মাসকাওয়াথ আহসান
বাংলাদেশের রাজনীতিকরা বেশিরভাগই মনে করেন, রাজনীতি সম্পর্কে তারা সবচেয়ে বেশি জেনে ফেলেছেন; একই সমাজে ধর্মনীতিকরা মনে করা স্বাভাবিক যে তারা ধর্ম সম্পর্কে অনেক বেশি জেনে ফেলেছেন। আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলে; সিলেটের এক সহমত ভাই শাহাবুল এসে পট করে ইনবক্সে এসে গালি দেয়, আন্নে তো পাইক্কা দালাল। বিএনপির সমালোচনা করলে নোয়াখালির এক রহমত ভাই আশিক ইনবক্সে গালি দেয়, আন্নে তো রেন্ডিয়ার দালাল। দালালস্য দালালের বাচ্চাগুলো বংশানুক্রমিকভাবে দালালির অন্নে লালিত হয় বলে; ফট করে একটা কথা কইয়া দিতে পারে। ফইন্নি জানে শুধু মুখ চালাতে; মুখরোচক গালি দিতে।
ধর্মীয় কুসংস্কারের সমালোচনা করলে ইনবক্সে ধর্মনীতিক খোমেনি ভাই এসে গালি না দিয়ে বলে, হিজাবের সমালোচনা যে করেন; আপনি কী চান; মেয়েরা ব্রা-প্যান্টি পরে ঘুরুক!
বোঝা যায়; ইন্টারনেটের সুযোগে বিস্তর ব্রা-প্যান্টি পরা পশ্চিমা নারীর ভিডিও দেখার সুযোগ হয়েছে ধর্মনীতিকদের। হিজাব আর ব্রা-প্যান্টির মাঝামাঝি আর কোন পোশাকের সঙ্গে পরিচিত নন ভাইয়েরা আমার।
প্রথমত, নারীর পোশাক নিয়ে কথা বলার কেউ নই; পোশাক নারীর ফ্রিডম অফ চয়েস।
কিন্তু যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, মুখ ঢেকে একটা মেয়ে ক্লাসে আসছে; কে ক্লাস করছে; কে পরীক্ষা দিচ্ছে জানিনা; এরকম ছাত্রীর গ্রেডিং আমি পরীক্ষার খাতায় করবো না। করলে তা বে আইনি হবে।
আর জাতীয় পরিচয়পত্র না হলে; মানুষ পরিচয়হীন থাকে আজকের যুগে; মানব পাচারের ফাঁদে পরিচয়পত্রহীন মানুষেরাই বেশি পড়ে। মুখ ঢেকে কাকে বিমানে করে নিয়ে গিয়ে মুম্বাই কিংবা দুবাইয়ে দেহ ব্যবসায় লাগিয়ে দিচ্ছে ঠগীর দল; তার ইয়ত্তা নাই।
ইসলামের কেন্দ্র তো সৌদি আরব ও তুরস্ক। সেখানে সরজমিন ঘুরে যে ইসলামের দেখা পেয়েছি; আমি তার ভক্ত হয়ে গেছি। জীবনে প্রথম মুসলমান হিসেবে গর্ব অনুভব করেছি; যেখানে এতো সুরেলা আজান; এতো পণ্ডিত ইমাম সাহেব, যেখানে মসজিদে শিশুরা নামাজের আগে ও পরের সময়টাতে কলকাকলী করে; সেই শিশু স্বর্গই তো প্রার্থনার স্থান হওয়া উচিত।
অনুন্নত দেশে বড় হওয়ায়; ইমাম সাহেবের ধমক; ওয়াজ মেহেফিলের বক্তার মুখে দোজখের ভয় দেখে; অতি নারী পর্দার বাড়াবাড়িতে নারীর সঙ্গে কথা বলা বা তাদের দিকে তাকানোই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কীসে কোনটা আনইসলামিক হয়ে যায়; শত হস্ত দূরে থেকেছি রাগী ইমাম; ক্ষ্যাপাটে ওয়াজকারী আর লৌহ-পর্দায় ঢাকা অতি-ধার্মিক নারী থেকে। যেমন দূরে থেকেছি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লাল চোখ দেশের মালিক দেহভঙ্গির দেশপ্রেমের ম্যানেজারগুলোর কাছ থেকে।
সৌদি-আরব, তুরস্ক ঘুরে ভালোবেসেছি ইসলামকে আরেকবার; জার্মানি ঘুরে রাজনীতিকে ভালোবেসেছি আরেকবার।
এবার বাংলাদেশে ধর্মের বাড়াবাড়ির কিছু কারণ চিহ্নিত করতে চাই; কারণ রাজনীতির বাড়াবাড়ির কারণ ও ফলাফল নিয়ে নিয়মিত লিখি।
