কাকন রেজা
আজ পাঁচ বছর পুরো হলো ফাগুন রেজা হত্যাকাণ্ডের। বলতে পারেন বিচারহীনতার ষাটটি মাস। না, তেমন কোনো অনভূতি কাজ করছে না, আশাও জাগছে না আপাতত যে বিচার পাবো। পিতা হিসেবে শুধু একটা শূন্যতা বয়ে বেড়াচ্ছি। যাতনা বয়ে বেড়াচ্ছি। যে যাতনার সাথে কোনো কষ্ট ও ব্যথার তুলনা হয় না। যারা সন্তানহারা হয়েছেন তারাই শুধু বুঝতে পারবেন এ যাতনার কথা। অন্যরা কল্পনাতেও আনতে পারবে না।
বাদ দিন সন্তানহারা পিতার যন্ত্রণার কথা। আমার মতন অনেক পিতাই রয়েছেন যারা সন্তান হত্যার বিচার পাননি। কিন্তু এমন পিতা কেউ আছেন কিনা জানা নেই, যিনি নিজে গণমাধ্যমে আছেন, তার নিহত সন্তানও গণমাধ্যমে ছিলো এবং সেই সন্তানের হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত। এই যে গণমাধ্যমকে এত শক্তিশালী বলা হয়, বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সেই স্তম্ভ যে ভেঙে পড়েছে তাকি গণমাধ্যমের লোকজন দেখতে পাচ্ছেন না। গণমাধ্যমকর্মীদের মার খেতে হচ্ছে যার-তার হাতে। প্রাণ দিতে হচ্ছে। তারপরও হুশ হচ্ছে না গণমাধ্যমের মাথায় জেঁকে বসা কর্তাদের। আর হুশ হবেই কীভাবে, হাজার টাকার বেতন পেয়ে যখন কোটি টাকা দামের গাড়িতে চড়া যায়। ফ্ল্যাট-বাড়ি সব হয়, তখন হুশের চেয়ে জোশটা বেশি জাগে।
হ্যাঁ, আত্মসমালোচনাই করছি। অন্যেরটা করতে গেলে আবার কারো অনভূতি আহত হতে পারে, তাই নিজেদেরটাই করি। কারণ গলদ নিজেদের ভেতরেই। ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, যাকে সবাই ফাগুন রেজা নামে চিনতো, জানতো। যে গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগের সাব-এডিটর ছিলো। শুধু তাই নয়, রিপোর্টিংও করতো সে। আর সেটাই তার কাল হয়েছিলো। কারণ সে জানতো, সাংবাদিকতার মূল কথা হচ্ছে অ্যাস্টাব্লিশমেন্টকে চ্যালেঞ্জ করা। ক্ষমতাকেন্দ্রকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা। তাই করতে চেয়েছিলো সে। যে চেষ্টাটা আমি করে আসছি। এই করে আসাটাই কারো কারো গাত্রদাহের কারণ হয়েছিলো। আর সে কারণেই ফাগুনকে প্রথমে গুম, তারপর হত্যা করা হয়। আর সেই গুম আর হত্যাকাণ্ড ঢাকতে তার শরীর রেললাইনের পাশে ফেলে রাখা হয়।
রেলপথ হলো হত্যাকাণ্ডের নিশানা ঢাকার এক নিরাপদ স্থান। বিগত দিনে রেললাইনে যতগুলো লাশ পাওয়া গেছে, তার বেশিরভাগই অপমৃত্যু বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। ফাগুনেরটাও তাই করার চেষ্টা হয়েছিলো। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের পূর্ব মুহূর্তে ফাগুনের দেহ উদ্ধার করা হয়। এখানে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো রেলপুলিশ মৃতদেহ দাফনের আগে তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য আঙুলের ছাপ সংগ্রহের চেষ্টাটাও করেনি। ফাগুনকে যারা হত্যা করেছিলো, তারা ফাগুনের পরিচয় যাতে নিশ্চিত করা না যায় সে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি। তার মানিব্যাগ, আইডি কার্ড, ভিজিটিং কার্ডসহ সকল পরিচয় নিশ্চিত করার চিহ্ন মুছে ফেলেছিলো। এরপর নিশ্চয়ই আর প্রশ্ন থাকে না যে, হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত নয়। রেলপুলিশের কাছ থেকে ফাগুন হত্যা মামলা পুলিশ বিউরো অব ইনভেস্টিগেশন অর্থাৎ পিবিআইয়ে যাবার পর একজন অভিযুক্ত খুনির স্বীকারোক্তিতে হত্যাকাণ্ডের কথা প্রমাণিত হয়ে হয়েছে। অথচ এই স্বীকারোক্তি নিতে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে পিবিআইকে। তবে পিবিআইয়ের সাফল্য এপর্যন্তই। এরপর আর এগুতে পারেনি তারা। কেন পারেনি তারও হয়তো কারণ রয়েছে এবং সে কারণও হয়তো সময় আসলে বলা যাবে।
যারা ভুলে গেছেন তাদের মনে করিয়ে দিই ‘ডয়চে ভেলে’র খবরের শিরোনাম। ‘ডয়চে ভেলে’ ফাগুন হত্যাকাণ্ডর পর লিখলো, ‘সংবাদ প্রকাশের কারণেই কি খুন হলেন ফাগুন?’ দেশি-বিদেশি অনেক গণমাধ্যম, এনটিভি’র ক্রাইম ওয়াচ, অন্যান্য টেলিভিশনে ফাগুন হত্যার খবর এসেছিলো গুরুত্ব সহকারে। সহকর্মীরা ফাগুন হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে জাতীয় প্রেসক্লাবসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবাদে আসলে কি কিছু হয়? হয় না। হলে গুম হওয়া সন্তানের ছবি গলায় ঝুলিয়ে মা-বাবাদের রাস্তায় দাঁড়াতে হতো না দিনের পর দিন। হত্যাকাণ্ডের শিকার সন্তানের ছবি ঝুলিয়ে বিচার চাইতো হতো না প্রেসক্লাবের সামনে। যে প্রেসক্লাব নিজের লোকের বিচার নিশ্চিত করতে পারে না, সেই প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়েই বা কী লাভ?
আজ পাঁচ বছর পরেও ফাগুনের ঘরটা তেমনি আছে। পিতা হিসেবে যখন সে ঘরে যাই তখন কেমন লাগে, সেই অনভূতির কথা বোঝার ক্ষমতা কারো নেই। সে কারণেই ইদানিং মনে হয় যারা চোখ-কান বন্ধ করে থাকেন, তাদেরও যেন আশীবিষে দংশন করে। অনুচিত হলেও মনে হয়, না হলে সে বিষের যাতনা বোঝার ক্ষমতা তাদের কখনোই হবে না।
কাকন রেজা, সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট