রাজু আহমেদ মামুন:
বাংলায় সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন এবং ধারাবাহিক বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। যা আজও পৃথিবীর অধিকাংশ বাঙালীরা পালন করে থাকেন।ধর্ম হিসেবে এদেশে ইসলামের আগমন সপ্তম শতকে, যে শতকে নবী ধর্মটি প্রতিষ্ঠা করে মারা যান এবং এটা এখন নিশ্চিত। লালমনিরহাট জেলার পঞ্চগ্রামের ৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত মসজিদ যার জ্বলন্ত প্রমাণ।
আরব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইসলাম বাংলার উপকূল দিয়ে আগমন করলেও ছড়িয়ে পড়েছিলো বৃহৎ বঙ্গে। ফলে বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট মুসলিম কমিনিটির উপস্থিতি থাকা স্বাভাবিক এবং ঈদ সংস্কৃতির শুরুও সেই কাল থেকে।
সেকালে ব্রাহ্মণ্যবাদ বা হিন্দু ধর্মের উপস্থিতি বাংলার জনপদে ছিলো না বলতে, তবে বৌদ্ধ ধর্মের উপস্থিতি ছিল বেশ জোরালো, সাথে জৈন ধর্মের অনুসারীদের উপস্থিতি ছিল বলে প্রমাণ মেলে। তবে অধিকাংশ জনগণ ছিলো জড়বাদী বা প্রকৃতিপুজারি, নানারকম আদিবাসী উপজাতীয় কৌম ধর্ম সম্প্রদায়ে বিভক্ত। আবার ভিন্ন ভিন্ন জনপদে বিভক্ত বৃহৎ বঙ্গ জুড়ে একক কোন জাতিসত্তার জন্ম তখনও হয়নি।
বলে রাখা ভালো যে- ধর্মের নাম ইসলাম হলেও যারা এই ধর্মকে অনুসরন করে তাদের বলা হয় মুসলিম বা মুসলমান। মুসলমান কোন জাতি পরিচয় নয়, এটি ধর্মসম্প্রদায়ের পরিচয়। এটি উন্মুক্ত, পৃথিবীর যে কোন জাতির লোক ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করে এই সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। এই ধর্মে বছরে দু’বার ঈদ উৎসব হয়। আরবি রমজান মাসে মুসলমানরা পুরোমাস রোজা বা উপবাস পালনের পর একদিন পালন করেন ঈদুল ফিতর। এর ঠিক আড়াই মাস পরে পালন করে তিনদিন ঈদুল আজহা, এ সময়ে পশু কোরবানি করে দরিদ্রদের মধ্যে মাংস এবং খাবার বিলিয়ে এ উৎসব পালন করা হয়। সম্মিলিতভাবে কোন মাঠে ঈদের নামাজ পড়ে এর আনুষ্ঠানিকতার শুরু হয়। ঈদের আগে মুসলমানদের সম্পদের একটি অংশ দরিদ্রদের মধ্যে বিলানো এবং খাবার পরিবেশনের সংস্কৃতি নিশ্চয়ই সে কালের স্থানীয়দের মধ্যে উৎসাহ যুগিয়েছে বলে ধারনা করা যায়।
পরবর্তী পাল-চন্দ্র যুগে আব্বাসিয় খলিফাদের মুদ্রা ময়নামতি বৌদ্ধ বিহারে মিলেছে, ফলে এর ধারাবাহিকতাও অটুট ছিলো। বিভিন্ন সংস্কৃত সূত্রেও মুসলমানদের উপস্থিতির প্রমাণ মেলে বলে জানাযাচ্ছে। এছাড়া পাল আমলেই অনেক পীর দরবেশের উপস্থিতি জানা যায়। অতএব ঈদ সংস্কৃতির পরিসর যে বেড়েছিলো তাতে আর সন্দেহ কি!
হিন্দু সেন রাজারা ছিলো বহিরাগত, তারা বারো শতকে বাংলার রাজ ক্ষমতা দখল করে এবং সমগ্র বাংলা সেনদের সামান্ত মহাসামান্ত জমিদারদের মধ্যে বাটোয়ারা হয়ে যায়। এ সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ বা হিন্দু ধর্ম রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় কিছুটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে, বিদেশ থেকে ব্রাহ্মণদের আনিয়ে বর্ণপ্রথার সূচনা হয় কিন্তু তা ছিলো মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে, দক্ষিণ পশ্চিম এবং কিছুটা উত্তর বঙ্গ ছাড়া পূর্ব বঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশে তার কোন প্রভাব ছিলো না। তবে সেন রাজারা স্থানীয় মুসলমানদের মসজিদ নির্মানে অনুদান দিয়েছেন বলে ইতিহাসে প্রচ্ছন্ন উল্লেখ পাওয়া যায়।
অতঃপর ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে খলজি মুসলমানরা বাংলার উত্তর পশ্চিমাংশ দখল করে প্রতিষ্ঠা করেন লখনৌতি রাজ্য। তারা যে তাদের ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তার ঐতিহাসিক তথ্যও রয়েছে। তাই রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলাম ধর্মের গতি বৃদ্ধি হয়েছিলো ত্রোয়দশ শতক থেকেই। হয়তো একারনেই বৃহত্তর পাবনা, বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী, মালদা এবং মুর্শীদাবাদ অঞ্চলে ইসলাম অনুসারীদের সংখ্যাধিক্য বহু আগ থেকেই ছিলো। ফলে ঈদ সংস্কৃতিও ছিলো এবং তার কলেবর বৃদ্ধি পাবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন- সেন শাসনের পতন হলেও তাদের সামান্ত মহা সামান্ত জমিদারগন মুসলিম শাসকদের বস্যতা স্বীকার করে বহাল তবিয়তেই ছিলেন এবং সংখ্যাল্প বহিরাগত ব্রহ্মণদের অধিকাংশ তাদের আশ্রয়ে ছিলেন। যদিও এই সব অভিজাত ব্রাহ্মণদের সাথে জনপদের সাধারণ মানুষদের বিশেষ কোন যোগ ছিলো না।
আবার উল্টো প্রমাণও কিছু মেলে, মুসলিম শাসন তের শতকে শুরু হলেও সমগ্র বাংলা তাদের দখলে আসে চৌদ্দ শতকে কিন্তু হিন্দু শাসিত বিক্রমপুর অঞ্চলের জনৈক সামান্ত রাজা বল্লালের সাথে দলবল সহ বাবা আদম নামে এক মুসলিম সন্তোর যুদ্ধ হয়েছিল, ধর্মাচারণে বাধা দেয়ার ফলে। তার মানে, ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রাচীন বঙ্গ-সমতট-হরিকেল বা পূর্ব বঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল- যেখানে হিন্দু ধর্মের উপস্থিতি ছিল কদাচিত, সেখানে ইসলামের একটা জোরালো উপস্থিতি ছিলো মুসলিম শাসন পূর্ব যুগেই। ফলে ঈদ সংস্কৃতিও যে ছিলো তাতে আর সন্দেহ কি!
চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমল। এই সময় থেকেই সমগ্র অঞ্চলের নাম হয় বঙালা বা বাংলা (আগে কেবল পূর্ব বঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশের একটা বিশেষ অঞ্চলের নাম ছিলো বঙ্গ এবং বঙ্গাল), সমগ্র সালতানাতের অধিবাসীদের রাজনৈতিক পরিচয় হয় বঙালি। সুলতান নিজেও উপাধি নেন শাহী বঙাল। এই সময় থেকেই বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম হয়ে ওঠে ইসলাম। ইসলামের একটি সুবিধা ছিলো অবাধ বৈবাহিক সম্পর্ক, যার ফলে নানারকম আদিবাসী উপজাতি অধ্যুসিত বাংলায় একটি পুর্নাঙ্গ, বৃহৎ জাতিগঠনের দরজা খুলে যায়। এমনকি স্থানীয় লোক ভাষাটি, সেন আমলে ব্রাহ্মণরা যাকে নরকের ভাষা বলে ঘৃণা করতো, সেটি সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। হয়তো স্থানীয়দের মাঝে ধর্ম প্রচার এবং শাসনের সুবিধার্থেই তারা বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন- সুলতানি আমলে অনেক লোকায়ত দেবদেবীর পুরোহিতরা নিজেদের ব্রাহ্মণ দাবী করতে শুরু করে, যারা ছিলো স্থানীয় জনসাধারণের অংশ। কেন্দ্রীয় হিন্দু শাসনের অভাবে ছিটেফোঁটা অভিজাত ব্রাহ্মণদের পক্ষে এদের দমন করাও সম্ভব ছিলো না। এই পুরহিত নকল ব্রাহ্মণরা, স্থানীয় ভাষায় স্থানীয় লোক দেবদেবীদের নিয়ে সৃষ্টি করতে থাকে নানা উপাখ্যান, বেড়ে যায় তাদের জনপ্রিয়তা, প্রভাব। সৃষ্টি হয় বাংলার নিজস্ব হিন্দু ধর্ম এবং মুসলিম শাসনের মধ্যেই বাড়তে থাকে এর পরিসর। তবে হীনমন্যতা থেকে এই নকল ব্রাহ্মণদের মধ্যে খাঁটি ব্রাহ্মণ হওয়ার একটা তীব্র প্রবণতাও ছিলো। ফলে সংস্কৃত ভাষা সাহিত্য চর্চাও এরা করেছে মরিয়া হয়ে। এতে করে মধ্য যুগের বাংলা ভাষা প্রথমে তার লোকায়ত ধারাটি প্রবল করেছে আরবি ফার্সি সহযোগে এবং অচিরেই তাতে যোগ হয়েছে সংস্কৃত ভাষার ছোঁয়া। সর্বোপরি মধ্য যুগে আধুনিক বাঙালি জাতিসত্তা বিনির্মানে ইসলাম ধর্মের সাথে বঙ্গীয় হিন্দু ধর্মের অংশগ্রহণ এবং অবদানও ছিলো গুরুত্বপূর্ণ।
মোগল আমল ছিলো ঔপনিবেশিক যুগ, শাসক দূর দেশে বসে প্রতিনিধি দিয়ে শাসন করাতেন, স্থানীয়দের সাথে তার যোগ ছিলনা বললেই চলে। যদিও তাতে বাংলার ঈদ সংস্কৃতির উপর বিশেষ কোন প্রভাব ছিলোনা বলেই বোধ করি। তবে গ্রামীন জনপদে ঈদ উপলক্ষে নৌকা বাইস সম্ভবত এই সময় থেকেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তুলনামূলক স্বাধীন নবাবী বাংলার চল্লিশ বছরে বাংলার মুসলিম জনগণের সাথে নবাবদের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক খুব একটা ছিলো বলে মনে হয় না, এর প্রধান কারন বোধ করি ধর্মীয় তরিকার পার্থক্য। নবাবরা ছিলেন সিয়া কিন্তু বাংলার মুসলমানদের প্রায় সবাই ছিলো সুন্নি ধারার। তবে ঈদ সংস্কৃতিতো দু’দলেরই সমান, কাজেই এ সময়ের ঈদ উদযাপন জাঁকজমকই ছিলো বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
ব্রিটিশ দখলের দুইশত বছর ছিলো বাঙালি মুসলমানদের চরম দুর্যোগ কাল। শুরুতেই এই জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস বস্র শিল্প ধ্বংস হয় ইংরেজদের হাতে, পরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারনে অধিকার হারায় নিজেদের দখলি জমির উপর। আবার সেই জমির প্রায় সব জমিদার হয়ে ওঠে নিজ জাতির কিছু লুঠেরা হিন্দু। মাঝখানে দেখাদেয় ৬ থেকে ৫০ স্তরের মধ্যসত্বভোগির। তারাও প্রধানত হিন্দু এবং বর্ণবাদী। এদের সম্মিলিত শোষণ চিত্রটা ছিলো এমন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইংরেজরা যে জমিদারির খাজনা নির্ধারণ করতো ২০০ টাকা, সেই জমির কৃষকদের কাছ থেকে জমিদার এবং তার লোকেরা খাজনা আদায় করতো ৪৮০০ টাকা। ফলে জনসাধারণের কাছে বিদেশি শোষকের চেয়েও নির্মম শোষক হয়ে দেখা দেয় এই দেশীয় লুঠেরা জমিদারকূল। যাদের প্রযত্নে আবার গড়ে উঠেছিলো সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি। ফলে এই শোষকরা জনগণের কাছে পরিচিত হয় সাম্প্রদায়িক শত্রু হিসেবে। যদিও পৃথিবীর সমস্ত শোষকের চরিত্র একই রকম।
বিচিত্র শোষণ এবং ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রাণ বাঁচাতে একের পর এক বিদ্রোহে জড়িয়ে পরে বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠী। পিছিয়ে পড়ে আধুনিক শিক্ষা সংস্কৃতি থেকে। তাই বলা যায় এ কালের ঈদ সংস্কৃতি ছিলো বাংলার সমাজ-জীবনে বেশ নিস্প্রভ।
পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে বাংলার শহুরে ঈদে উর্দু সাম্রাজ্যবাদীদের কিছুটা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থাকলেও গ্রামীণ ঈদ ছিলো তার চিরায়ত বৈশিষ্ট্যের। ঈদের দিন বিকেল থেকে শুরু হতো নানা রকম খেলা, মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাতে বসতো জারি-শারি-মুর্শিদী গানের আসর অথবা নানা রকম পালাগান বা যাত্রাপালা।
বাংলাদেশ আমলে বাঙালির ঈদ উৎসব হয়ে উঠেছে সবচেয়ে প্রানবন্ত এবং জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব। এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও বিশাল। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্থ প্রবাহ হয় দুই ঈদে।
দুই ঈদ বাঙালি জীবনের সবচেয়ে বড় পার্বণ। ধনি গরিব নির্বিশেষে সকল বাঙালি মুসলমানরা এ উৎসব পালন করে, এমন কি বাঙালি মুসলমান নাস্তিকরাও।
রাজু আহমেদ মামুনঃ গবেষক ও লেখক