কাকন রেজা : ফাগুন চলে যাওয়ার চৌত্রিশ মাস। প্রতীক্ষা শব্দটা প্রাপ্তির। অর্থাৎ যার শেষ প্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে। আর অপেক্ষা শব্দটা নেতিবাচক। যার শেষ না পাওয়ার মাঝে। আমি ফাগুন হত্যার বিচারের প্রতীক্ষায় আছি। কিন্তু সময় বোধহয় এখন অপেক্ষার। অবশ্য এও জানি, সময়ও পরিবর্তনশীল। হাল ছাড়িনি।
একজন বললেন, আপনি তো কোন দলের সাথেই যান না। একটা পক্ষ নিতে হয়। অন্তত একটা পক্ষে থাকতে হয়। না হলে সবাই মনে করে বিপক্ষের লোক। অর্থাৎ নিরপেক্ষতা বিষয়টি এখন আর কার্যকর নেই। সে হিসেবে সাংবাদিকতাও এখন ভ্যানিশ। কারণ সাংবাদিকতার মূলনীতিই নিরপেক্ষতা। খবর হবে নিরপেক্ষ। খবরের মানুষ কাজের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকবেন। সাংবাদিকরা রাজনৈতিক আদর্শের প্রশ্নে বিভাজিত হতে পারেন, কিন্তু ঘটে যাওয়া অন্যায়, অবিচারের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকাটাই সাংবাদিকতা। এর বাইরে যারা, তারা সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে দাবি করার কোনোভাবেই যোগ্য নন।
ফাগুন রেজা। ইহসান ইবনে রেজা। একজন গণমাধ্যমকর্মী ছিলেন। একজর সাবএডিটর এবং রিপোর্টার। পিতা ও নিজে একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে বলতে চাই এবং তা পরিষ্কার ভাবে, অভিজ্ঞতা বলে এ মৃত্যু সাংবাদিকতার জন্যই। গণমাধ্যমকর্মী হওয়ার জন্যই খুন হতে হয়েছে ফাগুনকে। আজকে চৌত্রিশ মাস প্রতীক্ষা করছি ফাগুন হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য। না, এখনো অসহিষ্ণু হইনি, আশা ছাড়িনি, কারণ সাগর-রুনি’র দৃষ্টান্তটা চোখের সমুখে রয়েছে।
সেদিন ফাগুনের এক শিক্ষকের সাথে কথা হচ্ছিল। উনি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছিলেন আর আমি নিজের আবেগকে সামলাচ্ছিলাম। বলছিলেন, ফাগুনের মেধার কথা। বলছিলেন, স্কুল থেকেই অসম্ভব মেধাবী ছিলো সে। একবার বললেই হতো, ভুলতো না ফাগুন।
না, শুধু মেধাবীই নয়, শুদ্ধতার প্রশ্নেও নিরাপোস ছিলো সে। তার ইচ্ছা ও স্বপ্ন ছিলো একটি বিশুদ্ধ গণমাধ্যমের। ফাগুনের চলে যাবার পর যা লিখেছিলেন লেখক সাংবাদিক তানজিল রিমন। তার লেখার শিরোনাম ছিলো, ‘একটি শুদ্ধ গণমাধ্যম চেয়েছিলো ফাগুন’।
শুদ্ধতার বিষয়ে বলি। ফাগুনের এক শিক্ষকের সাথে ফাগুনের একটা ব্যাপার নিয়ে কথা হয়। তখন ফাগুন সদ্য মাধ্যমিক পাশ করেছে। শিক্ষক একটা বিষয় নিয়ে বলছিলেন। ফাগুন বিনীতভাবে ব্যাখ্যাটি যে ভুল তা তার স্যারকে বলেছিলো। কিন্তু শিক্ষকসুলভ ইগো’র কারণে তিনি বিষয়টাকেই মেনে নিতে চাইছিলেন না। কিন্তু ফাগুন শেষপর্যন্ত বিষয়টা যে ভুল তা প্রমাণ করে দিয়েছিলো। আর তা করেছিলো তার শিক্ষককে অসম্মান না করেই। একজন সদ্য মাধ্যমিক পেরুনো ছেলের কাছ থেকে এতটা আশা করেননি সেই শিক্ষক। পরে তিনি অকপটে প্রশংসা করেছেন ফাগুনের। এই ছিলো ফাগুন। নিজের স্বল্পপরিসর সাংবাদিকতার জীবনে শুদ্ধতার বাইরে যায়নি সে। লোভকে জয় করতে শিখেছিলো সেই অল্প বয়সেই।
