লুৎফুল কবির রনি
আমিই সুমন- জয় গোস্বামী
সুমন ‘তোমাকে চাই’ বলে লুট করে নিয়ে গেছে
তোমাকে, আমার কিছু করবার ছিল না তখন
আজ এই কাব্য নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তোমার
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই সুমন।
বাঙালি কৈশোরে জয় গোস্বামীর মতো এমন করেই ভাবতে শেখে কবির সুমনকে নিয়ে।
রোজকার জীবনযাত্রা, অচেতন মনের চিন্তাধারা, নগর জীবনের বাস্তবতা আর এর সাথে জড়ানো অনুভূতিগুলো বিস্ময়কর এক দ্যুতি নিয়ে ফুটে ওঠে সুমনে গানে। অনেকে তাকে ডাকেন ‘নাগরিক কবিয়াল’। অনেকে তার গানকে বলেন ‘জীবনমুখী’। এত শত বিশেষণে আগ্রহ নেই সুমনের। তার কাছে তার গান হলো শুধুই আধুনিক বাংলা গান। তার গানের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো প্রেম। প্রেমকে তিনি বরাবর উপস্থাপন করেছেন কোনো তরুণের সেই প্রথম শিহরণের সাথে, ফুটিয়ে তুলেছেন সেই চিরন্তন আকাঙ্খা, চিরকালের বাসনা, লজ্জাহীন আকুতি আর ব্যার্থতার দীর্ঘশ্বাস; যার ফলে তার গানে প্রেমানুভূতি হয়েছে আরও শক্তিশালী, আরও বাস্তব, আরও সুন্দর আর কালজয়ী।
“হাত থেকে হাতে বুক থেকে বুকে করে দেব গোপনে পাচার, ভালোবাসার নিষিদ্ধ ইস্তেহার…ভালোবাসার নিষিদ্ধ ইস্তেহার
”“যতবার তুমি জননী হয়েছো, ততবার আমি পিতা,
কত সন্তান জ্বালালো প্রেয়সী তোমার আমার চিতা।
বারবার আসি আমরা দু’জন, বারবার ফিরে যাই,
আবার আসবো, আবার বলবো- শুধু তোমাকেই চাই।”
শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন গিটার হাতে বুকে গেঁথে দিয়েছেন যে গেরিলা, স্বপ্নমানবীকে পাওয়ার বাসনা সুরে একেঁছেন যে প্রেমিক, ধর্ষিত নারীর বেদনা বুকে যিনি পুরুষ জন্মের জন্য লজ্জিত হন,গিটার হাতে এক গেরিলার নাম, আমার বোধ সুরে যে বুকে বসিয়ে দিয়েছেন।
প্রেম তার কাছে সঙ্গীতের আলাদা আলাদা রাগের মতো। তিনি আরও বলেন, “আমার প্রিয়তমা শুধু আমার নাম ধরে সুমন, সুমন… বলে ডাকছে, এটা শুনতে শুনতেই আমি মরে যেতে পারি। অল্প বয়সে আমরা প্রেমে গন্তব্য খুঁজি, এখন আমি জানি যে মৃত্যুই শুধু সেই গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে।” কতটা সূক্ষ্ম, কতটা গভীর তার জীবনবোধ, শুধু এ কথাটি থেকেই বুঝা যায়।
প্রিয় কবির সুমন, গানগুলোতো নেহাত গান নয়-একেকটা শপথ। মানুষের স্বাধীন হবার , বিপ্লবের রাস্তায় নেমে একটু বৃষ্টিতে ভেজার মত রোমান্টিক হওয়ার শপথ। আপনার ‘ঘুমাও বাউন্ডুলে’ কী অদ্ভুত মমতা নিয়ে ঝড় তোলে আমাদের হৃদয়ে।
কিম্বা আপনার ‘অভিবাদন’ গানটি। এ বাংলার অভিমানি কবি শহীদ কাদরির কবিতাটি এমন করে গাইলেন যেনো মনে হলো মৃত্যুর আগে হলেও ‘মানবজনমের’ এই সমাজ আমরা আনবোই।
আপনার ‘তোমাকে চাই’ নিয়ে কথা বলবো না। কারণ একটি গান কিভাবে বৃষ্টির মত, প্লাবনের মত, ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়লো। সে কী মিউজিক! সে কী বন্দনা। এমন গানও হয়। এই গান থাকুক আমার ভেতর গোপন প্রেমের মত, গোপন কষ্টের মত-যেমন আপনি ছিলেন গিটারের গেরিলা।
কবীর সুমন গেয়েছেন “একটুর জন্য কত কিছু হয় নি, ক্ষয়ে যাওয়া আশা তবু পুরটা ফুরায় নি”।
আমাদের কাজটি কেনো জানি “বুকের ভিতর যত কথা আছে সব ব্যাকারণ ভুলে” গিয়ে শুরু হয়ে আর এগোয় না, তারপরও ক্ষয়ে যাওয়া আশাটা পুরপুরি ফুরায় না। তাঁর গান যতবার শুনি ততবারই না-পারার এ অক্ষমতা আমাদেরকে ভীষণ যন্ত্রনা দেয়।
“যত দূরে, দূরে, দূরে যাবে বন্ধু /
একই যন্ত্রণা পাবে, একই ব্যথা ডেকে যাবে,
নেভা নেভা আলো যতো বার জ্বালো,
ঝড়ো হাওয়া লেগে তার শিখা নিভে যাবে।”
ক্ষয়ে যাওয়া আশাটাকে সম্বল করে আবার হাল ধরে বসি, আবার আলো জ্বালে, আমাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার ঝড়ো হাওয়া লেগে বারবার তার শিখা নিভে যায়। তারপরও হাল ছাড়ি না। যিনি গেয়েছেন “হাল ছেড়ো না বন্ধু…”
কবীর সুমন হচ্ছেন সেই বাঙালি যাঁর মধ্যে মিশে আছে ধ্রুপদী সেকাল, মৌলিক একাল।
তোমার ভুল, ভ্রান্তিকে ধরে নিয়ে আমি তোমাকে অস্বীকার করতে যেয়ে দেখি নিজেকেই অস্বীকার করছি।
ভালবাসি তোমায় নাগরিক কবিয়াল, শুভ জন্মদিন।আমার কৈশোর তোমার কাছে ঋণী, এই যে বেড়ে ওঠা তাও অমলিন তুমি।
সত্তরের যুবক মন খারাপগুলো ত তোমারই নাম জপে
“রাস্তায় পড়ে আছে স্বপ্নের লাশ
বাতাসে লুকোনো তার দীর্ঘশ্বাস
খুন হওয়া স্বপ্নের চোখ ঢেকে দেওয়া চাই-
বিদায় পরিচিতা, আকাশ বিষণ্ন, তার কাছে যাই…”
কবির সুমন আমার মন খারাপ করা কৈশোর,প্রেমময় যৌবনের সাথী।
শুভ জন্মদিন গানওয়ালা।
জয় গোস্বামীর কথাটা দিয়েই শেষ করছি “যে দেশে সব গানপাগলা চল সে দেশে যাই/গীটারকে একতারা করে গাইছে সুমন সাঁই”..
লুৎফুল কবির রনিঃ লেখক, আর্ট ক্রিটিক