মাসকাওয়াথ আহসান
পৃথিবীর আর কোন দেশে এমনকী ভারত-পাকিস্তান-নেপাল-ভুটান-মালদ্বীপ-শ্রীলংকায় রাস্তায় গিয়ে বানর খেলা শুরু করলে; কাজ ফেলে কেউ দাঁড়িয়ে যায় না বানর খেলা দেখতে। হয়তো কিছু শিশু ভিড় করে; যেটা বয়সোচিত।
কিন্তু বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকায় রাস্তায় বানর খেলা শুরু করলে; দেখবেন কাজ ফেলে লোকজন দাঁড়িয়ে গেছে। ট্রাফিক পুলিশ হিমশিম খেয়ে যাবেন ভিড় সরাতে।
শিক্ষা বাজেট সর্বনিম্ন রেখে আর ১৯৭২ সাল থেকে নকলের ব্যবসা শুরু করে; দলীয় ভিত্তিতে আকাট মূর্খগুলোকে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে; স্বদেশী উপনিবেশ গড়ে তোলার উপযুক্ত প্রজা গড়ার প্রকল্প শুরু করা হয়েছিলো। জাতির জনক বিদ্যানুরাগী হলেও চোরের খনির চাটার দল শিক্ষা-ব্যবস্থাকে খেয়ে ফেলেছে উঁইপোকার মতো। বিএনপি-জাতীয় পার্টিও মজা পেয়ে যায় এমন শিক্ষা বঞ্চিত প্রজা তৈরির রাজনৈতিক কল দেখে।
এরপর আর শাসন শোষণ ত্রাসন সং হার চালিয়ে যেতে কোন অসুবিধা হয়নি তিনটি দলেরই; জামাত এই সুযোগে ইসলামি বিপ্লবের চারা রোপণ করে তাদের নিজস্ব ধারার শিক্ষা-ব্যবস্থায়। আর ইংলিশ মিডিয়ামে তৈরি হয়েছে হাসজারু; যারা ঢাকার জন্য ওভার স্মার্ট-পশ্চিমের জন্য ইয়ুজলেস।
নেই নেই করেও শিক্ষা-ব্যবস্থার যতটুকু ছিলো; তা গুঁড়িয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগের ২০০৯-২৩-এর একদলীয় ঔপনিবেশিক শাসক।
আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের ছেলে-মেয়েও লুটের পয়সায় দেশের বাইরে পড়ে। বিদেশ থেকে জমিদারি চালানোর ট্রেনিং দিইয়ে নিয়ে এসে নব্য জমিদারদের পুত্র-কন্যাকে ক্রমে ক্রমে গদিনশীন করা হয়েছে; প্রজাদের দলাই মলাই করে আওয়ামী উপনিবেশ ধরে রাখার জন্য। বিএনপির নেতারাও অনেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলেঝুলে পুকুর চুরি করে নিজেদের ছেলেমেয়েদের বিদেশ থেকে পড়িয়ে এনেছে। সেকেন্ড হোম বিপ্লবের ফজিলত এইসব বাছুর চিফ হিট অফিসার ।
নাই নাই করেও যেটুকু মেধা সেনাবাহিনীতে ছিলো; যারা নাইন-ইলেভেনের টুইন টাওয়ার হামলা পরবর্তী অভিঘাতের কট্টর ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছিলো; তাদের হত্যা করা হয় পিলখানার ফাঁদে ফেলে। এই ঘটনা যেই ঘটাক; এর বেনিফিশিয়ারি আওয়ামী লীগ। যেভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড যারাই ঘটাক যেমন বেনিফিশিয়ারি ছিলেন জিয়া। জিয়া হত্যাকান্ড যারাই ঘটাক; বেনিফিশিয়ারি ছিলেন এরশাদ।
এরপর আওয়ামী লীগের দলীয় স্ট্রিট ফাইটে প্রাণ দেয়া-প্রাণ নেয়া জোসেফদের ভাইকে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দেখে; আমরা বুঝলাম; সেনাবাহিনীর শৃংখলা-আভিজাত্য-“দল নয় দেশের প্রতি আনুগত্যে”র সোনালি নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে।
