-মাসকাওয়াথ আহসান
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এবারের ওয়াশিংটন সফর হয়ে উঠেছিলো বাংলাদেশের ভাগ্য বিধাতার এমেরিকা সফর যেন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির “কোয়ালিশন ইয়ারস” আত্মজৈবনিকে উনি খোলামেলা লিখেছেন, ২০০৮ সালের ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আনার জন্য উনি প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন।
এক এগারো ছিলো সেনা সমর্থিত সরকার। জেনারেল মইন ইউ আহমেদকে নতুন দিল্লিতে ডেকে ঘোড়া উপহার দেয়া হয়। প্রতীকী উপহার। মইন খুঁজছিলেন সেইফ এক্সিট। প্রণব তখন ঘোড়া দিয়ে কথা দেন তাকে, এই ঘোড়ায় চড়ে এমেরিকা চলে গিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে গেলে ছোট্ট একটা কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনে দিতে হবে।
আওয়ামী লীগ ভারতের জন্য ভালো। কারণ ১৯৭১ সালে এই দলটি ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে পাকিস্তান উপনিবেশের শেকল থেকে। সেই থেকে ভারতের সোনার খাঁচায় আওয়ামী লীগের দিনগুলি।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আগের সেই সম্পর্কটিকে ধীরে ধীরে বিবাহে পর্যবসিত করার জন্য ঢাকায় ডেটিং করতে শুরু করে ভারতের কর্মকর্তারা এসে। ২০১৪-এর নির্বাচনে ওয়াক ওভারে আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে নিতে; প্রেমিক হিসেবে পূর্ণ সমর্থন দেয় দিল্লির সাউথ ব্লক। এরপর ভারতের সুজাতা সিং ঢাকায় এসে বিরোধী দল থিয়েটারের অভিনয় চালিয়ে যাবার অনুরোধ জানান রাজনীতির নটরাজ এরশাদকে। সুজাতা এরশাদকে আসন্ন বিয়ের গায়ে হলুদের গান করতে অনুরোধ করে্ন। গণতন্ত্রের বুটের হালুয়া রাঁধতে থাকে কোটাল পুত্ররা লাইলাতুল ইলেকশনে। ঐ রাত হয়ে ওঠে বিজেপি ও লীগের মধুচন্দ্রিমার রাত।
বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে গেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রী লাজুক হাসি হেসে বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। এরপর লীগ-বিজেপির রাজনৈতিক দর্শন মিলে মিশে একাকার হয়। মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন; পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের জন্য বিজেপির প্রচারণা শুরু করতে আর “মানবতাবাদী মুজিব” শতবর্ষে ভাষণ দিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন ছাত্ররা মানবতা বিরোধী গুজরাট এর কসাইয়ের ঢাকা সফরের প্রতিবাদ জানালে; বিজেপির রাখি হাতে বেঁধে আর সুপারম্যানের আন্ডারওয়ার পরে ছাত্রলীগের এক বাহুবলী বেদম পেটায় প্রতিবাদী ছাত্রদের। পৃথিবীর যেখানে মোদি যান; সেখানে প্রতিবাদ হয়। কোথাও এমন মোদীপক্ষের হামলার ঘটনা ঘটেনা; এমনকী কলকাতাতেও না। ঢাকা সেইদিক থেকে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। ওই সফরের প্রতিবাদে মাদ্রাসা ছাত্রদের প্রতিবাদে কোটাল পুত্ররা গুলি করে কমপক্ষে ১৮ জন কিশোর-তরুণকে হত্যা করে।
এরপর চট্টগ্রামে হিন্দু ধর্মী নেতাদের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি গিয়ে ভারতকে ভালো করে বলে এসেছি; যে কোন মূল্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে। এতে উভয় পক্ষের লাভ।
মোদিজী বাংলাদেশের ক্ষমতায় আওয়ামী লীগের মায়া চান। কারণ পশ্চিমবঙ্গের মমতা অত্যন্ত অবাধ্য। কাজেই চিরশত্রু চীনের আগ্রাসন থেকে বিজেপির নিয়ন্ত্রণে থাকা আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরামসহ সাত বোন রাজ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগের মায়া সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য।
ভারতের অভ্যন্তরে গুরুত্বপূর্ণ মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজ মোদী বিরোধী। মোদীর অন্ধ সমর্থক কেবল ঢাকায় মায়ার খেলায়; সাংস্কৃতিক চেতনায়। ভারতের গত নির্বাচনের আগে ঢাকার সহমত বুদ্ধিজীবী ও ফেসবুক এক্টিভিস্টরা যেভাবে মোদীর জন্য প্রচারণা চালিয়েছেন; তাতে বিজেপি ও লীগের বিবাহটিকে স্মরণকালের সবচেয়ে সফল দাম্পত্য সম্পর্কের উদাহরণ বলে মনে হয়েছে। লায়লা-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট জুটিদের জীবনে যে স্বপ্ন সফল হয়নি; তা যেন হয়েছে লীগ-বিজেপির প্রেমের ভুবনে।
