মাসকাওয়াথ আহসান
ওয়াশিংটন থেকে উড়ে আসা মায়াবন বিহারিনী উজরা জিয়াকে নিয়ে ফেসবুক যখন মশগুল; তখন নিউজফিডে একটা পোস্টে একজন লিখলেন; আমার প্রিয় একজন মানুষের মৃত্যু সংবাদ।
এরপর আর কোন খবরে নেই তিনি; দেশের দৈনিক বড় বড় আলো যখন অন্ধকার বতস্যকে মহামানব বানাতে ব্যস্ত ; তখন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের মুক্তিযোদ্ধা আশফাকুর রহমান খান নীরবে প্রস্থান করলে; এই জিডিপি ঝুমুর পায়ে উদবাহু নৃত্য করতে থাকা স্মার্ট বাংলাদেশে সেটা কোন খবরই নয়।
কিন্তু আমি থমকে যাই। ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর সকাল নয়টা; আওয়ামী লীগের হরতালে হেঁটে হেঁটে সিভিল সার্ভিসের প্রথম পোস্টিং জাতীয় বেতার ভবনে গেলাম কাজে যোগদান করতে। শেরে বাংলা নগরের ঐ জীবন গৃহের লবিতে বসে অপেক্ষা করছিলাম আঞ্চলিক পরিচালক মহোদয় আসবেন।
তিনি এলেন হেঁটে হেঁটে; আশফাকুর রহমান খান; অভিজাত; কারটিয়াস, ভরাট কন্ঠের একজন আপাদমস্তক শিল্পী যেন। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন উনার কক্ষে। পকেট থেকে টাকা বের করে অফিস সহকর্মীকে দিলেন চা আর বিস্কিট আনতে। বললেন, হরতালের কারণে মিষ্টির দোকান বন্ধ; তাই এই অফিসে প্রথম দিনে তোমায় মিষ্টিমুখ করাতে পারলাম না।
আশফাক খা্নের মতো ঢাকার শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রিয় পরিবারের ছেলেরা সি এসপি হবার সামাজিক দাবীকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে রেডিও ম্যান হয়েছিলেন। ফলে বিসিএস হিসেবে এই অভিজাত শিল্পগৃহে আমি মানানসই কীনা আমার সন্দেহ হচ্ছিলো। আশফাক খান মাঝে মাঝে তাঁর কক্ষে আসা লোকেদের সঙ্গে যেভাবে হেসে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন; সে ছিলো এক অভাবনীয় দৃশ্য; ঢাকার আইভরি টাওয়ার ঘেরা বিষণ্ণ শহরে।
ঐ সময় ঢাকা বেতারে এন্টি বিসিএস সেন্টিমেন্ট ছিলো সিনিয়র আধিকারিকদের মাঝে। এই যে বিসিএস বলেই একদল অভিজ্ঞ সংস্কৃতিপ্রবণ কোমল মানুষের প্রশাসক হিসেবে বিসিএস অফিসার বসিয়ে দেয়া; যে হয়তো এগ্রিকালচার পড়ে কালচারের ব্যবস্থাপক হয়ে পড়লো। কিংবা প্রশাসক ও পুলিশ হতে না পেরে সেই ঝাল মিডিয়া প্রশাসনে ঝাড়তে থাকলো।
এক প্রোমোটি বৃদ্ধ তখন প্রশাসন দেখতেন; তিনি আমাকে শুনিয়ে বিসিএসদের গালি দিলেন। আমি উপভোগ করলাম। এ খবর আশফাক খানের কাছে পৌঁছালে উনি নিজে এসে আমায় বলেন, ঐ লোক পড়ালেখাটা জানে না। এমএলএসএস থেকে প্রমোশন পেতে পেতে শেষ বয়সে অফিসার হয়েছে।
আশফাক স্যার জাতীয় বেতার ভবনের প্রত্যেকের ভালোমন্দ দেখতেন। প্রোগ্রাম মিটিং-এ দরাজ গলায় যখন কথা বলতেন; মনে হতো উনি বুঝি নন্দতত্ত্বের ক্লাস নিচ্ছেন।
আবিষ্কৃত হলো নিউ ইস্কাটনে আমি যে বাসায় গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকি; সেখানেই উনি সেকেন্ড ফ্লোরে থাকতেন। উনি সকালে অফিসে যাবার সময় আমায় সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কোনদিন আমি ঘুমিয়ে থাকলে, উনি বলতেন; ও ক্লান্ত বোধ হয়; ঘুমাক তাহলে; আমি গিয়েই গড়িটা পাঠিয়ে দেবো!
