আমাদের দেশে ছয়টি মৌলিক চাহিদার মধ্যে সর্বপ্রথম হলো খাদ্য। যদিও বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর মতে,বায়ু ও পানির পর মানুষের তৃতীয় চাহিদা হচ্ছে খাদ্য । আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য প্রয়োজন। সাধারণভাবে বলা যায়, যা খাবার যোগ্য তাই খাদ্য। শুধু খাবার যোগ্য হলেই হবে না সেটা পুষ্টিকর হতে হবে। ক্ষুধা নিবারণের জন্য মানুষ যেকোন ধরনের খাবার গ্রহন করতে পারে তবে সেটা কতটুকু পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর তা অনিশ্চিত। তাহলে বলা যায়, যে খাদ্য পুষ্টিকর ও নিরাপদ নয় সেটা খাদ্য বলে গ্রহনযোগ্য হবে না। সুস্থ জাতি গঠন করতে হলে পুষ্টিকর খাদ্যের পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা হলো একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি। যার ক্রিয়া বা প্রক্রিয়া খাদ্যে উপস্থিত বিভিন্ন উপাদানের রাসায়নিক পরির্বতনকে বাধা প্রদান করে। খাদ্য নিরাপত্তার কারণে খাদ্য দ্বারা ব্যক্তির স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়না । খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্য হল এমন খাবার খাওয়া যা খাওয়ার জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর । অনিরাপদ খাদ্য রোগ এবং অপুষ্টি একটি দুষ্ট চক্র তৈরী করে। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক এবং অসুস্থদের প্রভাবিত করে। খাদ্য নিরাপত্তা বিভিন্ন জায়গায় অবদান রাখে সেগুলো হলো খাদ্য ও পুষ্টি, পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতি, বাণিজ্য ও পর্যটন,টেকসই উন্নয়ন এগুলো ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভ‚মিকা রাখে। দ্রত বিশ্বায়ন কারণে বিশে^ জনসংখ্যা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল খাদ্য ব্যবস্থার কারণে খাদ্যের নিরাপত্তার উপর প্রভাব ফেলে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য বিশে^র সকল দেশে অনিরাপদ খাদ্যের সাথে যুক্ত জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি, রোগ প্রতিরোধ এবং সেবা প্রদানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা
সুস্থ জাতি গঠনের লক্ষ্যে ২০১৩ সালের খাদ্য নিরাপত্তা আইন অনুসরণ করে ,খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি (বিএফএসএ) ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি (বিএফএসএ)-এর প্রধান দায়িত্ব ও কাজগুলি হল – খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিরীক্ষণ করা, খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, সঞ্চয়, বিতরণ এবং বিক্রয় সম্পর্কিত কার্যক্রম করা। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্যের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা । খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করা। এর পাশাপাশি শিল্প মন্ত্রণালয়ে নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এবং বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড (বিএবি) নামের প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় আইনি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য বাদে বাকিসব পণ্যের গুণগত মান ও সামঞ্জস্যের জন্য একটি জাতীয় মান নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি (বিএফসিএ) ও জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ২০১২ সালে ঢাকায় ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক হেলথ-এ একটি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করে, যা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন (আইএসও) ১৭০২৫৯ কাছে স্বীকৃত। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) খাদ্য নিরাপত্তা পরীক্ষার জন্য পাঁচটি অতিরিক্ত পরীক্ষাগারের ব্যবস্থা করেছে। বিএসআইটি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ,খাদ্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ এবং সেন্ট্রাল ডিজ্সি ইনভেস্টিগেশন ল্যাবটরিতে সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছে। বিএফএসএ ঢাকায় একটি কেন্দ্রীয় রেফারেল ল্যাব স্থাপন করার পরিকল্পনা করেছিল এবং আটটি আঞ্চলিক ল্যাব যা রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত হবে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে খাদ্যের ভেজাল এবং দূষণ (যেমন: বিষাক্ত রাসায়নিক, ভারী ধাতু, কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক, ই. কোলাই, সালমোনেলা, শিগেলা, এবং ফর্মালডিহাইড) সনাক্ত করতে ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সী ফর ইর্ন্টারন্যাশনাল ডেভোলাপমেন্ট (ইউএসএআইডি), বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি(বিএফএসএ) দ্বারা রাজধানী জুড়ে ভ্রাম্যমাণ খাদ্য নিরাপত্তা পরীক্ষাগার (শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মিনিবাস) প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। এই ভ্রাম্যমাণ গবেষণাগারগুলো প্রথমে ঢাকার মধ্যে বিভিন্ন স্থানে চালু করা হয়েছে। ক্রমানয়ে সমগ্র বাংলাদেশের সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে জনসাধারণের জন্য শিক্ষামূলক ভিজুয়্যাল এবং টেলিভিশন স্ক্রীনে খাদ্য নিরাপত্তামূলক বিজ্ঞাপন প্রচারিত করা হয়। যাইহোক, বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি (বিএফএসএ)-এর ফুড লাইসেন্স এবং রেজিস্ট্রেশনের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, যা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) দ্বারা পরিচালিত হয়। সুতরাং, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়নে সমন্বয় করতে বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি (বিএফএসএ) এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)উভয়কেই সহযোগিতা করতে হবে।
আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের। তারা অনেকাংশে রাস্তার খাবারের উপর নির্ভরশীল। সাশ্রয়ী মূল্যে রাস্তার খাবারগুলি খেয়ে শহরের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ভোক্তারা খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যে বিষক্রিয়ার বিজ্ঞপ্তির সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এটি আংশিকভাবে আধুনিক খাদ্য উৎপাদনের পরিবর্তন, আধুনিক জীবনধারার প্রভাব, খাদ্য গ্রহণের পরিবর্তন এবং নতুন রোগজীবাণুর উদ্ভবকে দায়ী করা যেতে পারে। ভোক্তা জ্ঞান এবং মনোভাব খাদ্য নিরাপত্তা আচরণ এবং অনুশীলনকে প্রভাবিত করতে পারে । বাংলাদেশে প্রচলিত কৃষিকাজে প্রাকৃতিক সারের ব্যবহার কমিয়ে বর্তমানে কৃষকেরা কৃত্রিম সার ও কীটনাশকের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।এর ফলে অনেক মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত বিপত্তি ঘটেছে, খাদ্য নিরাপত্তার সাথে আপস করেছে ।
বাংলাদেশের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো খাদ্যে ভেজাল দমন করা। ব্যবসায়িক খাতে অধিক লাভের আশায় বিভিন্ন প্রযুক্তি-ভিত্তিক নতুন পণ্যের সাথে, বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন, অনুপযুক্ত মিডিয়া কভারেজ এগুলো কারনে একটি নির্দিষ্ট খাদ্যসামগ্রী নির্বাচন করা চ্যালেঞ্জিং বিষয়।এসবের প্রাথমিক শিকার হল একজন গ্রাহক। যিনি ভেজাল খাবার গ্রহণ করেন এবং এই ধরনের দুর্নীতির মূল্য পরিশোধ করেন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার খাদ্য নিরাপত্তা আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করেছে । বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং এর অধিকাংশ জনসংখ্যার জীবিকা কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষির গুরুত্ব সত্ত্বেও, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব এবং ভূমি ক্ষয়ের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি উদ্বেগের বিষয় যেখানে দেশে ভূমি এলাকা সীমিত। দুটি উপাদানের অধীনে খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি নির্ভর করে: ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতির প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়েছে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা জনসংখ্যার আর্থ-সামাজিক স্তর দ্বারা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সক্রিয় হস্তক্ষেপের জন্য খাদ্য ঘাটতির ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে ।
খাদ্য, পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য সরকারের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এনজিও ও ইন্টারন্যাশনাল এনজিও অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ঠিক রাখতে হলে সরকারের বিভিন্ন আদেশ বিধি নিষেধ মেনে চলা সাথে সেগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করতে হবে। পুষ্টিকর খাদ্যের প্রাপ্যতা সহজলভ্য করতে হবে। কৃষিকাজে প্রাকৃতিক সারের ব্যবহার বাড়ানো জন্য উৎসাহ দিতে হবে। ভোক্তাদের বিভিন্নভাবে খাদ্য নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি রাস্তার খাবারের দোকানগুলোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলার জন্য উৎসাহিত করতে হবে
লেখক
আতিয়া রহমান (গবেষণা সহকারী)
এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট
ডাঃ মোঃ শামীম হায়দার তালুকদার
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট