মাসকাওয়াথ আহসানের যুক্তিতর্ক
প্রবীণ সাংবাদিক রণেশ মৈত্র বসুন্ধরা মিডিয়া সম্মাননা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। মুনিয়ার রহস্যজনক মৃত্যুর পর রণেশ মৈত্রের লেখা একটি অভিমত; আর মুনিয়ার সন্দেহভাজন হত্যাকারীর সঙ্গে একই ফ্রেমে পুরস্কার নেবার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।
রণেশ মৈত্র-র নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এই বসুন্ধরা এওয়ার্ড নেবার ঘটনায়। প্রশ্ন উঠছে, রাষ্ট্রীয় একুশে পদক পেয়েও কী তিনি সন্তুষ্ট নন।
রণেশ মৈত্র সারাজীবন পাবনায় বসবাস করে সাংবাদিকতা করেছেন। অন্যান্য দেশে রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকদের যথেষ্ট গুরুত্ব থাকলেও; বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র একটি দেশে কেন্দ্র ও প্রান্তের বিভাজন খুব প্রকট। এই একটা দেশ; যেখানে ঢাকার দশ ফুট বাই দশ ফুটে বসবাসকারী নিম্ন মধ্যবিত্ত কাকরোলও; রাজধানীর বাসিন্দা হিসেবে অতীব গর্বিত। ঢাকার বাইরে প্রাসাদে বা প্রশস্ত গৃহায়তনে বসয়াসকারী উচ্চ মধ্যবিত্তকেও ঢাকার কাকরোল মফস্বলের ভুত বলে; ভীষণ গর্ব অনুভব করতে পারে।
অথচ পৃথিবীর কেন্দ্র ইউরোপে গিয়ে দেখেছি; বৃটিশ রাজবংশের লোকও বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র দেশের প্রতিনিধি হিসেবে কখনো অবজ্ঞা করেনি। মানসিক বিবর্তনে এগিয়ে গেলে মানুষের আর এসব সংকীর্ণতা থাকে না।
বাংলাদেশের ঢাকায় বিরাট হয়ে ওঠা সাংবাদিকদের ভীড়ে সুদূর পাবনায় বসে রণেশ মৈত্র সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবে এতোদূর অগ্রসর হয়েছেন; এটাই তো অস্টমাশ্চর্য।
২০০০ সালে সেসময়ের তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ আমাকে তার সাথিয়া এলাকায় নিয়ে যান একাত্তরের বধ্যভূমি দেখাতে। সিভিল সার্ভিসে থাকলেও যেহেতু আমি লেখক, তাই উনি আমাকে বলেছিলেন, একাত্তরের শোকের গল্পগুলো ব্যথিত স্বজনদের মুখে শুনে রাখো। পরে লিখতে পারবে। এই বধ্যভূমি খননের আদ্যপান্ত জানাতে পাবনা প্রেসক্লাবে একটি প্রেস কনফারেন্স আয়োজিত হয়। সেখানে রণেশ মৈত্রের সঙ্গে দেখা হয়।
পাবনায় বসে মৈত্র পরিবারের এই মানুষটি সারাজীবন তাঁর সাংবাদিকতার প্যাশন ধরে রাখলেন কী করে; এ ছিলো আমার কাছে এক বিস্ময়। কারণ আমি তখন ঢাকায় মিডিয়ায় কাজ করে সন্তুষ্ট নই; ইউরোপে একটা জাম্প দেবার কথা ভাবছি। গ্রাসহপার এন্ড এন্ট গল্পের ঘাসফড়িং হিসেবে সাধক এন্ট দেখলে শ্রদ্ধায় অবনত হই আমি। আনন্দভূক অধ্যবসায়ী রণেশ মৈত্র, কবি ওমর আলী, হাসান আজিজুল হক; আমার স্বপ্নের মানুষ। যে জীবন আসলে আমি যাপন করতে চেয়েছিলাম।
রণেশ মৈত্র’র সঙ্গে তথ্য মন্ত্রীর সম্পর্ক ছিলো পারস্পরিক শ্রদ্ধার। বঙ্গবন্ধু যাদের রাজনীতিতে এনেছিলেন, তাঁদের পণ্ডিতদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকাটাই স্বাভাবিক।