১ বাংলাদেশের শ্রমিক ভাইয়েরা মধ্যপ্রাচ্যে কঠোর পরিশ্রম করে দেশটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। উনারা শ্রমিক শ্রেণীর হওয়ায়; সৌদি আরব বা তুরস্কের মূল-ধারার মানুষের সঙ্গে সামাজিকতার সুযোগ সীমিত। আরবী ও ইংরেজি দুটো ভাষাতে যথাযথ দক্ষতা না থাকায় মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের জানা হয় কম। সৌদি সমাজের কারখানার সুপার ভাইজার পর্যায়ের লোককে দেখে সৌদি সংস্কৃতি সম্পর্কে যে ভাসা ভাসা জ্ঞান তারা লাভ করেন; ঐ জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই তারা দেশে ফিরে “সৌদি সংস্কৃতি!” প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফলে সৌদি আরবের নিম্ন আয়ের মানুষের অনুশীলিত লৌহ-ইসলাম তারা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।
২ সৌদি আরব সম্পর্কে বাংলাদেশ ও ভারতের কথিত পোগোতিচিলদের ধারণাও একইরকম। ফলে বাংলাদেশ ও ভারত মিডিয়ায় ইসলামকে তুলে ধরা হয়; আদিম গুহার এক ধর্ম হিসেবে। আর নিম্নবর্গ থেকে শিক্ষিত হয়ে প্রথম প্রজন্মের জিনস-টিশার্ট পরা ছেলেরা ফেসবুকে “ইসলামকে গালাগাল”-কেই পোগোতিচিলতার পরিচয় বলে মনে করে।
৩ বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির মুনতাসির ফ্যান্টাসির লোকেরা ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য শুধু পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে দায়ী না করে; পাকিস্তানের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে যুদ্ধাপরাধীদের তকমা দিয়েছেন। নিজেরা তথ্য সংগ্রহে গিয়ে মিশেছে; তাদের মতোই অর্ধ-শিক্ষিত উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে। একই ধরণের লোক একই ধরণের লোককে আকর্ষণ করে। তারা ঢাকায় ফিরে পাকিস্তানকে তুলে ধরেছে “মধ্য যুগীয় বর্বর” দেশ হিসেবে। আমি পাকিস্তানে শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা করতে এসে দেখি; শহুরে সমাজ অনেক আগে থেকেই উদারনৈতিক, কবিতা ও সংগীত প্রিয়, নিয়মিত থিয়েটার-চলচ্চিত্র-ফ্যাশান শো-স্ট্যান্ড আপ কমেডিতে ঠাসা জনজীবন। নারীদের পোশাক স্বাভাবিক; কেউ পাশ্চাত্যের পোশাক পরে; কেউ বা প্রাচ্যের। যারা হিজাব পরে তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বা কোন অনুষ্ঠানে এসে (চেঞ্জ রুমে হিজাব খুলে) দেশীয় পোশাক পরে সামাজিকতা করে। জন পরিসরে মুখ ঢাকা হিজাবের নারী আমি দেখিনি। গ্রামাঞ্চলে কিছু থাকলেও; তারাও পথে-ঘাটে মুখ ঢেকে চলে। কিন্তু উতসবে আয়োজনে খুব স্বাভাবিক তারা। পাকিস্তানে জাতীয় সনদ পত্র প্রদান বেশ আগে থেকে করা হয়। সেখানে ছবি তুলে এই সনদ গ্রহণ বাধ্যতামূলক।
৪ ভারতে হিন্দুত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর; বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতি কর্মীদের ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রয়োজনে মানসিকভাবে বিজেপিতে যোগ দিতে হয়। বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে তারা হাজির করে মধ্যযুগের হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক পরিসরে কলকাতার ট্রাম-বাসের মাজন বিক্রেতার মতো