মোহাম্মদ বাতেনঃ
ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে “খোদা কি লিয়ে” মুভিটা দেখতে বসলাম। পাকিস্তানি এ-ই মুভিটি ২০০৭ সালে মুক্তি পেয়েছিলো।।গ্লোবালি In the name of God নামে মুক্তিপ্রাপ্ত মুভিটি পাকিস্তানের ইতিহাসে আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত মুভিগুলোর মধ্যে একটি। সত্যি বলতে কি মুভিটা আমার দেখতে তিনদিন লেগেছে। মুলত কনজারেভটিভ ইসলামের ইন্টারপ্রিটেটিভ পার্স্পেক্টিভ এ পাশ্চাত্য ও পাকিস্তানে দৃষ্টিভংগী কিভাবে ভেরি করে সেটাকেই মূল উপজীব্য করে মুভিটি বানানো।
ডকুমেন্টারী স্টাইলে বানানো মুভিটাকে ঠিক ড্রামা জনরার ফেলা যায় না। খুব বেশি আগ্রহী দর্শক না হলে কাহিনীর মধ্য দিয়ে দর্শককে একটা ক্লাইমেক্সের দিকে টেনে নেয়ার চেষ্টাও করেনি পরিচালক। মুলত ফ্রেম বাই ফ্রেম করে মুভিটা এগিয়েছে।। মুভিটাতে ইসলামের ইন্টারপ্রিটেটিভ পার্ট নিয়ে আমাদের কনজারভেটিভ সোসাইটি এবং পাশ্চাত্যে ৯/১১ পরবর্তী মিসকন্সট্রুড প্যানিকড এবাউট ইসলাম কে পরিচালক পাকিস্তানী একটি পরিবারের দুই ভাইয়ের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছে।
যেখানে দুই মিউজিশিয়ান ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই র্যাডিকাল ইসলামের খপ্পরে পড়ে গান ছেড়ে মিলিট্যান্ট গ্রুপে যোগ দেয়, আরেকভাই আমেরিকায় মিউজিক নিয়ে পড়তে গিয়ে শুধু মুসলিম হওয়ায় সাসপেক্টেড টেররিস্ট হিসাবে নির্যাতনের শিকার হয়৷ দুইটা ভাইয়ের কাহিনী প্যারালালভাবে এগিয়ে আমাদের র্যাডিকাল ইসলামের ইন্টারপ্রিটেশন ও ওয়েস্টে ইসলামকে গড়পড়তাভাবে র্যাডিকাল ফোর্স হিসাবে পোট্রে করে শুধু মুসলিম হওয়ায় কিভাবে রেসিজম, হেট পলিটিক্সের শিকার সেটা দেখিয়েছে।৷ দুটার মধ্যেই দুই ধরনের প্রটেকশনিজম/ কনজারভেটিজম কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটাকে উপস্থাপন করতে গিয়ে পরিচালক র্যাডিকালিজম উত্থানের পেছনে যে পলিটিক্স সেটাকে হয় সচেতনভাবে নয়তো অচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে।।
সেই অর্থে মুভীটা আমার কাছে ওরিয়েন্টালিস্ট ঘরনার মনে হলো।। ওরিয়েন্টাল লেন্সে র্যাডিকাল ইসলাম কে যেভাবে পোট্রে করে সেটাই দেখিয়েছে পাকিস্তানের FATA ( Federally Administered Tribal Area) খাইবার পাখতুয়ানে মারিয়ামকে তার ব্রিটিশ-পাকিস্তানী বাবা মিথ্যা বলে পাকিস্তানে জোর করে বিয়ে দিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে সেটা দেখানোর মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে ইসলাম নিয়ে লিবারেলরা কনজারভেটিভ দের দৃষ্টিভঙ্গির যে সমালোচনা করে; সেটাই দেখিয়েছে মানসুরের আমেরিকায় এসে মিথ্যা আল কায়েদার কানেকশনের অভিযোগে আটক হয়ে নির্যাতনের শিকার হওয়া দেখিয়ে।
কিন্ত পুরো ঘটনার পলিটিকাল ও সোশ্যাল রিপারকেশন পরিচালক এড়িয়ে গেলেন।এই চলচ্চিত্রে সংলাপ গড়পড়তা, স্ক্রিনপ্লে দুর্বল মনে হলো আমার কাছে।।তবে ইসলামের নানা ইন্টারপ্রটেশনের ব্যাখা দিতে গিয়ে নাসরুদ্দিন শাহ যেভাবে আদালতে দাঁড়িয়ে র্যাডিকালদের ভাবনা ও প্রাক্টিসের যে দুর্বলতা; সেটাকে উপস্থাপন করেছে; সেটা নিঃসন্দেহে মুভীর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক।