এরপর এলিটফোর্সের চেহারাটিকে রক্ষীবাহিনীর রুপ দেয়া হয় নজিরবিহীন দলীয় পছন্দে। শুরু হয় ক্রসফায়ারে পাখির মতো মানুষ মারা। এলিট ফোর্সের নজিরবিহীন সহমত অফিসারের নেতৃত্বে সহব্রত অফিসারকে ক্রিয়াশীল দেখা যায়। “বিএনপি-জামাতে”র অপারেশন ক্লিন হার্টের অনুকরণে “আওয়ামী লীগ-বিজেপি”র ভালোবাসার যৌথ খামারে অপারেশন ক্লিন অপোজিশনের রক্তের হোলিখেলা চলতে থাকে।
৫৭ ধারা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট দিয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে ভীতির সার্বক্ষণিক চোরাবালিতে ফেলে ভিক্ষুক পাগল আর উন্মাদ বানানো হয়। পাকিস্তান দখলদার উপনিবেশের হাত থেকে বাংলাদেশ মুক্ত করে ভারত আওয়ামী লীগের হাতে দিয়েছে ১৯৭১ সালে। সুতরাং সেই কৃতজ্ঞতাবশত ২০০৯ থেকে এই সুবে বাংলার মালিক আওয়ামী লীগ। দিল্লির অঙ্গুলি হেলনে নির্ধারিত হয় নির্বাচন-মন্ত্রীসভা। রাজদণ্ড হাতে পাওয়া গার্মেন্টস সেক্টরের দর্জিরা লেন্দুপ দর্জি হয়ে স্ত্রীর মতো প্রেম নিয়ে গাড়ি চালিয়ে ভারতে যায়; ভালোবাসার নজরানা দিতে, হুকুম করুন স্বামী মোদীজী।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্রসফায়ারে মানুষ মারা বন্ধ হলে আয়নাবাজেরা শুরু করে বানর নাচ। পাকিস্তান-ভারতের আয়নাবাজদের মডেলে এরা দল ভাঙ্গা দল গড়ার এডভেঞ্চারে নামে। অবশ্য দিল্লি থেকে যেদিন এক এগারোর সেনা প্রধান মইন উ ফিরেছিলেন, প্রণব মুখার্জির আশীর্বাদ আর ঘোড়া নিয়ে; সেদিন বোঝা গিয়ে হর্স ট্রেডিং-এ নামবে বাংলাদেশে মিলিটারি ও মস্ক। রণকৌশলবিদ চাণক্যের আলোয় স্নাত সিপাহসালার মি তারেক সিদ্দিকিকে জাতি সারাজীবন মনে রাখবে; আওয়ামী লীগের প্রতিরক্ষায় পরিবারের সদস্যসুলভ কুশলতার পরিচয় দেয়ায়।
সামনে নির্বাচন; এবারেও বিএনপিকে দূরে রেখে গৃহপালিত পশুপ্রাণী প্রজাতন্ত্র বজায় রাখতে হবে আওয়ামী লীগকে।
আয়নাবাজেরা তাই নুরু পুতুল আর রেজা পুতুলকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলো গৃহপালিত বিরোধী দল বানাবে বলে। সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতেই দিশেহারা দুই পুতুলের ঠোকাঠুকি দেখিয়ে দর্শককে বিনোদন দেয় গোয়েন্দা সংস্থার পুতুল নাচের শিক্ষকেরা। ফেসবুকে রয়েছে সহমত পুতুল আর সহব্রত পুতুল; তাদের কাজ হলো কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় নেচে ওঠা।
স্ট্যালিনের আমলে ক্রোকোডাইল নামে একটি পত্রিকা স্ট্যালিনের ছদ্ম বিরোধিতা করে জনমনে দোলা দিতো। আসলে তো সে স্ট্যালিনের পত্রিকা। এরকম অসংখ্য ক্রোকোডাইল মিডিয়া বাতাবি লেবু খায়; আর নন ইস্যুকে ইস্যু করে ঠেলে দেয় ঢাকায়।
একটা ক্রেডিবল নির্বাচনের আলোচনা যেন জনপরিসরে না ওঠে; সেজন্য তাবত পুতুল খেলা ও কুমির বিদ্যা সচল থাকে। জনগণ খুশির ঠেলায় ঘোরতে আনন্দে এসব ভাঁড়ামি দেখে আর হাহা ইমো দেয়; জোকার মুভির নায়কের মতো; কান্না পেলে যে হাসতো আর হাসতো।