রণেশ মৈত্র সম্পন্ন পরিবারের মানুষ। যেসব ঘরের মানুষের সাংবাদিকতা, লেখালেখি, সংগীত চর্চা কিংবা সাম্যবাদী রাজনীতি করার রোমান্টিসিজম থাকে।
রণেশ মৈত্র-র লেখা কলামগুলো পড়লে টের পাবেন; উনি জোর করে কোন অভিমত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন না। একটা নির্মোহ বয়ান থাকে সেখানে। তিনি হালের চেতনার হাল ধরা ডায়ামন্ড আংকেলদের একজন নন। এই চেতনাটা তৈরি হয়েছে তাদের তারুণ্যে বাঙালি মননের অস্থিধারণ করে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, জনকন্ঠস্বর তুলে ধরলেও; প্রজ্ঞাবান মানুষদের নিয়ে আধাশিক্ষিতদের গালাগাল-আখড়াই-এর একটা জায়গা এটা।
লক্ষ্য করুন, বসুন্ধরা মিডিয়া এওয়ার্ড যিনি দিলেন, সেই তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, কিংবা এই পুরস্কারের জুরিদের নিয়ে খুব অল্প আলাপ হয়েছে। যারা মুনিয়া হত্যার পর মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন, তাদের নিয়ে সামান্য কথা হয়েছে।
অথচ যে মানুষটি কলামিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; তিনি এই পুরস্কার নেয়াতেই ঘাট হয়েছে। সরকারের তথ্য মন্ত্রী কোন পুরস্কার বিতরণ করা মানে এর একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়া। অপরাধী চক্রের আয়োজিত পুরস্কারকে সরকারি প্রাতিষ্ঠানিকতার মালা পরানোর দায় মন্ত্রীর।
বাংলাদেশে যে কোন আয়োজনে সৎ মানুষ একজন দুজনকে পুরস্কার দিয়ে একে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করা হয়। চাঁদাপথের যুদ্ধের অপরাধীরা মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননার নামে এই বাটপারিটা অনেকদিন ধরে করে আসছেন।
ঢাকার বাইরে প্রায় “সংস অফ ইনোসেন্সে”-র জগতের বাসিন্দা প্রবীণদের সঙ্গে বাটপারি ও ধাপ্পাবাজি করাটা খুব সহজ। কারণ ঢাকার মিডিয়া জগতটা যে অপরাধ আর তেলাঞ্জলির আখড়া; সেটা ফেসবুকে নেই এমন কোন সত্তরোর্ধ মুক্তিযোদ্ধা- কবি-লেখক-সাংবাদিক কিংবা নাগরিকের পক্ষে জানা ও বোঝা প্রায় অসম্ভব।
আমি তো বলবো এই পুরস্কার বিতরণ সভায় শঠতা করে; ঢাকার খ্যাতনামা সিনিয়র সাংবাদিকদের দিয়ে ডাকিয়ে রণেশ মৈত্রের ক্রেডিবিলিটিকে স্লটার কর হয়েছে। পচা ডিমের ঝুড়িতে একটি ভালো ডিম রাখা হয়েছে।
রণেশ মৈত্রকে তাঁর কলাম পাঠাতে হয় জাতীয় দৈনিকে। প্রথম আলো তার চোখে তারকা না হলে লেখা ছাপায় না। তখন কালের কন্ঠ, দেশ রুপান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ভোরের কাগজ, জনকন্ঠ রণেশ মৈত্রের লেখা ছাপলে; তিনি প্রাসঙ্গিক থাকতে পারেন।
রণেশ মৈত্র তো এ যুগের মানুষ নন যে, এইসব গজদন্তের মিনারকে কলা দেখিয়ে নিজেই অনলাইনে লিখে লেখার আকাংক্ষা পূরণ করবেন। আমাদের কালে কাউকে পাত্তা না দিয়ে সত্য সুন্দর মঙ্গলের সাধনা করা সম্ভব। কিন্তু রণেশ মৈত্রদের যুগে পচে যাওয়া প্রতিষ্ঠানের মিডিয়াতেই লেখালেখি করতে হয়। যেখানেই ছাপা হোক, শেষ পর্যন্ত রণেশ মৈত্রের লেখাতে সত্য সুন্দর ও মঙ্গলের আবাহন থাকে।