মাসকাওয়াথ আহসান
আফঘানিস্তানে তালিবানেরা মেয়েদের বিউটি পার্লার বন্ধ করে দিয়েছে। আফঘানিস্তানের মেয়েরা এতো সুন্দর দেখতে যে; বিউটি পার্লার বন্ধ করে বা তাদের বস্তাবন্দী করে সেই রুপ ঢেকে রাখা অসম্ভব।
আফঘানিস্তান-পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশের পুরুষ সমাজের একটি অংশ নারীকে প্রবলভাবে হিংসা করে। কারণ নারী মেধাবী ও রুপবতী। নারী মা-ফলে ধরিত্রীর সবচেয়ে সম্মানিত মানুষ সে।
আফঘানিস্তানে নারী তার মেধা দিয়ে শিক্ষা-চাকরি সবজায়গায় এতো ভালো করতে শুরু করেছিলো যে; পুরুষ সমাজের একটি অংশ ভীত হয়ে পড়ে। দক্ষিণ এশীয় জীবনের পুরুষদের বেশিরভাগেরই নারীভাবনা কেন্দ্রিক জীবন। নারীকে দখল করাই পুরুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
ভারতের প্রাচীন পুরুষ বিজ্ঞানীদের একমাত্র গবেষণালব্ধ গ্রন্থ কামাসূত্র ও বাতস্যায়ন। ভারতের প্রাচীন ভাস্করদের একমাত্র শিল্প অর্জন ইলোরার-অজন্তার গুহাচিত্রে নারী দেহের প্রতিমূর্তি নির্মাণ।
কেন পশ্চিমা বিশ্ব জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে গেলো; আর দক্ষিণ এশিয়া রয়ে গেলো গো-বিজ্ঞানের অন্ধকারে। এর কারণ পশ্চিমের পুরুষের যৌনতা থাকে জনন অঙ্গে আর সৃজনশীল চিন্তা থাকে মস্তিষ্কে। অন্যদিকে দক্ষিণ এশীয় পুরুষদের বেশিরভাগেরই সৃজনশীল চিন্তা থাকে জনন অঙ্গে আর যৌনতা থাকে মস্তিষ্কে।
আফঘানিস্তানের তালিবান, ভারতের হিন্দুত্ববাদী কিংবা বাংলাদেশের সহমত ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখেছি; পার্কে গিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকাদের ধরে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যেতে। এ কারণে প্রেম-ভালোবাসা বিদ্বেষী এসব সমাজে বিকৃতি অনেক বেশি। অভিজাত পাড়ায় পরিবারের মুখোশে পিউ-পাপিয়ার আসর। দক্ষিণ এশিয়া আসলে প্যাসেজ টু ব্যাংককের লাল বাতি অঞ্চল।
হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃস্টান-অবিশ্বাসী-রংধনু-পোগোতিচিল; দক্ষিণ এশীয় পুরুষ মানুষ আবার খালু। এই অঞ্চলে কন্যা শিশুদের দিকে নজর দেয়া পেডোফাইল গিজ গিজ করছে। মনসুন ওয়েডিং ছবির পেডোফাইলের মতো খুব ভদ্র চেহারার অন্তরালে রয়েছে বিকৃতি।
এই অঞ্চলে আমসি পারা কিংবা রামায়ণ পড়াতে আসা মোল্লা-পুরুত অথবা গান শেখাতে আসা সংস্কৃতি মামা সবাই বাজপাখির মতো হানা দেয় কিশোরি ছাত্রীর শরীরে।
দক্ষিণ এশীয় সমাজ প্রেমের শত্রু। এখানে ফইন্নি মানসিকতার কারণে মা-খালা-ফুফু লালবাতি এলাকার মোক্ষদা মাসি বা পাপিয়া খালার মতো; তরুণীকে প্রতিষ্ঠিত লোলুপ পুরুষের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসে। বিবাহ নামের লাইসেন্সে; সারাজীবন বইয়ের আড়ালে রসময়গুপ্ত লুকিয়ে পড়া বিকৃত পুরুষ; বিরাট প্রতিষ্ঠিত বলে ধর্ষণ করে তরুণীকে। এরকম অন্ধ-অক্ষম-বিকৃত সমাজে অসংখ্য মাদাম কুরি, ভ্যালেন্তিনা টেরেসকোভা, জেন অস্টিন, শার্লট ব্রন্টির সম্ভাবনার মৃত্যু হয় “পুরুষ” নামে ইনসিকিওরড প্রতিষ্ঠানের কারাগারে।