এমন একজন তরুণকে হত্যা করার অর্থ হলো, শুদ্ধতাকেই হত্যা করা। সততাকে নিহত করা। মেধাকে খুন করা। একজন পিতা হিসেবে আমি হয়তো সন্তান হারিয়েছি, কিন্তু এ দেশের ধুঁকতে থাকা গণমাধ্যম তার এক প্রাণশক্তিকে হারিয়েছে। গণমাধ্যমকে বাঁচানোর জন্য ফাগুনদের আজ বড় প্রয়োজন। আপোসের বিরুদ্ধে জেগে উঠার মতন তারুণ্য প্রয়োজন।
ফাগুন রেজা’র গণমাধ্যমে ঢোকার কথা অনেকবার বলেছি, তার পুনরাবৃত্তি না করে শুধু বলি, ফাগুন নিজ মেধাতেই গণমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছিলো। আমার পরিচয়েরও দরকার হয়নি। পরিচয়ের দরকার হলে ফাগুন যে পরিবার থেকে এসেছে সেই পরিবারের অনেকেই আছেন যাদের নাম ব্যবহার করতে পারতো। এ দেশের সাংবাদিকতা, শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ অনেক বিষয়ের ইতিহাস লিখতে গেলে এই পরিবারকে অস্বীকার করা যাবে না, অস্বীকার করা সম্ভব নয়। সুতরাং ফাগুন পারতো তার পরিবারের নাম ব্যবহার করতে, কিন্তু করেনি। নিজ যোগ্যতায় সে প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলো।
ফখরুদ্দিন-মঈন শাসনামলে, আমার নিজ জেলায় জেলার বিশেষ ব্যক্তিদের নিয়ে একটা সভা ডেকেছিলেন জেলা প্রশাসক। সৌভাগ্যক্রমে সেখানে আমন্ত্রিত ছিলাম আমি এবং আমার পিতা। দুই দিকের প্রথম দুটো চেয়ারে পিতা-পুত্রের অবস্থান ছিলো। একজন সচিব ছিলেন সেই সভার প্রধান অতিথি। সচিব যিনি তিনি আমাদের সম্পর্ক জানতেন। কিন্তু জেলা প্রশাসক জানতেন না। সভার মাঝখানে একজনের বক্তব্যে আমাদের পিতাপুত্রের সম্পর্কটা প্রকাশিত হলো। জেলা প্রশাসক সভার পর প্রশ্ন করলেন আপনারা পিতাপুত্র তা জানতাম নাতো। বলেছিলাম, এটার জানার কী খুব দরকার, আমরা প্রত্যেকেই নিজ পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই, সম্পর্কগুলো মূলত সম্পূরক। সে ধারাতেই ফাগুন তার নিজ পরিচয়েই বড় হয়ে উঠতে চেয়েছিলো। কিন্তু হতে দেয়া হয়নি। কেন হয়নি, সে প্রশ্নটা আন্দাজ করা গেলেও, আনুষ্ঠানিক ভাবে জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি এই চৌত্রিশ মাসেও। ফাগুন হত্যাকাণ্ড সেই তদন্তেই আটকে আছে। এগিয়েও থমকে গেছে।
প্রতীক্ষায় আছি, অপচেষ্টা হলেও প্রতীক্ষাকে অপেক্ষা হতে দেবো না। সৃষ্টিকর্তার কাছে আয়ু প্রার্থণা করি যেন ফাগুনের বিচার সম্পন্ন হয়, খুনিদের শাস্তি হয় সাথে খুনের আবহ সৃষ্টির কারণ অপসারিত হয় এবং তা দেখে যেতে পারি।