ঠিক একইভাবে আমেরিকায় মিথ্যা সন্দেহে অভিযুক্ত মানসুরকে FBI যেভাবে নির্যাতন করেছে সেটার বিপরীতে একটা ব্যাখা দিলে মুভীটা অরিয়েন্টাল বাউন্ডারিকে কিছুটা হলেও অতিক্রম করার চেষ্টা করতে পারতো।।অনেকগুলো দৃশ্য আরোপিত এবং মুল কাহিনীর ফ্লো এ-র মাঝে আউটলায়ার মনে হলো। মারিয়ামের বাবার গার্ল্ফ্রেন্ড ব্রিটিশ, তিনি নিজে আধুনিক জীবন যাপন করে। কিন্ত মেয়েকে মুসলিম ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পাকিস্তানে নিয়ে কেন আসলো, তাও আবার আফগান সীমান্তের আদিবাসী র্যাডিকাল এলাকায়- পুরো মুভিতে এ-র ব্যাখা খুঁজে পাই নাই– শুধু হিপোক্রেট বাবা এই একটা শব্দ দিয়ে মুভির সবচেয়ে টার্নিং পয়েন্ট যে বিয়ে সেটাকে জাস্টিফাই করা যায় না।
বাবার ব্রিটিশ গার্লফ্রেন্ড জোর করে মেয়েকে পাকিস্তানে বিয়ে দেয়া নিয়ে শক্ত কোন ভুমিকা নেয় না, কিন্ত পরে মেয়েকে পাকিস্তান থেকে উদ্ধার করতে মেয়ের বয়ফ্রেন্ডকে সাহায্য করে- এই যোগসূত্র মিলাতে পারলাম না। মেয়ের বাবার না পাকিস্তানের আদালতে না ব্রিটেনে; কোথাও শাস্তি হলো না- যদিও আদালতে এটা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে; মেয়ের বাবা মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে মিথ্যা বলে একটা ব্রিটিশ নাগরিককে পাকিস্তানে বিয়ে দিয়ে তার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে।
আদালতে মৌলানার র্যাডিকাল ফলোয়াররা যেভাবে হামলা করে ফাওয়াদকে আহত করলো সেটার বিচার ও হলো না। এটা কিভাবে সম্ভব? যে মৌলানা ইসলামের ভুল ব্যাখা দিয়ে জঙ্গি বানাচ্ছে আদালতে সাওয়াল জবাবে সেটা প্রমাণিত হওয়ার পরেও সেটা নিয়ে আদালতের প্রতিক্রিয়া কি সেটা দেখানো হলো না! উলটো শেষ দৃশ্যে দেখা গেল সেই মৌলানা তারা ব্যাখা দিয়ে নতুন নতুন যুবকদের র্যাডিকালিজমের দিকেই টানছে।।
সবই আমার কাছে অরিয়েন্টাল লেন্স মনে হলো। মানে দেখাতে চেয়েছিলো পাকিস্তানে আইন আদালত ও এ-ইসব রাডিকাল ইন্টারপ্রিটেশনের প্রতি সফট।মেয়েটা জীবনে এত দুর্দশার পরেও আবার সেই খাইবার পাখতুয়ানেই ফিরে গিয়ে নারী শিক্ষায় মনোনিবেশ করে– পুরো ছবিতে তাকে মানসিক ও শারিরীক যে নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাতে এ-ই দৃশ্য আরোপিত মনে হয়েছে।।
যেখানে তাকে ব্রিটিশ এম্বেসি উদ্ধার করে ব্রিটেনে সেইফ হোমে পাঠাতে চাইলো কিন্ত সে আবার সেই আদিবাসী অধ্যুষিত খাইবার পাখতুয়ানে ফিরে যাওয়া অতি নাটকীয়তা আর পাকিস্তানী এসটাবলিশমেন্টকে রক্ষা করার চেষ্টা মনে হলো।
এ-ই অর্থে এটা কনজারভেটিভ ভিউ। কিছুটা দূর্বলতা থাকলেও,মুভিটা কিছুক্ষেত্রে অনেক সাহসী। ইসলামের ভুল ইন্টারপ্রটেশন যেভাবে আমাদের সমাজে কিংবা পাশ্চাত্য এ একটা শ্রেনীর মধ্যে গেড়ে বসেছে সেটা বুঝার জন্য মুভিটা চমতকার রেফারেন্স। আমি সচেতন সবাইকে মুভিটা দেখতে বলবো।।অন্তত আমাদের অনেকগুলো ভুল ভাঙ্গবে ইসলাম সম্পর্কে।
আমাদের মৌলানাদের – মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত- বিদ্যার কারণে ইসলাম ঘরে বাহিরে কিভাবে মানুষের জীবন ও পরিবারকে অসহায় ও বিপর্যস্ত করে তোলে সেটা বুঝার জন্য মুভিটা দেখা দরকার। নাসরুদ্দিন শাহ এ-র ব্যাখা শুনে মনে হবে- ইসলাম আসলেই শান্তির ধর্ম। এটা পালন কঠিন নয়। সবচেয়ে বড় কথা ধর্ম অন্তরে অনুভবের ব্যাপার, জোর জবরদোস্তির ব্যাপার না। ইসলামের এ-ই সৌন্দর্য্য বুঝার জন্য হলেও মুভিটা দেখা উচিত।।