“ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড়,দোসর-জনম দিলা তিঁহ সে আহ্মার।”
( ‘বন্দনা’:শাহ মুহম্মদ সগীর)
বাবা দিবস এলেই মনে হয়; আমার বাবা তো ঠিক বাবার মতো ছিলেন না; আপাদমস্তক শিক্ষক ছিলেন। ফলে বাবা দিবসে অনেক ভালোবাসার বাবার গল্প বলা কঠিন আমার জন্য।
আব্বার চোখে আমি এবং তাঁর কলেজের ছাত্ররা একইরকম ছিলাম। কেবল মন দিয়ে পড়লেই তাঁর মন পাওয়া যায়। উনি এরিস্টোটলের পাঠশালার মতো করে গড়ে তুলেছিলেন; আমাদের বাড়িটিকে। ড্রইং রুমে দিনমান ছাত্ররা বসে থাকতো। ঈশ্বরদী কলেজের পাশেই আমাদের বাড়ি দ্যুতি-অরণী। কলেজের দাপুটে ভিপি-জিএস; সুবোধ বালকের মতো বই পুস্তকে মুখ গুঁজে বসে থাকতেন। সোন্নত সাহসের ছাত্রনেতা মিন্টু মামা; মাথা নিচু করে বসে থাকতেন গুরুভক্তিতে। আব্বা এই চ্যালেঞ্জগুলো নিতেন। সক্রিয় ছাত্র রাজনীতি করা ছেলেদের যুক্তিবিদ্যায় লেটার মার্কস পাওয়ানোর চেষ্টা আর ইংরেজিটা একটু দেখে দেয়া।
আব্বা তাঁর ভালো ছাত্রদের প্রতিদিন আমার সামনে উদাহরণ হিসেবে মেলে ধরতেন। আমি ফার্স্ট বয় ছিলাম স্কুল জীবনে। সেকেন্ড বয়ের চেয়ে ১০০ নম্বরের ব্যবধান এঁকে দেয়া ছিলো; আমার ছাত্রজীবনের টেস্ট ক্রিকেটের নিয়ম। আব্বা আমাকে ফার্স্ট হতে বলেন নি কখনো, বলেছেন ভালো করে বুঝে পড়ে শিখে বড় হতে; মানুষ হতে, দেশপ্রেমিক হতে। আব্বা কেবল দেশপ্রেমিক হতে বলতেন উনার ছাত্রদের। একজন এপলিটিক্যাল মানুষের প্রধান উপদেশ ছিলো দেশপ্রেম নিয়ে বেড়ে ওঠা।
ক্লাস ফোর-ফাইভেই আব্বা অবসর সময়ে আমার সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শন ও রাজনীতি নিয়ে সহজ করে আলোচনা করতেন। শেখাতেন জীবন-জগত-সমাজ-রাষ্ট্র সম্পর্কে; সক্রেটিক-প্লেটো-এরিস্টোটল-কান্ট-হেগেল-হিউম-কার্ল মার্কসের দর্শন চিন্তা সম্পর্কে। কলেজ লাইব্রেরি থেকে প্রতিদিন বই এনে দিতেন। বিশ্বকোষ পড়া ছিলো অবসর বিনোদন। তুলনামূলক ধর্মকে দর্শনের আঙ্গিকে বোঝান। ডারউইনের বিবর্তনবাদ খাতায় পেন্সিল দিয়ে এঁকে বোঝাতেন। লিবারেল আর্টসের শাখাগুলোতে প্রশিক্ষণ দিতেন।
আম্মা আমার সামনে সাহিত্যকে মেলে ধরতেন, চর্যাপদ-ব্রজবুলি থেকে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-মাইকেল মধুসূদন-বংকিম-জীবনানন্দ দাশ; আম্মা সবই পড়াতেন। সত্যজিত রায়ের ছবি ও ইন্টারভিউ দেখাতেন। শিক্ষক হিসেবে আব্বার চেয়ে আম্মা ছিলেন কড়া।
ক্লাস সিক্সে আব্বা বিশ্ব-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত করেন। ইংরেজি গ্রামারে জোর দেন। আমি প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরলে আম্মা একটা বাংলা ও ইংরেজি প্যারাগ্রাফ লেখাতেন। এরপর খেলার মাঠে যাবার অনুমতি। এখন ভেবে দেখি; ক্লাস সেভেনে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি করে দিলে ক্লাস টুয়েলভের মধ্যে বেশ মাস্টার্স করে বেরিয়ে যেতাম। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের ইংরেজির এক শিক্ষক আমার খাতা দেখে সেটাই বলেছিলেন।