এইভাবে শত বছরের লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নিতে; নতুন প্রজন্মে খুনে নারী তৈরি হয়েছে অনেক; যারা স্বামীকে দুর্নীতিতে বাধ্য করে; এমেরিকা-ক্যানাডায় মাইগ্রেট করতে বাধ্য করে। বাচ্চাদের দাদা-দাদীদের সঙ্গে মিশতে দেয়না। স্বামীর টাকা বিনিয়োগ করে নিজের বাপ-মায়ের বাড়িতে। থাগস অফ সাউথ এশিয়ান উইমেন; এই দলটি শতবছরের নির্যাতনে বর্বর হয়ে ওঠা নারীমন। ফলে ভালো মনের অসংখ্য পুরুষ “জীবন থেকে নেয়া”র খান আতার মতো “এ খাঁচা ভাঙ্গবো আমি কেমন করে”-র হতভাগ্য স্বামী; যে সাউথ এশিয়া রিভেঞ্জ ফেমিনিজমের শহীদ।
নারীকে শতবর্ষ ধরে অবরুদ্ধ রাখার কারণেই সে কট্টর মোল্লা-কট্টর পুরুত-কট্টর প্রগতিশীলের মতো কট্টর নারীবাদী। এ কারণে এ অঞ্চলের নারীবাদের সঙ্গে এনলাইটেনমেন্টের সম্পর্ক খুব কম।
আফঘানিস্তানে নারীদের বিউটি পার্লার বন্ধ হওয়ায়; নিউজ কমেন্টে আলহামদুলিল্লাহ লিখছে। বিউটি শব্দটির সঙ্গে প্রবল শত্রুতা মোল্লা-পুরুতের। মোল্লা-পুরুতের সমস্যা হচ্ছে, তারা নারীর প্রতি প্রেম প্রকাশের ভাষা খুঁজে পায়না। তাই তাকে বস্তা পরিয়ে অধিকার করতে চায়। একই কাজ প্রগতিশীল করে দুটি কবিতার লাইন বলে; গান শুনিয়ে, ফাঁপা প্রশংসা; আসল লক্ষ্য তাদের লিটনের ফ্ল্যাট। মাত্র দশ মিনিটের শারীর উদ্দীপনার লোভে নারীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে আছে এই যৌনতা-পিপাসার্ত সমাজ।
অথচ নারী অন্য রকম চিন্তার মানুষ। সে সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের মানুষ। সে ভালোবাসতে চায়; ভালোবাসা পেতে চায়। দীর্ঘ প্রেমের আস্থা আর মায়া ছাড়া সে দশ মিনিটের শারীর উদ্দীপনা পছন্দ করে না। সেইখানে যখন পুরুষ সমাজ এগিয়ে আসে লাললার লালামাখা লোলুপ জিভ নিয়ে; নারী প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে, মাদাম বোভারির মতো এডভেঞ্চার করে। কবি-লেখকেরা নারীকে ছলনাময়ী বলে; সে ছলনা আসলে বর্বর পুরুষ সমাজে আত্মরক্ষা কৌশল।
সমাজে যে মেয়েটার দুর্নাম আছে; সে-ও শেষ পর্যন্ত প্রেম চায়; চন্দ্রমুখীর মতো সে কোন দেবদাসের আশ্রয় হতে চায়।
দক্ষিণ এশিয়াতেই নারী সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পায় তার বাবার মাঝে। এইজন্য হুমায়ূন আহমেদ বলেন, পৃথিবীতে একজনও খারাপ বাবা নেই। বাবাই নারীর জীবনের নায়ক। বাবার মতো কাউকে খোঁজে সে জীবনে নির্ভর করার জন্য। ছেলেরা যেমন মায়ের মতো কাউকে খোঁজে নির্ভর করার জন্য।
দক্ষিণ এশীয় পুরুষের একটি অংশের মাঝে নারী নিয়ে ছোঁকছোঁকানির জন্য দায়ী শিক্ষা-ব্যবস্থা। শিক্ষা ব্যবস্থাতে যদি স্পষ্ট করা যায় যে, পরীক্ষার খাতায় নারী বা পুরুষ দেখে নম্বর দেয়া হয় না। মানুষের মেধা আর সৃজনশীলতাতেই তার পরিচয়। সুকৃতি নির্ধারণে কেউ জেন্ডার বা জনন-অঙ্গ খোঁজে না। খোঁজে বুদ্ধাংক।
