মোহাম্মাদ মনিরুল হাসান ও ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার
একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে নগরায়ন কোন নতুন বিষয় নয় । নগরায়ন কোন একটি দেশ বা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই । ধারনা করা হয় ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ বিভিন্ন বড় নগর বা শহরে বাস করবে । দ্রুত নগরায়নের ফলে সৃষ্ট নব্য নগর জীবন ব্যবস্থা এবং বৈচিত্র্য শুধু নতুন ধরনের সমাজ-সাংস্কৃতিক নিয়ম নীতি তৈরি করে না বরং তা সামগ্রিক পরিবেশ বিশেষ করে স্বাস্থ্যগত পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে । ফলে আবাসিক বর্জ্য, কল-কারখানার বর্জ্য, শিল্প-কারখানা এবং যানবাহনে ব্যবহূত জ্বালানির ধোঁয়াসহ নানা ধরনের আবর্জনার ব্যাপকতা পরিবেশকেও সমহারে প্রভাবিত করছে। পরিবেশগত এ দূষণের জন্য নগরবাসীর বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে ।
দ্রুত নগরায়নের ফলে নগরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায় তার মধ্যে যক্ষ্মা অন্যতম । ২০১৫-২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৪৭ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে অসংক্রামক রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত । যেখানে ২০১০ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল সংক্রামক রোগ । অধিক মাত্রায় অ্যালকোহল এবং ধূমপান, শারীরিক পরিশ্রমের মাত্রা হ্রাস এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণের ফলে সংক্রামক এবং অসংক্রামক রোগের মাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে । ২০১৫ সালের গ্লোবাল হেলথ রিপোর্ট অনুযায়ী, যক্ষ্মা (টিবি) হলো বিশ্বব্যাপী অসুস্থতা এবং মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর একটি । গবেষণার তথ্য অনুযায়ী , ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী ১০.৪ মিলিয়ন মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছে এবং এই রোগে ১.৮ মিলিয়ন লোক মারা গেছে বলে জানা গেছে । অপর এক গবেষণায় দেখা যায় ২০২২ সালে প্রায় ৪০ মিলিয়ন মানুষ যক্ষ্মা (টিবি) দ্বারা সংক্রামিত হয়েছে যার মধ্যে ৩.৫ মিলিয়ন শিশু।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের নগরবাসীদের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ এখনো অস্থায়ী প্রকৃতির বস্তিতে বসবাস করে । বাংলাদেশে অবস্থিত বস্তি ঘরগুলোর ৬৯ শতাংশই দুর্বল অবকাঠামোবিশিষ্ট , ৯৫ শতাংশ ঘরই ১৫০ বর্গফুটেরও কম যেখানে পরিবারের সব সদস্য মিলে গাদাগাদি করে বাস করে । এই ঘনবসতি, যক্ষ্মা (টিবি) রোগের অন্যতম কারন হিসাবে বিবেচনা করা হয় । শ্লেষ্মা পরিক্ষার মধ্যমে বাংলাদেশের হিজড়া সম্প্রদায়কে নিয়ে করা অন্য এক গবেষণায় দেখা যায় নগরে বসবাসকারি অধিকাংশ হিজড়া যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত । ফুসফুসে যক্ষ্মা হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি হওয়ায় সবার ধারণা যে যক্ষ্মা মানেই ফুসফুসের রোগ। কিন্তু বিশেষজ্ঞগণ বলেন, আসলে তা না। আমাদের এমন কোন অঙ্গ নাই, যেখানে যক্ষ্মা হয়না। কারণ যক্ষ্মা হচ্ছে একটি বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক ব্যাধি যেটা মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকুলোসিস জীবাণুর সংক্রমণে হয়ে থাকে।
যক্ষ্মা রোগ নির্মূলের জন্য বাংলাদেশ ২০৩৫ সালের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করেছে । পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে 95% যক্ষ্মা মৃত্যুর হার হ্রাস করা । এই লক্ষমাত্রায় পৌঁছানোর জন্য স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা হ্রাস করার জন্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে টিবি রোগে মৃত্যু শূন্য কোটায় নিয়ে আসার জন্য ২০১৫ সালে ‘টিবি নির্মূল কৌশলপত্র’ প্রণয়ন করেছিল । ‘টিবি নির্মূল কৌশলপত্রে’ বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব বাড়ানোর জন্য তিনটি কৌশলগত স্তম্ভ নির্ধারণ করা হয়েছে – ১। কেন্দ্রিয়ভাবে রোগীর যত্ন ২। সাহসী নীতি এবং সহায়ক পদ্ধতি, এবং ৩। অধিকতর গবেষণা এবং উদ্ভাবন । যদিও এই উদ্যোগের কারণে যক্ষ্মা নির্ণয় এবং চিকিৎসা আরও ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে যার ফলে কিশোর বয়সের টিবি রোগীর সংখ্যা অধিক হারে বাড়েনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে দেশে প্রায় ১১১৯ টি সরকারি বেসরকারি ও এনজিও কর্তৃক পরিচালিত যক্ষ্মা রোগের সেবা কেন্দ্র রয়েছে যার সিংগভাগ নগরে অবস্থিত। কিন্তু যক্ষ্মা রোগের পরিপূর্ণ চিকিৎসার জন্য একমাত্র বড় হাসপাতাল হচ্ছে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউড ও হাসপাতাল যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল । যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা কমানোর জন্য নগরের অন্যান্য চিকিৎসার মত যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে, বাড়াতে হবে হাসপাতাল । একই সাথে নগরের জনগণকে আরো সচেতন করতে হবে । সরকারি বেসরকারি যেসব ডট সেন্টার রয়েছে সেগুলোতে পূর্ণ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক:
মোহাম্মাদ মনিরুল হাসান (অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অরডিনেটর)
এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট
ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা)
এমিনেন্স এসোসিয়েট ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট