কাকন রেজা : ঈদ নিয়ে বলার আগে বলে নিই, ঈদ শব্দটি মূলত টেকা-টুকাওয়ালাদের নয়। এটা আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি গরীবী শব্দ। বিশেষ করে যেখানে অধিকাংশ মানুষে গরীব, অথচ দ্রুত ধনীর তালিকায় প্রথম, এমন একটি দেশে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের চেয়েও অনেক বেশি গতিতে, বলতে পারেন রকেটের গতিতে আমরা ধনী হচ্ছি।
তবে মুশকিল অন্যখানে। সবাই ধনী হলে এক কথা ছিলো, হয় হাজারে এক জন। আর বাকিরা থাকেন গরীবের তালিকায়। যারা ধনী, টেকা-টুকাওয়ালা তাদের সবসময়েই আনন্দ। যে কোনো ছুটিছাটায় তারা বিদেশে যান। ছাগল কিনতে যান। ঘাস কাটা শিখতে যান। সাঁতার শিখতে কিংবা জলকেলি শিখতেও বিদেশ যেতে চান তারা। বছরভর আনন্দ করেন। ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেন বিমান ও বিমানবালার। ভালো ভালো রেস্তোরাঁর খাবারের। কেউ খুশিজলের বোতল হাতেও তাদের খুশির প্রকাশ ঘটান। সুতরাং তাদের হররোজই খুশি আর আনন্দ।
গরীবের যেমন হররোজ রোযা তেমনি। সুতরাং ঈদের আনন্দ আলাদা করে তাদের গায়ে খুব একটা লাগে না। মূলত ঈদ গরীবী ব্যাপার এ কারণেই। আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তরাই প্রকৃত ঈদের আনন্দ অনুভব করেন। ক্রমাগত বর্ধমান বৈষ্যম্যে এই আনন্দ আরো গরীবদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ হয়ে উঠেছে। বছরের দুটো দিনে নতুন জামা, ঈদি, ভালো খাবার সব মিলিয়েই ঈদটা দারুণ প্রার্থিত হয়ে ওঠে তাদের কাছে।
যা টেকা-টুকা মানে মেরেকেটে যারা ধনী হয়েছেন তাদের বোধের বাইরে রয়ে যায়। কিংবা অধিকাংশের স্মৃতিতে সেই গরীবানা থাকলেও বিস্মৃত হতে চান। যার ফলে তারা বেশ বড় ধরণের সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠেন। এই যে ঈদের নামে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি এসব মরু-সংস্কৃতি বলে উড়িয়ে দিতে চান। খোর্মা-খেজুরের সংস্কৃতি বলে খেজুরে আলাপ জুড়তে চান।
আসল কথা হলো তারা তাদের অতীত ভুলতে চান, শেকড় ছিড়তে চান। অপরদিকে এসব টেকা-টুকা কামানোদের অর্থাৎ ধান্ধাবাজদের গত এক যুগে যে বারোটির মতন বারোটা বাজানো জেনারেশন গড়ে উঠেছে, তাদের জন্য ঈদ তার ঐতিহ্য এবং সাম্যের রূপটাই হারাতে বসেছে।
বাংরেজি বলা এসব জেনারেশন হঠাৎ ধনী হওয়া মা-বাবা’র ঘুটে কুড়ানো অতীত ঢাকতে বছরভর নানা রকম কসরত করে থাকে। এদের জন্যই আমরা ইয়াবার নাম শুনেছি, এখন শুনছি এলএসডি, আইস ইত্যাদির নাম। বাপের অবৈধ পথে কামানো টাকা ব্যয়ের একটা রাস্তা তো থাকতে হবে।
যারফলেই মসজিদের শহর ঢাকায় মসজিদ ছাপিয়ে অলিগলিতে গড়ে উঠেছে ক্যাসিনো, ক্যাবারে আর বার। ঝলকানো আলোর নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে গরীব মানুষের অন্ধকার জীবন। মানুষ হাতিরঝিলের আলোতে বিভ্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে গত একযুগে হঠাৎ ধনী হওয়া মানুষগুলোর জন্য সমাজে যে অসাম্যের সৃষ্টি হয়েছে সেটা ইসলামের মৌলিক চিন্তা সাম্যবাদের সাথে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক।
ফলেই ঈদ নিয়ে গত, আজ ও আগামির বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। ঈদকে ঈদ করে তোলা দরকার হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এইযে টেকা-টুকা কামানোর মেগা ধান্ধা বন্ধ না করা যায়, তবে ইসলাম তার সাম্যের রূপ হারাবে। আর সাম্য হারানোর পরিণতি বৈষম্য। বৈষম্য মানেই সংঘাত আর দুর্দশা অনিবার্য। পুরোপুরি না হলেও সেই অসাম্যের ঝলক আমরা দেখতে শুরু করেছি।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।