কাকন রেজা : দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতাকেন্দ্রগুলিতে শনিতে ভর করেছে। প্রথমত পাকিস্তান, দ্বিতীয়ত শ্রীলঙ্কা। পাকিস্তানের পতনে ইমরান খান নিজ এবং দলের বিপর্যয় আপাত সামাল দিতে পেরেছেন। দু’একজন ছাড়া দলের কারো হেনস্থা হতে হয়নি, যেভাবে হতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। এর আগে আফগানিস্তানের পতন দেখেছি আমরা। দেখেছি কাবুল বিমানবন্দরের অবস্থা। দুঃশাসক ও সহযোগীদের পলায়ন যাত্রার সাক্ষি কাবুল বিমানবন্দর। দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ নেপালের অবস্থাও খুব একটা সুবিধের না। যদিও নেপাল সরকার তার কিছুটা আঁচ করতে পেরে বিলাস দ্রব্যের আমদানি বন্ধ করেছে যাতে কিছুটা হলেও বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচে। কিন্তু ঘটনাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তাও যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। একটু সময় লাগবে কিন্তু নেপালেও ধ্বস শুরু হবে এমন আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
ইউক্রেন ক্রাইসিস নিয়ে শুরুতেই বলেছিলাম যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির অনেক মেরুকরণ ঘটবে। বদলে যাবে আঞ্চলিক রাজনীতির দৃশ্যও। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়বে মোটাদাগে। তখনো যুদ্ধ শুরু হয়নি, তাই আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীগণ খুব একটা গা করেননি সেসব আলাপে। করার কথাও নয়, তারা দেশের মহান বুদ্ধিজীবী আর আমরা কোন হরিদাস পাল। দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরই সময়ের সাথে চামড়া মোটা হতে থাকে। গণ্ডারের মতন, চুলকানি দিলে পনেরো দিন পরে টের পান। আর তারমধ্যে যা ঘটার ঘটে যায়।
বলেছিলাম ইমরান সরকারের পতন ঘটবে। কেউ পাত্তা দেয়নি। কারণ পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ভালো সম্পর্ক নেই। সেখানেও কিছু মানুষের জিকির রয়েছে ইমরানের বিকল্প নেই বলে। তারা ইমরানকে রীতিমত তুলনার বাইরে রেখেছেন। ভাবটা এমন ইমরানের প্যারালাল কেউ নেই। গণমাধ্যমেরও সমর্থন ছিলো ইমরানের প্রতি, ফলে প্রচারে তারা ইমরানের পাশাপাশি কাউকে রাখেনি। তারপরেও ইমরানের পতন রোখা যায়নি। পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যম গ্লোবাল ভিলেজের গ্লোবাল পলিটিক্স বুঝতে ভুল করেছিলো। স্রোতের বাইরে গিয়ে চিন আর রাশিয়ার মিত্রতা ভারী হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইমরানের জন্য।
পুরো দক্ষিণ এশিয়ার দৃশ্যচিত্র প্রায় একই রকম। চিন ও রাশিয়ামুখী হয়ে উঠেছে দেশগুলো। এ অবস্থার পেছনে অর্থনীতি ছাড়াও ভারতের ভুল রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ ও তা থেকে সৃষ্ট চিন্তাও দায়ী। ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোর মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়তে চায়নি। সেক্ষেত্রে তাদের চিন্তাও ছিলো একমুখী, নির্দিষ্ট দলকে কেন্দ্র করে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ ক্রমেই ভারত বিমুখ হয়ে উঠছিলো এবং এখনো সেই বিমুখতা কাটেনি। যার সুযোগটা নিয়েছে চিন। অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেই বলবেন, চিনের লাভটা হলো কী; দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের সমর্থক সরকারগুলোর একে একে পতন ঘটছে। আপাত দৃষ্টিতে কথাটা ঠিক। কিন্তু দূরদর্শি চিন্তায় সেই আপাত ঠিকটা নিশ্চিত ভুল হয়ে দাঁড়াবে। কীভাবে ভুল হবে একটু বলি।
দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া অন্য দেশগুলি ভারতের সাথে ছিলো। এমনকি আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সাথেও তলে তলে ভালো সম্পর্ক ছিলো ভারতের। আর এসব দেশ যদি মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ভালো থাকে, তবে তাদের সমর্থনটাও ভারতের জন্য কাজের হবে। কিন্তু এসব দেশের যদি বারোটা বেজে যায়, অর্থনীতি ধ্বসে পরে, রাজনীতি অস্থিতিশীল হয় তবে তারা অন্যদের সমর্থন জোগাবে কী, নিজেদেরই তো ইয়া নাফসি অবস্থা। শ্রীলঙ্কা তার চাক্ষুস নজির। চিন জানে পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একসময় ভারতমুখীই হবে। সুতরাং দেশগুলির অবস্থা যতদিন মোটামুটি থাকে ততদিন তাদের সাথে থাকলে মন্দ না। আর অবস্থা খারাপ হলে তাদের সাথে না থাকলেও কুছ পরোয়া নেই, কারণ ততদিনে দেশগুলির বারোটা বাজা শেষ।
এই ক্ষেত্রে চিন আর ইউক্রেন-রাশিয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের নীতি এক। ইউক্রেনের কী হলো তা নিয়ে পশ্চিমাদের মাথাব্যথা নেই, ছিলো না কোনকালেই। কারণ ইউক্রেন একসময় রাশিয়ার অংশ ছিলো, যেখানের মানুষের একটা বড় অংশ এখনো রাশিয়াপন্থী এবং তারা এক সময় ইউক্রেনের ক্ষমতায়ও ছিলো। তাদের আবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়ার মতন ছিলো না। বলা যায় ইউক্রেন রুশ বলয়েরই একটা অংশ। সেই রুশদের সাথেই ইউক্রেনকে লড়িয়ে দিয়েছে পশ্চিমারা, আর এই লড়াই হবে দীর্ঘমেয়াদী। ইউক্রেনকে অক্সিজেন দেয়ার মতন সাহায্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্ররা, যাতে ইউক্রেন দীর্ঘসময় যুদ্ধের ময়দানে থাকতে পারে। আর ওদিকে পুতিন তার ইগোর চোটে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন। নামলেই বাঘের পেটে যাবার ভয়।
সুতরাং যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী না হয়ে উপায় নেই। তাতে অনিবার্যভাবে রাশিয়ার অর্থনীতিরও বারোটা বাজবে। যার লক্ষণ প্রকটভাবে দৃশ্যমান। আগামি অন্তত পঞ্চাশ বছর নিরাপদ থাকবে পশ্চিমারা। চিনও তাই করেছে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে। জামা কাপড়ের মাপে কাটতে হয়। শ্রীলঙ্কার সরকার জামার মাপে কাপড় কাটতে গিয়েছিলো। একসাথে প্রচুর মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া হলো নির্বুদ্ধিতার কাজ। অর্থনীতি যতই ভালো থাকুক, বিপুল খরচের ধাক্কাটা একসময় লাগবেই। সাথে যদি কোনো প্রকৃতি প্রদত্ত দুর্যোগ থাকে তাহলে তো কথাই নেই। শ্রীলঙ্কার বড় আয় পর্যটন খাত থেকে। করোনায় তা ধ্বসে পড়েছে। লোভী রাজা পাকসে পরিবার মেগা প্রকল্পের নামে লুটপাটের যে প্রকল্প চালু ছিলো, করোনার বিপর্যয় সে হিসেবে ছিলো না। তাদের ধারণা ছিলো, তারা লুটপাট করেও উতরে যেতে পারবে। কিন্তু বিধি বাম।
শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবার যে ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটিয়েছিলো তার পরিণতি তাদের ভুগতে হচ্ছে। রাস্তায় অন্তর্বাস পরিহিত শ্রীলঙ্কান সংসদ সদস্যের করুণ আকুতি সেই পরিণতির দৃশ্যমান চিত্র। ফ্যাসিস্টদের পরিণতি কোনকালেই ভালো হয়নি। স্তালিন থেকে গাদ্দাফি কারোরই না। ফ্যাসিস্টরা ভুলে যায় ফ্যাসিজম কোনো দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া নয়। প্রবল কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। ফ্যাসিস্টদের পরিণতিও ভয়াবহ হয়। বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়, মানুষের ক্রোধে জ্বলতে হয়। মুশকিল হলো ফ্যাসিস্টরা কখনোই এসব দেখেও শেখে না। যতই বলা হোক না কেন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে, তারা নেয় না। বরং যারা নিতে বলে উল্টো তাদের শত্রু জ্ঞান করে।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।