত। বরং নুরু ও হিরো আলমের শেকড় খুঁজলে পারিবারিক সততা ও শিষ্টাচারের দেখা মেলে। নুরু কিংবা হিরো আলমের মা; বাংলাদেশের সেই মা; যে তাঁর সন্তানকে শুধু নিজেরটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট না থেকে মানুষের অধিকার নিয়ে লড়ার শক্তি দিয়েছেন। মা’ই সন্তানের মেধা-যুক্তিশীলতা-শিষ্টাচার-মানবতার প্রধান বিদ্যালয়।
যারা নূর ও হিরো আলম সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করেছেন; তাদের মায়েরাও শ্রদ্ধেয়। তাঁরা সন্তানকে ঘৃণা শেখাননি। তাহলে নুরু কিংবা হিরোর মতো একই অর্থনৈতিক সামাজিক আবহ থেকে আসা তরুণেরা কেন নিজেদের হঠাত সুপিরিয়র ভাবছে!
এই সেন্স অফ সুপিরিয়রিটি কোত্থেকে এলো। এলো এদেশের দুটি লালসালুর মাজার থেকে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুজন প্রয়াত মানুষের মাজার আর ছবি নিয়ে ব্যবসা করার জন্য; তৈরি করেছে খাদেম মণ্ডলি।
আওয়ামী লীগের খাদেমেরা ভারতের কাস্ট সিস্টেম প্রভাবিত। ফলে আওয়ামী লীগ ‘ব্রাহ্মণ’ আর অন্যরা দলিত; এই ধারণা ফেসবুকে প্রচার করেছে খাদেম শিয়াল, কালাজম, ইতিহাসান, বলদা রায়, বহুল রাহা। লীগ ও শিবসেনার ঘৃণা কারখানায় শেখানো হয়েছে রেসিজম।
নূর কোটা সংস্কার আন্দোলন করায় চোখ বুঁজে লীগ ও শিবসেনা কর্মীদের বিসিএস-এ নিয়োগে বাধা পড়ে; ফলে উন্মত্ত একদলীয় বাকশিয়ালেরা নূরকে নিয়ে হেন খারাপ কথা নাই; যা বলেনি।
হিরো আলম বগুড়ায় নির্বাচন করে প্রায় জিতে যাবার উপক্রম হলে; লীগের সংস্কৃতি পুরোহিত জাঢ্য জগদগব ঠোঁট নেড়ে বলেন, রুচির দুর্ভিক্ষের জন্য হিরো আলম দায়ী। ব্যাস লীগের ফেসবুক পিকেটাররা হিরোকে গলাধাক্কা দেয় আওয়ামী রুচির মন্দির থেকে। বগুড়ার নির্বাচনে প্রায় জিতে যাবার উপক্রম হলে; সহমত নির্বাচন কমিশন জিতিয়ে দেয় লীগের জোট সঙ্গী জাসদের প্রার্থীকে। এই অভিযোগ হিরো আলমের। তিনি বলেছেন, ডিসি-পুলিশ সুপারেরা চায় না হিরো আলমের মতো মানুষ এমপি হোক; কারণ এমপিকে স্যার বলতে হয়।
এই ডিসি-পুলিশ সুপারই কী ইউরোপের কোন রাজবংশের রক্ত ধারা কিংবা কোন মুঘল অথবা মৌর্য রাজবংশের নীল রক্ত! তা তারা নয়। হিরো আলমের মতো সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান থেকেই উঠে আসা। হিরোর বাবা-মা আর এইসব অহংকারি ডিসি-পুলিশ সুপারের বাবা-মা’র চেহারা-সুরত কিন্তু একই। কিন্তু ঐ যে ছাগলনাইয়া থেকে সরু একটা টাই বেঁধে পিএটিসি ট্রেনিং দিতে ঢুকলেই মাছের রাজা ইলিশ আর জেলার রাজা ডিসি-পুলিশের এক দম্ভ তৈরি হয়। নিজের দেশের মানুষ; নিজের ভাই-বোনকে প্রজা বলে ভাবতে আনন্দ লাগে। বাপের বয়েসী লোকের মুখে স্যার ডাক শুনে মর্ষকাম ভাব জাগে।
এবার হিরো আলম যখন ঢাকা-১৭ উপনিবার্চনে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয়ের এমেরিকা প্রবাস জীবনের বন্ধু আরাফাতের মুখোমুখি হলো; ফেসবুকে তখন আওয়ামী লীগের পিকেটারেরা মাথায় করে মল ভাণ্ড এনে হিরো আলমের নামের পাশে ঢেলে দিতে শুরু করলো। কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং কলেজের গ্র্যাজুয়েট; যার বানান বাক্য ভুল; পেটে বোমা মারলেও শিক্ষার ছিটেফোটাও নেই; তারা এসে হিরো আলম অশিক্ষিত আর আরাফাত বিরাট শিক্ষিত বলে শ্লোগান দিতে শুরু করলো।
কয়েকটা সার্টিফিকেটের যে শার্ট প্যান্ট কোট পরা অহংকার এদেশে দেখি; তা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে নেই। এই দেশে লালন শাহ, হাসন রাজা, আরজ আলী মাতুব্বর, পলান সরকার, মহেশ্বরচান্দার স্বশিক্ষিত কৃষক কিংবা হিরো আলম; বাঙালি মনীষার এমন উজ্জ্বল উদাহরণ এদেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পেরেছে!
এদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুষ-দুর্নীতি-লুন্ঠন-ক্রসফায়ার-গুম-হত্যা-ধর্ষণ কলাকৌশল শেখায়; অনুতাপহীন দেশের শত্রু তৈরির কারখানা এইসব প্রাচ্যের ফক্সফোর্ড।
মাই হিরো প্রবাসী শ্রমিক, কৃষক শ্রমিক, সেলাই শ্রমিক, গৃহকর্মী, ছোট খাট মানুষের ঈশ্বরেরাই এই দেশের অর্থনৈতিক মিরাকলের প্রাণপুরুষ। এই স্বশিক্ষিত মানুষেরাই দেশের প্রাণ। হিরো আলম তাদের প্রতিনিধি।
আর আরাফাত হচ্ছেন রাজপুত্রের প্রতিনিধি; রাণীমাতার আশীর্বাদধন্য কথিত শিক্ষিত লোক। ঐ যে ব্যাংক মালিক; যাকে নিয়ে কার্টুন এঁকে কার্টুনিস্ট কিশোর কারাগারে গেলো; যার সমালোচনা করে লেখক মুশতাক কারাগারে পুলিশ হেফাজতে প্রাণ হারালো; সেই ব্যাংক মালিকের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক মি আরাফাত। গত ১৪ বছরে দলের ভাগ্য পরিবর্তনের যে মহানব্রত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব পালন করেছেন; আরাফাত সেই ক্ষমতা বসন্তের সৌভাগ্যবান। যিনি বাংলাদেশের মিডিয়ার ইতিহাসে মিডিয়া নৈতিকতা ভেঙ্গে সবচেয়ে উদ্ধত আচরণ করেছেন; টকশো গুলোতে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞ রাজনীতিক-সাংবাদিক-শিক্ষকদের কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেই লীগের জাস্টিফিকেশন গুরু আরাফাত আঙ্গুল উঁচিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে ধমকের সুরে বলেছেন, আপনি জানেন না; আপনি তো বুঝতে পারেননি; আমি বলি। উনি ক্ষমতার আইভরি টাওয়ারে বসে সবাইকে তুচ্ছ করার হাসি হেসেছেন।
আমি ১৯৯৫ সাল থেকে দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় সাংবাদিকতা করার সুবাদে পৃথিবীর কোথাও এমন উদ্ধত টকার দেখিনি। এটা সম্ভব না; পৃথিবীর অন্য কোন দেশের কোন রাজনৈতিক দল এমন দাম্ভিক মুখপাত্র মিডিয়া টকশোতে পাঠিয়ে আত্মঘাতী হয় না। কারণ রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করতে হয় জনগণকে খুশি রেখে।
রাজপুত্র দেশে এসেছেন বন্ধুর নির্বাচনী প্রচারণাকে অনুপ্রাণিত করতে। মি আরাফাত ফেসবুকে যুগল ছবি প্রকাশ করে নির্বাচনী প্রচারণা করেছেন; যার অনুবাদ, আমি রাজপরিবারের খুব কাছের লোক।
মি সজীব ওয়াজেদ জয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী সরকারের কোন দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি প্রকাশে কোন নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারেন না। মি আরাফাতের এই ফেসবুকে “বন্ধু” জয়ের সঙ্গে ছবি প্রকাশ নির্বাচনী আচরণবিধির সুষ্পষ্ট বরখেলাপ। অবশ্য মিডিয়া টকশোতে তিনি মিডিয়া এথিকসের বরখেলাপের কারণেই বীরবক্তা হিসেবে আদৃত। সাত দশকের পুরোনো একটি রাজনৈতিক দল অচল আজ গত চৌদ্দ বছরের ক্ষমতাকালে প্রধান আওয়ামী থিংক ট্যাংক হয়ে ওঠা মি আরাফাতের সুপরামর্শ ছাড়া।
এরকম হেভিওয়েট প্রার্থী; পুরো ক্ষমতা করিডোর যার খালাবাড়ির আবদার ; তার বিরুদ্ধে কীভাবে লড়বেন; এ প্রশ্নের উত্তরে হিরো আলম দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভের টকশোতে বলেছেন, আত্মবিশ্বাস আর স্বপ্ন হারালে তো জীবনে আর কিছু থাকে না। আমি তাই শতভাগ সামর্থ্য দিয়ে জনগণের ভালোবাসা জিততে চেষ্টা করবো; ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনে। আমি বন্ধু ও শত্রু সবার ভালোবাসা জিততে চাই।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া