মাসকাওয়াথ আহসান
প্রসঙ্গ প্রেম ও মায়াঃ স্মৃতিগদ্য
আমার আম্মা ভীষণ এন্টি-রোমান্টিক মানুষ। ইন্দিরা গান্ধী রাশির মানুষ। অন্যদিকে আব্বা উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখে রোমান্টিসিজমকেই লাইফ-স্টাইল হিসেবে নিয়েছিলেন।
আব্বা জ্যোতস্না রাতে বড়াল নদীতে আম্মাকে নৌকাভ্রমণে নিয়ে গেছেন। কিন্তু এসব সিনেমাটিক ব্যাপারকে আম্মা কখনোই প্রশ্রয় দেননি।
ফলে কলেজ জীবন থেকে আমার ফিমেল ফ্রেন্ডরা আমাদের বাসায় এসে একটু ঢং ঢাং করার পরিবেশ পায়নি। মনের মধ্যে ‘রোজ রোজ আঁখু তলে; একহি স্বপনা জ্বলে” সুর ভাঁজতে ভাঁজতে এসে আম্মার চোখাচোখি হতেই থমকে গেছে। চশমা পরা সেন্সর বোর্ড; নায়িকাকে ফ্রিজ করে দিয়েছে ড্রইং রুমে; নায়কের স্টাডিরুমে ঢোকা তার হয়নি।
জীবনের শুরুতেই প্রেমের বিকাশ থমকে যাওয়ায়; আর কখনো প্রাণখুলে প্রেম করতে পারিনি। কোথাও ঘুরতে গিয়ে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের কোন ঘিয়ে রঙ স্কার্ট পরা বান্ধবী তার বোনের বাসার স্টাডিতে সোন্নত গ্রীবায় প্রজাপতি চুম্বন এঁকে দিতে এলে; মনে হতো; আম্মা ফ্যাসিস্টের মতো; পাভেল বলে চেঁচাচ্ছেন।
পশ্চিমা দেশে ডিসকো থেকে ফরাসী বান্ধবীর সঙ্গে যুগল নৃত্যের সময় কানের কাছে শুনেছি, সেই পাভেল ডাক।
পাভেল ওটা ছুঁড়বে না; ওটা ভাঙ্গবে না; মারপিট করবে না! পড়তে বসো।এখন ঘুরতে যাবার দরকার নাই; পড়তে বসো; খালার বাসায় গেলে আর ফেরত আসার কথা মনে থাকে না কেন! সৌম্য ছোট ভাইটাকে এতো জ্বালাও কেন! চুলের মধ্যে শাহরুখ খানের মতো পদ্ম ফুটিয়ে লাভ নাই।মুভিটা ফরোয়ার্ড করো; তোমার আব্বাই বা কেমন; এসব নাচ-গান দেখে ফরোয়ার্ড করতে বলছে না কেন!
এইরকম লক্ষ্ণণ রেখার মাঝে জীবন কাটিয়ে প্রেমের গোল্লাছুট খেলা আর সম্ভবই হয়ে ওঠেনি। অযথা বাইরের হাব-ভাব দেখে কম পরিচিত ছেলেরা ভেবেছে; নতুন নতুন গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরছে। অথচ আমি আম্মার এঁকে দেয়া লক্ষ্ণণরেখার মধ্যে আটকে থাকা মানুষ। শাসন আর স্নেহের এক এক্সপেরিমেন্টাল কারেকশান সেন্টার ছিলো আমার বেড়ে ওঠার কাল। আম্মার প্যানোপটিক ওয়াচ টাওয়ারে ধরা পড়ে যায় আমার যে কোন মুভ।
আমার ফরাসী ফিমেল ফ্রেন্ড উদ জিজ্ঞেস করেছিলো; কথা বলতে বলতে অনমনষ্ক হয়ে যাও কেন! আমি আম্মার শাসনের কথা বলেছিলাম। উদ তখন হাসতে হাসতে বলেছিলো; তোমার আম্মা মনে হয় আমার আম্মার টুইন। আম্মার শাসনের ঠেলায় আমি প্যারিস থেকে পালিয়ে কোলনে এসেছি। এরকম পারফেকশনিস্ট মায়ের পাল্লায় পড়ে এখনও চোখ তুলে কথা বলতে পারিনা। আমি এটা লক্ষ্য করেছিলাম। বন শহরের অদূরের ব্রোট ফাবরিকের মৃদুলা সিং-এর ডান্স নাইটে আমার সঙ্গে গিয়ে নাচার সময়; উদ এমন সংকোচে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছিলো; যেন সে প্যারিস না; প্রয়াগরাজের সংস্কারি কইন্যা।
আম্মা সম্প্রতি আবার বললেন, এইসব প্রেম-ভালোবাসা খুব ওভাররেটেড। কবিগুলো প্রেমের কবিতা লিখে; গল্পকাররা প্রেমের গল্প লিখে; এরপর নাটক-চলচ্চিত্রে প্রেম প্রেম করে একটা আলুথালু অবস্থা তৈরি করেছে। তোমরা যে এতো প্রেম প্রেম করো; তারপর পট পট করে সব সম্পর্কচ্যুতি ঘটে। অথচ তোমার আব্বার সঙ্গে অর্ধশতকেরও বেশি জীবনে দেখো; দুজনের মাঝে চমৎকার বোঝাপড়া ছিলো; গল্প করার বিষয়ের অভাব হতো না; আর আছে মায়া।
এই যে তিন বছর হলো মানুষটা নেই; তবুও একটু বেশি খরচ হয়ে গেলে ভয় লাগে; তোমার আব্বা অসন্তুষ্ট হবে। কিংবা যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে মনে হয় ওকে জিজ্ঞেস করি, তারপর মনে পড়ে ওতো নেই। আমাদের তো অমন হাত ধরাধরি করার অভ্যাস ছিলো না; কিন্তু সেদিন স্বপ্নে দেখি; আমরা ব্যাংকে গেছি; একটা অফ হোয়াইট সুন্দর শার্ট পরে তোমার আব্বা; আমার হাত ধরে রেখেছে।
মায়া শব্দটা বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ফারসি সব ভাষায় আছে। নানা রকম অর্থে। আসলে পারস্য থেকে প্যারিস, দক্ষিণ এশিয়া থেকে লাতিন এমেরিকা; সবাই মায়া শব্দটার অর্থ খুঁজেছে। হয়তো মায়ার অর্থ খোঁজাটাই জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।
মাসকাওয়াথ আহসানঃ লেখক, সাংবাদিক