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে মন না টেকাতে চলে যাই রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। সেখানে পেয়ে যাই ইংরেজির দাপুটে শিক্ষক রমজান আলী স্যার। তিনি পাঁচজন ছাত্রকে ইংরেজিতে ডিকটেশান দিতে পারতেন পাঁচটি ভিন্ন কবিতা ও গল্প থেকে নোট প্রস্তুতের। একবার রাজশাহীর সব ছাত্রের ইংরেজি পরীক্ষা নিয়ে ইজহারুল হক স্যারকে সেকেন্ড এক্সজামিনার করে একশোতে ৮৯ দিয়েছিলেন আমাকে।
রাজশাহী কলেজের শিক্ষকেরা প্রতিটি পরীক্ষায় ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নম্বর দিতেন। শাহনাজ ম্যাম ছিলেন প্রিয় ইংরেজি শিক্ষক। এইচ এসসিতে রাজশাহী বোর্ডে ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নম্বর পাই।
এইচএসসির পর সেনাবাহিনীতে গিয়ে ক্যু করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পাগলামি মাথায় চাপে; জিয়া-এরশাদের সেনাশাসন কিশোর বয়সে এই ভূত মাথায় ঢোকায়। আইএসএসবি-র প্রেসিডেন্টশিয়াল ভাইবা বোর্ডের সদস্যরা বলেন, তোমার আম্মাকে বোঝাও; তোমাকে আমরা বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়ে এনে ইনটেলিজেন্সে বসিয়ে দেবো। অলস ছেলে তুমি; মাঠে দৌড়াদৌড়ি করা যাতে না লাগে; আমরা সে ব্যবস্থা করবো।
আম্মা বেঁকে বসেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ভালোভাবে টিকে গেলেও ভাইবায় যাইনি। আম্মা যান ভাইবা দিতে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আম্মাকে বলেন, ওকে ইংরেজিতে ভর্তি করে নিচ্ছি; ওকে ঐ সর্বনাশের পথ থেকে ফিরিয়ে আনুন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আর আনিস আহমেদ স্যার ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে কালচারাল শো আর থিয়েটার ডিরেকশনের ব্ল্যাংক চেক দেন। ইন কোর্স বা টিউটোরিয়ালে ইমতিয়াজ হাবিব, রাজিয়া খান আমিন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কাশীনাথ রায়, আনোয়ারুল হক, খন্দকার রেজাউর রহমান, ফেরদৌস আজিম; কেউ কখনো এ-গ্রেডের নীচে নম্বর দেননি; একটি দুটি বি-প্লাস দিয়েছেন কায়সার হক। আর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তো এ দেবেনই। কারণ উনি আমার ক্রিয়েটিভ রাইটিং-কে প্রতিনিয়ত উতসাহিত করতেন।
কিন্তু নিয়াজ জামান ম্যাডাম ডিপার্টমেন্ট থিয়েটারের ডিরেক্টর ছিলেন; তাঁর নাটক নিষ্প্রভ হয়ে যায়; আমাদের ড ফস্টাস কিংবা রাবণ নাটকের কাছে। ভাইভা বোর্ডে উপহাস করে বলেন, ড ফস্টাস অনুবাদ করো, ডিরেকশান দাও;তোমার তো ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি দরকার নাই। উনি আমাকে ইরানি কালচারাল সেন্টারে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ভলান্টিয়ার হতে বলেন; আমি না যাওয়াতে ক্ষ্যাপা দুর্বাশা হন। ভাইভাতে ৫০-এ ১৯ দিয়ে; আর আনোয়ারুল হকের দেয়া এ ও এ প্লাস গ্রেড যুক্ত না করে ২০-এ শূন্য দিয়ে; কোর্স কো-অর্ডিনেটর হিসেবে অনার্স ও মাস্টার্সে সেকেন্ড ক্লাস দিয়ে ছেড়ে দেন। উনার পছন্দের যাকে ভালো সেকেন্ড ক্লাস দিয়ে শিক্ষক বানান; সে এখন ক্লাসে অনাম্নী ও অজনপ্রিয় শিক্ষক; যেটা খুবই স্বাভাবিক। আমাদের এই নিয়াজ টাইপের কুইনেরা সহকর্মী চাননা; অনুগত স্তাবক চান সর্বত্র।
