মাসকাওয়াথ আহসানের স্মৃতিগদ্য
মা দিবসটাই আমার সবচেয়ে পছন্দের। কারণ এই একটা সম্পর্কই মৌলিক। আমি জীবনে মা ছাড়া আর কাউকে ভয় পাইনা। আম্মার বয়স বেড়েছে; কিন্তু আমার স্মৃতির আম্মা রয়ে গেছেন চিন্তাজগতে। পড়ালেখার হাতে খড়ি হয়েছে তাঁর কাছে। বাংলা সাহিত্য তন্ন তন্ন করে খুঁজে আম্মা আমাকে পড়ে শুনিয়েছেন ধ্রুপদী সব কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ। ছোট নানা বলেছিলেন, ক্লাস ফোর ফাইভের মধ্যেই আম্মা পড়ে ফেলেছিলেন ধ্রুপদী সাহিত্য। ফলে বাংলা সাহিত্যে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ ছিলো তাঁর জন্য পুনরাবৃত্তি।
আব্বা সবসময় আম্মাকে স্মৃতিতীর্থ বলে ডাকতেন। বলতেন, তোমার আম্মার লিটেরেরি রেফারেন্স মনে রাখার ক্ষমতা আমাকে বিস্মিত করে।
আম্মা ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ছিলেন। বিয়ের পর সংসার-সন্তান তাঁর কাঁধে বোঝা হয়নি। উচ্চতর শিক্ষায় অনায়াসে ভালো ফলাফল করেছেন। আম্মাকে সবাই আয়রন লেডি হিসেবেই জানতো। যে কোন জায়গায় অন্যায়ের প্রতিবাদে আম্মা অনমনীয়।
সামাজিক মানুষ তিনি; কিন্তু সমাজের অচলায়তনকে চ্যালেঞ্জ করেছেন সবসময়। অযৌক্তিক কোন কিছু কখনো সহ্য করেননি।
আব্বা কলকাতার ছেলে হওয়ায় বেশ কিছুটা রোমান্টিক ছিলেন। কিন্তু আম্মা রাজশাহীর মেয়ে। তিনি মেয়েলি ঢং একেবারেই পছন্দ করতেন না। আম্মা শিশুকালে ক্রিকেট খেলতেন, কিন্তু একটু বড় হলে ক্লাসমেটরা যখন বলে, গিনি, এখন তোমার আমাদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা ঠিক নয়; ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে উইকেট ভেঙ্গে দিয়ে আম্মা চলে এসেছিলেন।
আম্মাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি; কিংবা তিনি প্রকাশ্যে কাঁদেননা। আম্মার চোখ কিছুটা লাল হলেই বুঝতাম, আম্মা কষ্ট পেয়েছেন।
আমাকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করার পরই কেঁদেছিলেন, পরে সেটা বুঝে কলেজের এডজুটেন্ট আর প্রিন্সিপ্যাল বলেন, এখানে এতোগুলো ছেলের জন্য কয়েকজন শিক্ষক; আর আপনার বাসায় দুই ছেলের জন্য দুজন শিক্ষক। সুতরাং একে নিয়ে যান ভাবী।
আব্বা কিছুটা থিওরিটিক্যাল মানুষ বলেই ভুল করে আমাকে ক্যাডেট কলেজে দিয়েছিলেন। আম্মা সেই ভুল সংশোধন করেছিলেন।
আব্বা চেয়েছিলেন, আমি আর্কিটেক্ট হই; আম্মা সমর্থন দিয়েছেন, ইংরেজি সাহিত্য পড়তে। এইচ এসসির পর আই এসএসবি পাস করে আর্মিতে যাবার উদ্যোগ নিলে, আম্মা নিজে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত হন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আমাকে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি করে নিয়ে আম্মাকে বলেছিলেন, আপনি যান ছেলেকে সর্বনাশের পথ থেকে ফেরান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতারা হলে আমার প্রাপ্য সিংগেল সিট না ছাড়লে; আমি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যাই। ভর্তি হয়ে ফিরে এলে, আম্মা আবার আটকে দেন, আরবান নকশাল হয়ে অবাঙ্গালি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবো এই আশংকায়। সে যাত্রা আটকে দিলেও আমি ঠিকই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েই আরবান নকশাল হয়েছি; এবং আম্মার জন্য লক্ষ্ণৌ বংশোদ্ভুত অবাঙ্গালি বৌমা জোগাড় করেছি ইউরোপে গিয়ে।
