মাশুক আল হোসাইনঃ
চারণ কবিদের চারণভূমি হলো সহজিয়া মর্ত্যলোক, দূর্জ্ঞেয় অমর্ত্যলোক, নিত্যকার বিশ্বলোক, অন্তর্লোকের হাহাকার, শূন্যতাবোধের খা খা শূন্যলোক, হৃদয়লোকের বেদনাবোধ এবং প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সুখ-দুঃখ।
শুধু এসব বলেই সরাসরি তাদের বিচরণভূমিকে নির্দিষ্টকরন শ্রেয় নয় বটে।
তাদের সৃজনপ্রক্রিয়ার ভেতরে বহুতর চারণক্ষেত্রের সন্ধান সহজেই মিলতে পারে।চারণকবিদের সৃষ্টিশীলতায় অবদান রাখে কখনও মেঘমল্লার রাগে বিধৌত বৃষ্টিমুখর দিন, মেঘডম্বরু-বাজা আকাশ,স্তেপভূমির অনাবিল প্রসার, বাংলার প্রান্তর, নদীমেখলা দেশমাতৃকা, বিশ্বলোকের কিরনপ্রাপ্ত ঝলমলে প্রকৃতি, পাহাড়, সাগর ও উর্ধ্বলোক।
অধিকন্ত, অধ্যাত্মবোধ, নির্বিকার নিরাকার মহাপ্রভুর বয়ানে ও অংকনে রহস্যঘেরা এ-পৃথিবী, তারই দয়ায় জীবনযাপনের অবগাহন, এবং তাতে কৃতজ্ঞতাবোধ, বিস্ময়বোধ, চারন কবিমনের অন্তর্লোক, মনোরাজ্যের কল্পনার আকাশ এবং সর্বোপরি ব্যাখ্যাতীত আরো কিছুর প্রভাব, যা রয়েছে তাদের রচনায় ও ভাবসম্পদে তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।
কী করে এইসব ঘটে যায় চারণকবির হৃদয়ে? কেন তার রচনায় এসব ধরা পড়ে?এসকল প্রশ্নের মীমাংসা হয়ত হয়েই আছে, কিংবা ভিন্নার্থে তা হবারও নয়, এমন কথাও কেউ কেউ বলে উঠতে পারেন এ যুক্তিতে যে, শিল্পসৃষ্টির রহস্য কখনও উন্মোচনযোগ্য নয়! তবুও সাধারনভাবে, তাদের এ রচনার পেছনে কিছু দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রভাব সনাক্ত করা যায় এবং যেসব দৃষ্টিগ্রাহ্য নয় সেসব বিষয়ে প্রচলিত অনুমান ও ধারনার প্রশ্রয় নেয়া যায়।
যেমন; জন্ম-মৃত্যুর লৌকিক-অলৌকিক রহস্য এবং তা ঘটনের আন্দোলনে চারন কবির মন ও ঘর-বাহির উতলা হওয়া, সৃষ্টিরহস্যের গুপ্ত বিষয়াদির তল না পাওয়া, বা আধ্যাত্মিক ভাবে আচ্ছাদিত হওয়া যা তাদের মনোজগতকে ছেয়ে ফেলে বহুবর্নিল মহিমায়। এ অমোঘ বিষয়াদি নিয়েই পরম্পরাব্যাপী চারন কবিদের যে সহজিয়া রচনা অব্যাহত আছে তা আজ সহস্র বছর পরেও অমলিন।
এমনিতরো বিষয় যেমন: সামাজিক ঘটনা, বাদ-বিসম্বাদ, বিশ্বকর্মার সৃষ্টিরহস্য, প্রকৃতির দোলাচল, মানবীয় সুখ-দুঃখ, বন্চনা-লান্ছনা, জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধির অনুরনন, যুদ্ধ, শান্তি-অশান্তি ইত্যাদি সবকিছুর থেকেই চারনকবিদের রচনায় প্রতিভাত হয়ে চলেছে আনন্দ-বেদনার শৈল্পিক উৎসার! এবং বিস্ময়করভাবে সে প্রকাশ অত্যন্ত সহজিয়া! চারনগীতি, জারি, সারি, মারফতি, পদরচনা, শ্লোক ইত্যাদির অনাড়ম্বর সহজিয়া পরিবেশনের পেছনে চারন কবিদের যেধরনের জীবনাচারনের অবদান আছে তা-ও সহজ, স্বাভাবিক, স্বচ্ছন্দ।বস্তুতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার চাকচিক্য, আড়ম্বর, ধনসম্পদের প্রতি আকর্ষন, কিছুই তাদের আকৃষ্ট করেনা। এসব তারা খুব সহজেই এড়িয়ে যেতে পারে।