আব্বা আমার মার্কশিট ছুঁড়ে ফেলে দেন। বিসিএস দিয়ে তথ্য সার্ভিসে প্রথম হয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকি। ভর্তি হই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রামাটিকসে। সেলিম আল দীন স্যার ভোরের কাগজে আমার লেখা নাট্য সমালোচনা পড়ে ফোন করে ডেকে পাঠান। ভর্তি করে নেন। জার্নালে লেখা প্রকাশ হলে ড্রামাটিকসে সিনিয়র টিচারেরা সবাই তা পছন্দ করেন। সবার উতসাহে এম ফিলে অনায়াসে ফার্স্ট ক্লাস পাই। তখন ঐ মার্কশিট নিয়ে গিয়ে জমা দিই আব্বার টেবিলে। আব্বা কোন প্রতিক্রিয়া দেখান না।
এরপর কমনওয়েল প্রতিযোগিতায় প্রবন্ধ পাঠাই। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে দেখালে উনি পড়ে বলেন, পাঠিয়ে দাও। সঙ্গে সুপারিশ পত্র দেন। বাংলাদেশ বেতারের সিনিয়র পরিচালক ও স্বাধীন বাংলা বেতারের মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান ফারুক উপহার দেন আরেকটা সুপারিশ পত্র। সারা বিশ্ব থেকে আসা প্রবন্ধ থেকে বাছাই করে ৮০০ জনের প্রবন্ধ নিয়ে শুরু হয় পরীক্ষা নিরীক্ষা। অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজের স্কলাররা ছিলেন পরীক্ষক। শেষ পর্যন্ত দশজন টিকে যায়; ঐ প্রতিযোগিতায়। ব্রিটিশ কুইন লন্ডনে নিয়ে গিয়ে ঐ দশজনকে পারসোনাল রিসেপশান দেন বাকিঙহাম প্যালেসে।
আব্বা তখনও আমার অনার্স মাস্টার্সের ফলাফলের “নেওয়াজ” -এর কথা ভুলতে পারেননি।
ডয়চেভেলেতে চলে যাওয়ায় শিক্ষক পিতা সেলিম আল দীনের অধীনে পিএইচডি অসমাপ্ত রয়ে যায়। ওয়ান-ইলেভেনের সুযোগে দেশে ফিরি থিসিস শেষ করতে; পোস্ট লিবারেশন ওয়ার ড্রামা; ফর্ম এন্ড কনটেন্ট। কিন্তু শিক্ষাগুরুর অকাল প্রয়াণের পর আর পিএইচডি করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিই। কারণ ঐ থিসিস ছিলো সেলিম আল দীনের সঙ্গে কাজ করে শেখার উপলক্ষ।
হতাশ মনে ইংরেজি গল্পগ্রন্থ লিখি; মঙ্গা ক্যারাভান। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে বইটা উপহার দিই; পরীক্ষার খাতা হিসেবে। মাসখানেক পরে টিএসসিতে এক বিতর্কের আসরে স্যার আমাকে দেখেই বলেন,এ প্লাস। শুরু করলে টেনে নিয়ে যায় তোমার গল্প; আর কী চাও। এর আগে মৃত্যুর শহর উপন্যাস নিয়ে একই নম্বর দিয়েছিলেন শিক্ষাগুরু অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, একবিংশ শতকের প্রথম আলোয়।
কিন্তু আব্বার মন পাওয়া যায়নি কিছুতেই। অবশেষে ২০১৬ সালে প্যাসেজ টু হেভেন; ইতিহাস ভিত্তিক রম্য উপন্যাস পড়ে আমাকে ফোন করে বলেন, হ্যা হয়েছে; কাজটা ভালো হয়েছে; আই এম প্রাউড অফ ইউ।
আব্বার এই পারফেকশনিস্ট শিক্ষক মানসের ঝড়ের মুখে আমার আত্মবিশ্বাসের বাতিটিকে জ্বেলে রেখেছিলেন, আমার আম্মা। আমার জীবনে আম্মা একমাত্র মানুষ; যিনি আমার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন। খাম-খেয়ালি-ডেসপারেডো টাইপের আচরণ টুকু বাদ দিলে পুরোটাই এপ্রুভ করেছেন তিনি।
আর আব্বা আমার মধ্যে ক্রোধ দেখে বিতর্কে দীক্ষা দেন নয় বছর বয়সে। বিতর্ক আমার মাঝ থেকে প্রতিশোধ স্পৃহা প্রশমিত করে ভালোবাসার ক্ষমতা জন্ম দিয়েছে।
মাসকাওয়াথ আহসান
সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ ও প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া