আমার আব্বাও কোনদিন আমার ঘুমের এতোটা পরোয়া করেননি। আম্মাকে বলতেন ওকে তোলো, যে শুয়ে থাকে; তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে।
আশফাক স্যারের কাছে ঢাকার শিল্প সংস্কৃতির জগতের সোনালী দিনের গল্প শুনতাম অফিসের অবসরে। কীভাবে বিউটি বোর্ডিং কিংবা রেকসের আড্ডার কবি সাহিত্যিকদের উনারা ধরে আনতেন শাহবাগের বেতার ভবনে। আড্ডার পরিবেশ দিতেন তাদেরকে রীতিমতো সিঙ্গাড়া চা খাইয়ে।
উনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গল্প করতেন; কলকাতার অগ্নিঝরা দিনগুলোর চ্যালেঞ্জিং দিনরাত্রিগুলোর গল্প বলতেন। ৭ই মার্চের ভাষণ রেডিও পাকিস্তান থেকে সম্প্রচার না করতে দিলে; রেকর্ডকৃত ভাষণের টেপ ঠিকই পরে রেডিও পাকিস্তান থেকে বাজিয়ে দিয়েই; গেরিলা এই ব্রডকাস্টিং যোদ্ধা; ঋজু রেডিওম্যান পালিয়ে গিয়ে যোগ দেন কলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতারে। মুক্তিযুদ্ধকালে তার কন্ঠ শুনে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্দীপিত হয়েছেন; দেশের মানুষ মুক্তির আশায় বুক বেঁধেছে।
এই রেডিও ম্যানের ঘর সংসার ছিলো যেন রেডিও; ফলে বৈষয়িক চিন্তার সময় ছিলো না তাঁর। অভিজাত পরিবারের ছেলেরা সাম্য স্বপ্নের ঘোরে যেমন আরবান নক্সালাইট হতো; আশফাক ও তাঁর প্রজন্মের রেডিও নেশা যেন ছিলো ঠিক তেমনি।
চাকরি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উনি দায়িত্বে ছিলেন অবিচল; আমি কোনদিন তাঁকে কারো সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখিনি। না হেসে সম্ভাষণ জানাতে দেখিনি। তাইতো রেডিওতে আসা সব শিল্পীর কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় আশফাক ভাই।
উনি অবসরে গেলেও আমি উনাকে স্পেশাল শো উপস্থাপনার জন্য আমন্ত্রণ জানাতাম। উনার দরাজ সোনালী কন্ঠ; সিঙ্গাড়া চায়ের ফাঁকে উনার কোমল আড্ডা; স্নেহের আস্কারা; স্বপ্ন উস্কে দেবার নিষ্ক্রিয় শিল্প; এইসব কিছু মিলিয়ে; আমার জীবনে তিনি একজন আনন্দভূক রেডিও-ম্যান।
রাষ্ট্র উনাকে স্বাধীনতা পদক দিয়েছে; অনেক শব্দ সৈনিক সে পদক পাননি। এসব পদক টদকে কিছু এসে যায়না। আশফাকুর রহমান নিজেই ছিলেন আমাদের জন্য এক স্বপ্নদায়ী পদক। সাদাসিধে ভঙ্গিতে রেডিও করিডোরে কিংবা স্টুডিওতে হেঁটে বেড়ানো এক স্বপ্নের সওদাগর। আরেকজীবনে আমি উনার দেখা পেতে চাইবো। সেই অপেক্ষায় রইলাম।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া