আম্মার ইন্টারভেনশন আমার জীবনে আশীর্বাদ হয়েছে। আম্মা আমাকে বিতর্ক শিখিয়েছেন, শিশুকালে বিশ্বের সেরা চলচ্চিত্র দেখিয়েছেন, সংগীতে টেস্ট গড়ে তুলেছেন।
আম্মার কড়া শাসন না থাকলে আমি একজন খ্যাতনামা মাস্তানই হতাম। সেটা বাংলাদেশ সমাজের জন্য যুতসই হতো। এই আম্মার শৃংখলা আর শিষ্টাচার শিক্ষার কারণে, ব্যাং-এও মুঠি পাকিয়ে এসেছে মাঝে মাঝে ফেসবুকে।
আমি বিশ্বাস করতাম, মাইরের ওপর ওষুধ নাই। কিন্তু আব্বা বলেছিলেন, না মারপিট অসভ্যতা; ডায়ালগ ইজ দ্য বেসিস অফ সিভিলাইজেশান। আর আম্মা এই ডায়ালগ বা সংলাপ শিখিয়েছেন। আম্মা আমার ছেলেকেও পুরোদস্তুর ডিসিপ্লিনড আর ডায়ালগের মানুষ বানিয়েছেন। নাতির নানান রকম হুইমকে আটকে দিয়ে গাইড করেন তাকে ঋজুতার সঙ্গে।
আম্মা ভ্যাড়ভেড়ে আবেগ অপছন্দ করেন। তাই ছেলেদের নিয়ে অতো কেন্দে জারে জার হননি। আমরা ইউনিভার্সিটিতে চলে যাবার পর নিজের এলাকার একটা কলেজে ঢুকে ছাত্রদের মাঝে শিক্ষার আলো আর সন্তানস্নেহ ছড়িয়ে দিয়েছেন।
আম্মার কবিতা লেখার একটা জগত ছিলো। সত্তর-আশির দশকে তাঁর অনেক কবিতা ছাপা হতো। কিন্তু জার্মানিতে থাকতে আব্বা খবর দিলেন, তোমার আম্মা তার কবিতার খাতা পুড়িয়ে ফেলেছে। এই কবিতার খাতাটা আমার কাছে “জোয়ান অফ আর্কে”-র পুড়ে যাবার মতো একটা ট্র্যাজেডি।
এই যে মা দিবস; স্বার্থ পর ছেলেমেয়েরা ম্যা ম্যা করছে; এরা কেউ মাকে আদর করে ন্যানি বানাতে চায়; সারাজীবন এক্সপ্লয়েট করে এসে আবার নিংড়ে নিতে চায়।
কিন্তু আমার কাছে মা দিবসের পোস্টগুলো দেখে টমাস গ্রে’র এলিজি রিটেন ইন আ কান্ট্রি চার্চইয়ার্ড মনে হয়। মনে হয় মায়ের জন্য লেখা এইসব এলিজি আর এপিটাফে ঘুমিয়ে আছে জীবন্মৃত অনাম্নী মায়েরা; যারা কবি হতে পারতেন, বিজ্ঞানি হতে পারতেন, বিমান চালাতে পারতেন; পৃথিবীর অসাধ্য সব বিষয় সহজেই করে ফেলতে পারতেন। এই যে মেধা সৃজনশীলতার অপচয়; সেইখানে একদিনের জন্য মাতৃপূজার এইসব ভং এইসব স্বার্থপর ছেলে-মেয়েরা; মায়ের সঙ্গে কাইত হয়ে ছবি তোলা; যেন মাকে ধন্য করে দিচ্ছে; অথচ আমরা তো জানি, মা-ই সন্তানের জীবনের ঈশ্বর; যাকে আমরা পার্থিব তুচ্ছাতিতুচ্ছ স্বার্থ সাধনে ব্যবহার করে চলি।
কেউ আবার মা বুড়িয়ে গেলে, মাকে ধমক দিয়ে শাসন করে; কীরকম ক্ষ্যাত সব মানসিকতা; কীরকম বড় হবার দেমাগ!
আমার আম্মা আফরোজা বানু আর আমার শাশুড়ি ওয়াসিম আমনা; এই যে সাহিত্য আর পদার্থবিদ্যার সেই আমলের দুই তুখোড় ছাত্রীর জীবন আটকে রইলো সাধারণ রুটিনে; এই যে অবিকশিত দুটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু; এই যে নির্জনতায় ক্ষয়ে যাওয়া; একাকীত্বকে বয়ে বেড়ানো; এইখানে মাতৃত্বের গৌরব আরোপ করে কী কোন ক্ষতিপূরণ দেয়া যাবে!