যুক্তরাষ্ট্র এই প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের মানবাধিকার লংঘন, গুম, ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সম্প্রতি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে অংশগ্রহণমূলক স্বচ্ছ নির্বাচনে বাধা প্রদানকারীদের ওপর ভিসা স্যাংশন দিয়েছে। পশ্চিমের অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নীরবে ঐ কঠোর ভিসা নীতি অনুসরণ করছে তা বলাই বাহুল্য।
ঢাকার শীর্ষ কর্মকর্তারা বার বার এমেরিকা গিয়ে ওয়াশিংটনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। কিন্তু হোয়াইট হাউজ নামেহেরাম কারো সঙ্গে দেখা করতে চায়নি। তখন বাধ্য হয়ে মেহরাম মোদীকে অনুরোধ করা হয়েছে; ঢাকায় চলমান উন্নয়নের মায়ার খেলার ফজিলত সম্পর্কে বাইডেন প্রশাসনকে বোঝানোর জন্য।
কিন্তু মোদীর ওয়াশিংটন সফর সুখের হয়নি। রাজপথে ছিলো খালিস্তান মুভমেন্টের অনুসারীদের বিক্ষোভ, কাশ্মীর মুভমেন্টের অনুসারীদের শ্লোগান; মানবাধিকার কর্মীদের সক্রিয়তা। আর অন্দর মহলে ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যানদের অসন্তোষ দানা বাঁধছিলো। কেন বাইডেন, ভারতের মানবাধিকার লংঘন নিয়ে কথা বলছেন না মোদীর সঙ্গে! মোদী এমেরিকার সংসদে ভাষণ দিলে ৭০ জনেরও বেশি সাংসদ বেরিয়ে যান অধিবেশন কক্ষ থেকে। ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল।
ভারত একটি বড় বাজার এমেরিকার জন্য; সমরাস্ত্র থেকে প্রসাধন সামগ্রী সবই বিক্রি করা যায় এই বাজারটিতে। জো বাইডেন তাই ভেতরে-বাইরে চাপ নিয়ে মোদীর সঙ্গে শিষ্টাচার দেখান; সম্মান দেখাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কিছু রুটিন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার প্রশ্নে মোদির “ডিনাইয়াল” আরো বিক্ষুব্ধ করে তোলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিক ও মানবাধিকার নেতাদের। সি এনএন-এর খ্যাতিমান সাংবাদ খ্রিস্টিনা আমানপোরের সঙ্গে এক আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বারাক ওবামা স্পষ্ট করেই বলেন, ভারতে এই সংখ্যালঘুর নির্যাতন শুধু মুসলমানদের জন্যই নয়; হিন্দুদের জন্যও চিন্তার বিষয়। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে সংখ্যালঘু নির্যাতন শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের অখন্ডতার জন্য হুমকি হয়।
গার্ডিয়ানে মোদীর ভারত নিয়ে বিশ্লেষণ ছাপা হয়েছে; সেখানে সুইডেনের একটি গবেষণা সংস্থাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ভারত আর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিবেচিত নয়। এটি “ইলেক্টরাল অটোক্র্যাসি”। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গণতান্ত্রিক সূচকে ক্রমশ নীচে নেমে যায় ভারত। প্রেস ফ্রিডম সূচকে এর অবস্থান তলানিতে।
সম্প্রতি বিবিসিতে মোদির গুজরাট গণহত্যা নিয়ে প্রচারিত প্রামাণ্যচিত্র থেকে বোঝা যায়; ইয়োগা করে মোদীজী হাতের রক্তের দাগ মুছতে পারেননি। মোদির ক্যাশিয়ার খ্যাত আদানির ব্যবসায়িক দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট আদানির ধন-সম্পদ রাতারাতি কমিয়ে দিয়েছে।
ফলে ওয়াশিংটন সফরে “স্বামী কেন আসামী” হয়ে মোদী নিজের অবস্থান সমুন্নত রাখতে এতো ব্যস্ত ছিলেন; যে স্ত্রী’র অনুরোধ পত্রটি পড়ে শোনানোর পরিবেশই পেলেন না যেন।
ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশে স্ত্রী’র মায়ার খেলার বন্দোবস্ত হবে কীনা! সামনে বছর খোদ ভারতে স্বামীর গেরুয়ার খেলা আর চলবে কীনা; এসব অনেক দুঃশ্চিন্তা এখন লীগ-বিজেপির সংসারে।
“বিশ শতকের মহাপ্রয়াণে স্মরণযোগ্য ইহজাগতিক প্রেম নেই।” তবে বিজেপি ও লীগের প্রেমগাথা দক্ষিণ এশিয়ায় উপকথার মতো করে রয়ে যাবে নিশ্চিত। এখনো ঘুমের ঘোরে সহমত ভাই ও সহব্রত দাদা ডিসেম্বরের স্বপ্ন দেখে বলে প্রতীয়মান হয়, মায়াবতী গান করছে; ক্লান্ত বিপর্যন্ত আধা-ঘুমে আধা জাগরণে থাকা দিল্লীশ্বরের তখতের পাশে দাঁড়িয়ে গাইছে, “লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া, মজনু গো আঁখি খোলো।”
এই উইন্টার ড্রিম সত্যি হয় কীনা; সময় নিশ্চয়ই তার উত্তর দেবে।
মাসকাওয়াথ আহসান, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া ও সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