চকরা বকরা পাঞ্জাবি, বিজেপি দাদার মতো কপালে লাল তিলকের যে গ্রাম্য পোশাক ও চেহারা; ঐটি ঢাকায় হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে পরিবেশিত হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অষ্টাদশ শতকের নারীর বর্ণনা লিখে গেছেন তাঁর সাহিত্যে। কলকাতার একটি মেয়েও সে পোশাক পরে না এই একবিংশে। বেঙ্গল রেনেসাঁ আর পাশ্চাত্যের সম্মিলনে নারীর এক ওরিয়েন্টাল-অক্সিডেন্টাল অবয়ব তৈরি হয়েছে। কেবল বিজেপির অনগ্রসর শ্রেণী থেকে আসা নারীরাই সেই পৌরাণিক যুগের পোশাক-কপালে বড় লাল তিলক পরে ঘুরে। কপালের লাল তিলক আর হাতের কব্জিতে লাল-হলুদ মেশানো সুতোর ব্যান্ড বিজেপির চিহ্ন। জার্মানির নাতসিদের এমন চিহ্ন ছিলো। ঢাকায় হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে বিজেপি সংস্কৃতি ঢেলে দিলে; আত্মপরিচয় ও মানসিক সার্বভৌমত্বের প্রয়োজনে ইসলামি চিহ্নের পোশাক পরে সাধারণ নারী পুরুষ।
৫ বাংলাদেশ কোমল ইসলামের দেশ। পীর আউলিয়া ও সুফিদের প্রচারিত ইসলামে “ওহাবি” বা “নাতসি” কর্কশ ইসলামের জায়গা নেই। বাংলাদেশের নদী মানুষ, সুরের মানুষ, সবুজ ব-দ্বীপের মানুষ কখনোই বেদুইনের মতো মরুভূমির রুক্ষতায় গড়ে ওঠা মননকে গ্রহণ করতে পারে না। ফলে বাংলাদেশের আজকের ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি আসলে ভারতে বিজেপির ধর্মের নামে বাড়াবাড়ির প্রতিক্রিয়া। রাজনীতিকরা কে কখন কোথায় শুধু নিজের মসনদ টিকিয়ে রাখতে আত্মসমর্পণ করছে হিন্দুত্ববাদী মোদী-অমিত শাহ-জয় শংকর-দোভালের কাছে; পাকিস্তান উপনিবেশের শৃংখল ছেঁড়া মুক্তিকামী মানুষ আবার ভারত উপনিবেশের অধীনে খেলনা স্বাধীনতা নিয়ে নিজভূমে পরবাসী হয়ে বেঁচে আছে কীনা! এই আশংকায় “ইসলামই” এখন সাধারণ মানুষের আত্মপরিচয়ের ও বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্রয়।
৬ যে বাংলাদেশে গত দুই দশকে রাজনীতি ব্যবসায় দেশের সম্পদ লুন্ঠন করে দ্রুত কোটিপতি হয়েছে থাগস অফ বেঙ্গল। ক্রসফায়ার-ডিজিটাল-সিকিউরিটি এক্ট-নির্বাচনের সুচিন্তা মডেলে ভোটের অধিকার হীনতা-হেলমেট হাতুড়ি নিয়ে মানুষকে মারতে উদ্যত বিজেপি মিশ্রিত সহব্রতদা চারিদিকে চোখ লাল করে ঘুরছে; কোটাল পুত্রদের গ্রেফতার-গুম-আয়নাঘরের নির্যাতনে “একাত্তরের ভয়াল দিনগুলি” কিংবা “ফ্রিজে গরুর মাংস থাকলে পিটিয়ে মারার গুজরাটের কসাইয়ের দিনগুলিতে” অবরুদ্ধ এইসব ভীতিপ্রদ কষ্টে সৃষ্টে বেঁচে থাকা। এই হিন্দুত্ববাদী উপনিবেশের ফ্যাসিস্ট স্বদেশী জায়গীরদার সরকারের ভয়ের অপ-সংস্কৃতিতে আতংকিত উপায়হীন মানুষের আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই; যে তাকে বাঁচাতে পারে স্বদেশী উপনিবেশের রাক্ষসের হাত থেকে। চারপাশে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আল্লা আল্লা; আসলে কেবলি বাঁচার আকুতি।
(ছবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোদীর ঢাকা সফরের প্রতিবাদ বিক্ষোভে ছাত্রলীগের (হাতে বিজেপির ব্যান্ড) হামলা)
মাসকাওয়াথ আহসান
সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া