কাকন রেজা : যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা আমার কাছে বরাবরই লোমহর্ষক। আরে, লোমহর্ষক মানেই বীভৎস সবসময় এমন উল্টো বোঝার অবকাশ নেই। এর আরেক অর্থ রোমাঞ্চকর। ট্রাম্প বাবু বরাবরই রোমাঞ্চ প্রিয়। তিনি ক্ষমতা ছাড়ার আগে একুশ বছর হলেই যুক্তরাষ্ট্রের যে কেউ অস্ত্র রাখতে পারবে এমন আইন করে যান। তার বন্দুক নীতি’র ফলেই যুক্তরাষ্ট্রে স্কুল-কলেজে এখন ফুলের বদলে গুলি ফুটছে, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
ট্রাম্প বাবু রোমাঞ্চ প্রিয় বলেই তার কাছে পুতুপুতু প্রেমে ফুল ছোড়ার চেয়ে গুলি ছোড়াতেই আনন্দ বেশি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই লোমহর্ষক আনন্দে অবশ্য কোনোই আপত্তি ছিলো না, যদি একটার পর একটা বন্দুক হামলার ঘটনা না ঘটতো। যুক্তরাষ্ট্রে এখন সবচেয়ে বড় আতঙ্কের বিষয় হলো হঠাৎ করেই গুলিবর্ষণের ঘটনা। না, এমন ঘটনা আগেও ছিলো। কিন্তু ট্রাম্পের নীতির কারণে তা বেড়ে গেছে অনেকটাই।
সুতরাং যারা ট্রাম্পের সমর্থনে বলবেন, ‘আগেও তো গুলির ঘটনা ঘটেছে’, তারা সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ার নীতি অনুসরণ করেন। যেখানে কোনো কিছু ঘটলেই একদল সাফাই গাইতে থাকেন, ‘আগেও তো এমনটা হয়েছে’ বলে। না, ট্রাম্প নিয়ে লেখার কথা আমার নয়। আদার বেপারির জাহাজের খবরের কী দরকার। কিন্তু জাহাজের খবরটা দরকার হয়ে দাঁড়ায় সঙ্গত কিছু কারণে। সে আলাপে যাবার আগে ট্রাম্প বাবুকে উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমের শিরোনামটা দেখি। উনি বললেন, ‘ইউক্রেন পরে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আগে দেশের স্কুলের নিরাপত্তায় অর্থায়ন’। একেই সম্ভবত বলে, গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালা। পানি ঢালার বিষয়টা যে কতটাই নির্লজ্জ তা বুঝতে পারবেন তিনি কোথায় এবং কী উপলক্ষে এমন কথা বলেছেন জেনে।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্কুলে গুলিতে এগারো জন নিহত হওয়ার ঘটনায় যখন দেশটির মানুষ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে, ফুঁসে উঠেছে তারা এমন নৃশংসতার বিরুদ্ধে। ঠিক তখনই ট্রাম্প বাবু এমন বাণী উদগীরণ করেছেন আগ্নেয়াস্ত্রের পক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে। অনেকটা আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ধারা অনুসরণ করছেন ট্রাম্প। দক্ষিণ এশিয়ায় যেখানে আক্রমনকারীরাই উল্টো আক্রান্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আক্রমনের। আক্রান্তরা নিরাপত্তা পাবার বদলে উল্টো রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিপীড়নের শিকার হয়। নিজে আগ্নেয়াস্ত্র সহজলভ্য করে দিলেন। একুশ হলেই আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে পারবে এমন আইন করলেন। সেই আগ্নেয়াস্ত্র রাখার পক্ষে থাকা কিছু মানুষের লোমহর্ষক সমাবেশেই তিনি বক্তব্য রাখলেন, স্কুলের নিরাপত্তার জন্য অর্থ বরাদ্দের।
এইরকম প্যারাসিটামল মার্কা সরকার প্রধান সবদেশের জন্যই ভয়াবহ। ভাগ্যিস তিনি সাবেক। প্যারাসিটামল বিষয়টা খুলে বলি। জ্বর অসুখের উপসর্গ আর এ উপসর্গ কমাতেই প্যারাসিটামল দেয়া হয়। প্যারাসিটামল অসুখ সারানোর ওষুধ নয়। ট্রাম্প বাবু নিজে অসুখ সৃষ্টি কিংবা জটিল করার পর এখন নিরাপত্তা বিষয়ে সেই প্যারাসিটামল চিকিৎসাই দিচ্ছেন। মূল চিকিৎসা এমন শাসকেরা দিতে চান না। কারণ তারা জানেন মূল অসুখটাই তারা, ওষুধ দিলে অন্য কেউ না হলেও তারা নির্মূল হবেন নিশ্চিত।
দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থাও তাই। অসুখ সৃষ্টি বা বৃদ্ধি করার জন্য যারা দায়ী তারাই আবার অসুখ সারানোর চিকিৎসা বাতলাচ্ছেন এবং সে চিকিৎসা নিঃসন্দেহে হাতুড়ে এবং প্যারাসিটামল ধরণের। যাতে রোগীর সর্বশেষ অবস্থান হয় আইসিইউতে। যেমন শ্রীলঙ্কা। একটি দেশের দেউলিয়া হয়ে যাওয়া মানেই সে দেশের অবস্থা আইসিইউকালীন। যেখানের শাসকরা ক্ষমতা ধরে রাখতে দিয়েছিলেন প্যারাসিটামল চিকিৎসা। যার ব্যাকফায়ারে আজকে শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা।
ট্রাম্প বাবু বলেছেন, ‘অস্ত্র হাতে একজন মন্দ লোককে থামানোর একমাত্র পথ হচ্ছে—অস্ত্র হাতে একজন ভালো মানুষ থাকা’। এমন কথা বলেন এক্সট্রিমিস্টরা। সে হতে পারে ধর্মীয় এক্সট্রিমিস্ট কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ড বাম। তবে প্রকাশ্যেই এমন অনেকে আছেন, যাদের মন ও মগজে প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ ঠাসা থাকে। সেই প্রতিহিংসা কখনো ‘স্লিপ অব টাং’ হয়ে যায়। কথা একটাই, খুনের বদলা খুন। প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার নীতি। এই নীতির অনুসারীরা তাদের সব অপকর্মকে অতীত দিয়ে ঢেকে দিতে চান। সবকিছু সরলীকরণ করতে চান।
আগের অপরাধের ঢিবি দিয়ে হাল অপরাধের পাহাড়কে তুলনা করতে চান। আর এই তুলনায় যোগ দেন কিছু সহমত ভাই-বেরাদর। বাঘের সাথে ফেউয়ের মতন। ট্রাম্প বাবুও আগ্নেয়াস্ত্রের পক্ষে এমন সহমত ভাইদের সমাবেশে সে কথা বলেছেন। বলেছেন, সাথে আগ্নেয়াস্ত্র রাখুন আর সরকার সেই আগ্নেয়াস্ত্র থেকে বাঁচাতে নিরাপত্তা বাড়ান। আজব! চোরকে বলেন চুরি করো, সাধুকে বলেন সজাগ থাকো, আর কী। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের দক্ষিণ এশিয়াতেও এমন নটঙ্কির অভাব নেই।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।