আফঘানিস্তান সহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করা হয়; নারীর গণতান্ত্রিক চিন্তাকে ভয় পেয়ে। পরিবারতন্ত্র থেকে আসা চিফ হিট অফিসার, সিইও, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, সংরক্ষিত আসনের বুক ফাইটা যায় বাদ দিলে; নারী মূলত গণতান্ত্রিক। ভোটকেন্দ্রে তাদের উপস্থিতি থাকে সবচেয়ে বেশি।
আফঘানিস্তানের নির্বাচনে তালিবানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভোট দিয়েছিলো নারী। পাকিস্তানে রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি পিটি আইকে জিতিয়েছিলো নারী, ভারতে আম-আদমীর ভোটারদের বড় অংশ নারী।
বাংলাদেশে “হোয়াট ইজ ভোট” ফলে ও নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। আওয়ামী পুরুষতন্ত্র কয়েকজন নারীকে ভোটকেন্দ্রে বেঁধে রেখেছিলো টাকা দিয়ে; যাতে তারা ছদ্ম লাইন বানিয়ে রেখে পিছে অপেক্ষমান নারী ভোটারদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাতে পারে। বাড়িতে নারীর অনেক কাজ। তাই অনেকে ভোট না দিয়ে ফিরে যায়। তখন নুকা নুকা বলে সবার দিকে কমলা ছুঁড়ে দিতে পারেন হাজি সেলিম।
বাংলাদেশে নারীবাদের হিপোক্রেসি আমরা দেখেছি; সরকার দলীয় এক টকশো হকার ভটভটি আপার কলতলা ক্যাচালে। টকশোতে সিনিয়র সিটিজেনকে বার বার জামায়াত বলে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করে মাদারিপুরের গ্রামের ঐ মেয়েটি। ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ছেলে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন; তাকেও জামাত ট্যাগিং-এর চেষ্টা করে পাসকোর্সে টেনেটুনে পাশ করা ঐ গ্রামের মেয়েটি। এমন মেয়ে এ সমাজে আছে কিছু; যারা রেগে গেলে সাপ মেরে তা দিয়ে পেটায় স্বামীকে। নারীবাদের আওয়ামীকরণের কারণে পুরুষতন্ত্রের আদলে যে দলীয় নারীবাদ গড়ে উঠেছে; তা আফঘান তালিবান পুরুষের হাতে অবরুদ্ধ আফঘান নারীর মতো অসহায় করে রেখেছে; অসংখ্য বাংলাদেশি নারীকে; যাদের মুক্তি দরকার পুরুষতন্ত্রের শেকল থেকে।
আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক মার্টিনেজ আওয়ামী লীগের লোকেদের সঙ্গে ছবি তুলে জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন আগের চেয়ে। একইভাবে আওয়ামী লীগের স্পনসরশীপে; ঐ টকশোতে মানহানিকর “জামায়াত তকমার” এক ঢেলা গোবর ছোঁড়ার প্রতিবাদে ;ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তাকে “চরিত্রহীন” বললে; তাকে জেলে পাঠানো ঐ সচ্চরিত্র ভটভটিদের নারীবাদের কারণে; বাংলাদেশে অন্যান্য নারীবাদী প্রচেষ্টাগুলোও জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
ঘুরে ফিরে আফঘানিস্তানে তালিবান, পাকিস্তানে জামায়াত, ভারতে হিন্দুত্ববাদী আর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও ইসলামপন্থী দলগুলো; নারীর সুষ্ঠু বিকাশের পথে প্রবল বাধা। এরা সবাই বিউটি পার্লার বন্ধ করে পাপিয়া পার্লার খুলতে চেষ্টা করে সবসময়।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া