এমনকি তুমুল উচ্চশিক্ষা, পান্ডিত্বপূর্ন বিদগ্ধতা অর্জনের লক্ষে পঠন-পাঠনে মগ্ন হওয়ার প্রয়াসও তারা সচেতনভাবে এড়িয়ে যায়।বিশ্ববীক্ষা, অন্তর্যামীকে উপলব্ধি করা, নিখিল বিশ্বলোকের রহস্য ও কার্যকারনের পাঠ ইত্যাদি তাদের বড় টানে এবং তারা হন নিত্যদিনের বিশ্বালয়ের ছাত্র।তাদের কারো কারো বিদ্যা হলো গুরুমুখী।একধরনের মানসিক সন্ন্যাস ও তপস্যারও অবদান আছে তাদের মানসিক গড়নে ও দর্শনে। সে কারনে তাদের রচনা আপাতঃ পুস্করিনীর মত অগভীর মনে হলেও নিবিড় পাঠে ও উপলব্ধিতে জ্ঞানী পাঠকও তাতে সমুদ্রের গভীরতা পায়।সহজিয়া শিক্ষায়, অভিজ্ঞতায়, উপলব্ধিতে, ধীশক্তিতে তাদেরও রচনায় উঠে আসে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতাসূচক মধুর প্রেমোক্তি, শ্লেষোক্তি।
এমনকি তাদের রচনায় বক্রোক্তি, কটুক্তি, কৌতুক, উপস্থিতবুদ্ধির ঝলক, বিদ্যুতচমকের মত পাঠক-শ্রোতার আকাশ ভরিয়ে দেয়।জীবনজগতের জিজ্ঞাসা, তার সম্ভাব্য জবাব, তা না পেয়ে অভিমান, হতাশা ইত্যাদির অপরূপ অভিব্যক্তি তারা পেশ করেন পাঠকের সমীপে যা অমর, অক্ষয় হয়ে যায়!এসব কারনেই হয়তবা লোকালয়ে তাদের মর্যাদা বৃক্ষে উপবিষ্ট পাখির মত – যেন সে সমাজের হয়ে কথা বলে পাখি সেজে, নদী যেন সে; কলকলিয়ে বলে যায় সামাজিক ঘটনাপ্রবাহের বয়ান, তার মেঠো পথ ধরে হেঁটে যাওয়া যেন মাঠের গল্প, সে জ্যোৎস্না, চাঁদ, মেঘ, আকাশ আর সুখ-দুঃখের মত সমাজে হাজির যেন নিত্য দিন!
এই চারণ কবিকেই যদি একটু হাঁটিয়ে পল্লীর মেঠো পথ থেকে নগরের উপকন্ঠে হাজির করা যায়, নির্ঘাত সে মানসিকভাব বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
তার পরিচিত জগত তখন অনভ্যস্ত নাগরিক জীবনের ক্লেদ, ক্লান্তি ও কাঠিন্যের চাপে হতবিহ্বল হয়ে পড়বে।
আধুনিক জীবনযাত্রা, দ্বন্দমুখর পরিবেশ-প্রতিবেশ, সংশয়, বিচ্ছিন্নতাবোধ, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার মানসিক দৈন্য, জীবনযাপনের অনাকাঙ্খিত গতি ইত্যাদি তার সহজাত স্বভাবের একদম বিপরীত হয়।
মূলতঃ নগর জীবনের জীবনের অভিজ্ঞতা থাকেনা বলেই তার রচনা জটিল হবার উপায় থাকেনা।তার রচনা কখনওবা আধুনিক জীবনযাত্রায় নিমজ্জিত পাঠকের কাঙ্খিত বৈদগ্ধের চাহিদা ও স্বাদ হয়ত মেটাতেও ব্যর্থ হয়। আধুনিক কবি ও আধুনিক শিক্ষিত পাঠকের রুচির কাছে কিছুটা অনভ্যস্ততার কারনেই ঐ সহজিয়া রচনা অনেকাংশে আদর লাভেও ব্যর্থ হয়। তবে নাগরিক জীবনের কিছুই বোঝেন না চারনকবি এমন ধারনা করা অন্যায় হয়। চারনকবি তার রচনায় নাগরিক জীবনের জটিলতা, বৈসাদৃশ্য, সংশয় ইত্যাদি উপজীব্য করে বচনরীতিতে কখনও রসোক্তি, খেদোক্তি, কৌতুকরস পেশ করে পুনরায় হেঁটে ফিরে যান শহর থেকে নেমে তার মনোরাজ্যের পরিচিত চৌহদ্দিতে মেঠো পথ ধরে – কেননা ওখানেই তার মুল প্রবনতা!চারনকবি যেভাবে বলেন তা আধুনিক কালের পাঠক ও কবির কাছে কাঙ্খিত রুচির সমপর্যায়কে চূড়ান্তভাবে স্পর্শ করতে পারেনা। মূলতঃ এটা ঘটে যায় কবিতাশিল্পের প্রকরনের পার্থক্য ও রচয়িতাদ্বয়ের জীবনাচরনের বৈসাদৃশ্যের কারনে। আধুনিক কবির জীবনযাত্রা বাউল তথা চারন কবির জীবনের থেকে পৃথক বটে।
নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত কবিকে, যাকে মোটাদাগে তথাকথিত আধুনিক কবি নামে অভিধায় সনাক্ত করা হয়, তিনিও বিশ্বলোক দেখেন, আধ্যাত্মিকতা তার মনেও সাড়া দেয়, জীবনজগতের রহস্য তাকেও অভিভূত, বিহ্বল করে, দ্বন্দমুখর জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে তিনিও ক্ষতবিক্ষত হন।কিন্তু তার রচনায় এর প্রকাশ হয়ে যায় চারনকবির প্রকাশের থেকে অনেক ভিন্ন।এর পেছনে অনেক বিষয়, বস্তু, উৎকেন্দ্রিকতা, আইডিয়া, মানসগত পার্থক্য ক্রিয়া করে, প্রভাব রাখে।
প্রথমেই একটি বিষয় নজরে আসে যা হচ্ছে; নগরে প্রকৃতির আধিপত্য বিরল। প্রকৃতি যেন নগর-মহানগরের দয়ায় তার অস্তিত্ব কিছুটা তুলে ধরতে পারে। প্রকৃতি নিধন করেই মহানগরের ব্যাপক বিস্তৃতি ও প্রসার! নগরের প্রয়োজনে প্রকৃতি – এ সত্য নতুন করে উপলব্ধি করেছে যদিও অধুনা পৃথিবী, তবু মূল প্রবনতা রয়েই যাচ্ছে, অর্থাৎ নগর-শহরের অনন্ত প্রসার অনিবার্য, নাগরিক জীবনের প্রয়োজনীয় সকল বস্তুতান্ত্রিক উপাদানের অন্তহীন বিস্তার অপ্রতিরোধ্যভাবে চলমান থাকবেই!
কতগুলো অনিবার্য নিয়ামক প্রবণতাকে ঘিরে বস্তুতান্ত্রিক আধুনিক জীবনের বিকাশ ঘটেই চলেছে যা থেকে বেরুবার যেন কোনো উপায় নেই। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা অর্জন অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই, প্রায়োগিক শিক্ষা লাভ, জীবনাচরনে অসম্ভব গতি, পিছু ফিরে তাকাবার অবসরহীনতা, সমাজ জীবনে একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার শিকার হওয়া ইত্যাদি মানুষকে প্রকৃতি, পরম্পরাবোধ, শিকড়সন্ধানে উন্মুখতা থেকে ঠেলে বের করে দিয়েছে এক গতিময় জীবনের দিকে যার অর্থ খুঁজে পাওয়াও দুরুহ হয়ে গেছে। জীবিকা হয়ে গেছে জীবনের সব কেড়ে নেয়ার এক নির্দয় দানব।
এ জটিল পরিস্থিতির মধ্যেই বসবাস ঘটছে আধুনিক কালের কবি ও পাঠকের।স্বাভাবিকভাবেই এ পরিস্থতিতে এ প্রশ্ন এসে যায় যে, ভবিষ্যতে চারন কবিদের অস্তিত্ব থাকবে কিনা এবং তাদের সহজিয়া রচনার ধারাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে কিনা।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, বর্তমানে যে অব্যাহত গতিতে নাগরিক জীবনধারা ও জীবনাচরন চলছে, প্রকৃতি নিধন করে নগরের প্রসার বেড়েই চলেছে, অধিকন্ত, নাগরিক জীবনে প্রকৃতি-ভিত্তিক জীবনযাপনের অবকাশ ও প্রভাব লোপ পাচ্ছে, তাতে চারনকবিদের অস্তিত্ব সুদূর ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশী মনে হচ্ছে।ফলে একই কারনে চারনকবিতারও সমাপ্তি ঘটে যাবে বলে মনে হয়।বস্তুতান্ত্রিক নগরজীবনের প্রসারের কারনে পরবর্তী আধুনিক সময়কালে চারনকবি পাওয়া এবং চারনকবিতা সৃষ্টি একেবারেই দুর্লভ হবে। আর এখানেই আধুনিক কবির কাছে এসে যাবে এক অন্য চ্যালেন্জ!