ভারতীয় গোয়েন্দারা জানে পূর্ববঙ্গে নতুন জমিদাররা কেমন বোকা হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখে গেছেন কলকাতায় গিয়ে এই নতুন পয়সাওয়ালাদের বোকাট্টা হবার গল্প। তাই তারা সিগেরেট খেয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলা এক শিবব্রত দাদা শিপন কুমার বসুকে দায়িত্ব দেয়; বাংলাদেশের বিএনপি-লীগ ও পুতুল পরিষদের লোকেদের বাকরা বানানোর জন্য।
বাংলাদেশে একসময় আদম ব্যাপারীরা সৌদি আরবের ভ্যাগাবন্ড এনে তাদের আপিসে বসিয়ে রাখতো। তা দেখে শ্রমিকেরা আশা পেতো। দরিদ্র শ্রমিক জমি বেচে সৌদি আরবে যাবার জন্য টাকা জমা দেবার পরদিন দেখতো; আপিসও নেই; সৌদি ভ্যাগাবন্ডও নেই; আদমব্যাপারি হাওয়া হয়ে গেছে।
সেই একই দেশের লীগ-বিএনপি-পুতুল পরিষদের লোককে একে একে ইজরায়েলের এক ভ্যাগাবন্ড সাফেন্দির সংগে পরিচয় করিয়ে দেয় শিপন কুমার বসু। এরপর বেশ গোয়েন্দা কল্পনার পেয়ারা গাছ থেকে মোসাদ পেড়ে জেলে যায় বিএনপি নেতা আসলাম। আওয়ামী লীগের যে নেতারা এই মোসাদ পেয়ারা খায় তাদের জন্য রয়েছে ইনডেমনিটি। যেহেতু বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ইনডেমনিটি দিয়েছিলো এন্টি আওয়ামী লীগ; এই জন্য অনন্তকাল ধরে ইনডেমনিটির পেয়ারা খাবে আওয়ামী লীগের খুকু ও কাঠবেড়ালি। শেষ পর্যন্ত নূর পুতুলের ভাগ্য খারাপ; কারণ সে কোটা সংস্কার আন্দোলন করে বিসিএস-এ আওয়ামী লীগ ও শিবসেনা নিয়োগের পরিকল্পনায় বাধা দিয়েছে। শাস্তি তাকে শিবসেনা অবশ্যই দেবে। এই দেশে সাহস করে জামায়াতের বিচার চাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে শিবির যেভাবে কৌশলে ঠিকই ইমরান এইচ সরকারকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ফুল ফুটবে না ফুল ফুটবে না; ফুল আর কখনোই ফুটবে না।
একদলীয় চীন মডেলের নেশায় মোদীর আস্কারায় ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে গিয়ে এক্সিট রুট রাখেনি আওয়ামী লীগ। এই ভুল জাতির জনকও করেছিলেন বাকশাল প্রবর্তন করে। তাঁর স্নেহভাজন বঙ্গতাজ তাঁকে বলেছিলেন, এক্সিট রুট রইলো না লিডার; রাজনীতিতে সবসময় এক্সিট রুট রাখতে হয়।
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত জীবনে যে ট্র্যাজেডির মাঝ দিয়ে গেছেন; তাতে ভারতের সোনিয়া গান্ধীর মতো ক্ষমাশীল সুপার ওম্যান না হতে শিখলে; চোখের বদলে চোখ নীতিতে প্রতিহিংসার বাংলাদেশের অন্ধ হয়ে যাওয়াই নেমেসিস।
আমি অহিংসা ও শান্তির পক্ষে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করি। কিন্তু যে থাগস অফ বেঙ্গল ক্ষমতাকালে তাদের ঘিরে রাখেন তারা মীরজাফর-রাজবল্লভ-ঘষেটী বেগমের রক্তধারা। ক্ষমতার জন্য খুনো খুনি করা এদের জীনগত।
আর যাদের দাদা বানর খেলা দেখাতো; হাত সাফাই করতো রেলস্টেশনে ও লঞ্চঘাটে; তাদের নাতিরা কোটাল পুত্র হয়ে; দেশের সহজ সরল শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত মানুষদের বোকা বানাবে শতবর্ষ ধরে; এটাই বাংলাদেশের ভবিতব্য।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া