আধুনিক কবি তো অন্য কোনো গ্রহের থেকে আসা কেউ নন, তাকেও নাড়া দেয় পরম্পরার দায়, তিনিও বোঝেন এবং সাড়া দেন সহজিয়া চারনকবির চারনকবিতার মাধুর্যে! তিনিও তো নগরজীবনে চারনকবিদের মত বোহেমিয়ান হন কখনও কখনও, অথবা বলা যায়, আধুনিক কবিও তো নগরজীবনের ভেতরে বিচরনশীল এক চারনকবি! তিনিও তো নগরজীবন, বিশ্বজগত, সবকিছুর ভেতরে তার বিচরন অব্যাহত রেখেছেন এবং তার উপলব্ধি, অনুভব ও অভিজ্ঞতা থেকে রচনা করে চলেছেন অমর কবিতা।
তবে সে কবিতার প্রকরন, ভাষা, ছন্দ ও মেজাজ চারনকবিতা থেকে ভিন্ন যেহেতু রচয়িতার জীবনাভিজ্ঞতা, প্রতিবেশ ও পরিবেশ চারনকবিদের থেকে অনেক আলাদা। তবে এটুকু বলতে দ্বিধা নেই যে, ভবিষ্যতে আধুনিক কবিরা চারনকবিতার পরম্পরা ধরে রাখতে তাদের আধুনিক কবিতার ভেতরে সহজিয়া ভাব, মেজাজ, তুলে ধরতে পারবেন, কেননা নগরজীবন যতই জটিল হোকনা কেন সহজিয়া মন, সহজিয়া ভাব ও তার প্রকাশ হচ্ছে মানুষের মজ্জাগত। সুতরাং আধুনিক কবির কবিতায় একটা ভিন্ন প্রকরনে আবার চারনকবিতার ভাব, লয়, মেজাজ ও ছন্দ ফুটে উঠবে।
আধুনিক নগরজীবন থেকেও তো বেরিয়ে আসবে চারণভাবের আধুনিক নির্যাস। হয়ত প্রকাশের ধরন একটু ভিন্ন হবে, তবে তা আরেক আঙ্গিকে ভিন্ন মাত্রা পাবে।তখন আধুনিক নগরজীবন আধুনিক কবি ও পাঠকের চারনভূমি হবে, জটিল মানসও যথারীতি থাকবে মনোলোকের বিচরনভূমি, বৈদগ্ধতাও হবে তাদের ঋদ্ধির ক্ষেত্র, তবু সহজিয়া ভাব ও প্রকাশের তৃষ্ণা কবি ও পাঠকের থেকে যাবেই।আর তা থেকেই জন্ম নেবে নতুন সৃষ্টি।যেহেতু আবার বৈশ্বিক গ্রামের (global village)দিকে মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছে, নগর ও গ্রামের বিভাজনও যখন বিলুপ্তির পথে, তখন আরেক ভিন্ন আঙ্গিকে চারনকবিতা কথা কয়ে উঠবে আধুনিক কবিদেরই কলমে সার্বজনীন শ্রোতা ও পাঠকের সমীপে!
১৮/৯/২০২০ঢাকা।
মাশুক আল হোসাইনঃ কবি ও কথা সাহিত্যিক