লুৎফুল কবির রনি:
যে কোনো মাধ্যমেরই শিল্পী হলে দীর্ঘশ্বাস বাড়ে। ভেতরে ভেতরে বাড়ে একাকীত্ব। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। কিন্তু ভেতরে বাড়তে থাকে এর বোঝা।
– ঋতুপর্ণ ঘোষ
ঋতু বলেছিলেন….
‘আমি কোনো দিনই নিজেকে পুরোপুরি নারী মনে করতে চাইনি। হতেও চাইনি। ছোটবেলা থেকেই তো প্রচুর টাকা রোজগার করেছি রে বাবা! অনেকে সেক্স চেঞ্জ করাতে চেয়েও পারে না টাকার কারণে। আমার তো তা হয়নি কখনো। বিজ্ঞাপনে যখন কাজ করতাম, এখন যা করি তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা রোজগার করতাম। কিন্তু সচেতনভাবে সেক্স চেঞ্জ করা থেকে দূরে থেকেছি। প্রচলিত জেন্ডার আইডেনটিটি থেকে বের হয়ে নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেও পেরেছি আমি।’
আসলেই তাই, ঋতু নিজেকে প্রচলিত যৌনতার, নারী-পুরুষের সীমাবদ্ধ সীমারেখার ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।
ঋতু রূপান্তরকামী না, হিজড়ে না, নারী না, পুরুষ না- ঋতু কোনোটিই না। ঋতু মানুষ ছিলেন। শুধু মানুষ। মানবিক একজন মানুষ। প্রচলিত জীবনের বোধ ও যৌনতার সীমারেখা অতিক্রম করে যে মানুষ দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। দাঁড়াতে পেরেও ছিলেন যিনি, তিনিই ঋতুপর্ণ ঘোষ।
চোখের বালি থেকে ঝরে গেছে গোলাপের পাপড়ি-
নৌকাডুবির শেষে মাঝিও আর ফেরেনি গ্রামে,
চিত্রাঙ্গদা রূপে আমাকে ছু্ঁয়ে যাওয়া নারী-
চিঠি বুকে ঘুমিয়ে আছে ঋতুপর্ণ নামে।
আজকের দিনে সিনামা জগতের এক নক্ষত্র ঋতুপর্ণ ঘোষ আমাদের ও সিনামা জগত ছেড়ে চলে গিয়েছেলেন।ঋতুপর্ণ ঘোষ দশ বছর ধরে ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিস মেটিলাস টাইপ ২) রোগে এবং পাঁচ বছর ধরে প্যানক্রিটিটিস রোগে ভুগছিলেন। এছাড়াও তাঁর অনিদ্রা রোগ ছিল এবং সেই জন্য তিনি ঘুমের ওষুধ খেতেন। ডাক্তারদের রিপোর্ট অনুযায়ী, অ্যাবডোমিনোপ্ল্যাস্টি ও ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পর প্রয়োজনীয় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করাতে গিয়ে তাঁর শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। আরেকটি প্রেমের গল্প ছবিতে এক সমকামী চিত্রপরিচালকের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য তাঁকে এগুলি করাতে হয়েছিল।
৩০শে মে, ২০১৩… পঞ্চাশ ছোঁয়ার তিন মাস আগেই কলকাতায় নিজ বাড়ি “তাসের ঘর“-এ ঘুমের মাঝে চিরনিদ্রার দেশে চলে গেলেন ঋতুপর্ণ। ক্যামেরার পেছনে, ক্যামেরার সামনে, স্টুডিওর বাইরে যার কর্মজীবন আর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সরব ছিলো সারা পৃথিবী, তার এমন নীরব প্রস্থান মেনে নিতে কষ্ট হয় বৈকি। কিংবদন্তী পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিকের বেশিরভাগ কাজই সমাদৃত হয়েছে তার মৃত্যুর পর। তিনি তার সময়ের চে এতটাই এগিয়ে ছিলেন যে, পৃথিবী তার চিন্তাধারার সমকক্ষ হতে অনেকটা সময় নিয়ে ফেলেছে। ঋতুপর্ণের সাথেও বুঝি এমনটাই হয়েছে। তার সৃষ্টি অনুভব করার জন্য পৃথিবী হয়তো এখনো যথেষ্ট প্রস্তুত হয়নি। কিন্তু তাই বলে তিনি হারিয়ে যাবেন না।দর্শকদের অন্তরে মননশীলতার দোসর হয়ে থাকবেন আবহমানকাল জুড়ে।
বাঙালি মোটাদাগে সিনেমা বলতে বুঝতো বেদের মেয়ে জোৎস্নাকে, বিনোদন যেখানে সব। একটু উঁচুদরের দর্শক যারা, তাদের কাছে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালরা আবার পূজনীয়। তারা জীবনের গল্প বলেছেন ভদ্রস্থ ভঙ্গিমায়, তাতে বাঙালি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ঋতুপর্ণ এলেন, নিজস্ব একটা সিগনেচার তৈরী করলেন। বাঙালির তো আবার নতুনত্বে অ্যালার্জি, তারা বরাবরের মতোই ছি ছি করে উঠলো। ঋতুপর্ণ তার সিনেমায় গল্পের প্রয়োজনে যৌনতাকে এনেছেন। এনেছেন ট্রান্সজেন্ডার রিলেশনশীপকেও, বাঙালির কাছে যেটা ‘ঘোরতর পাপ!’ বাঙালি মুখে হাতচাপা দিয়ে আঙুলের ফাঁক গলে তাকিয়ে সেসব দেখেছে, তারপর মন খুলে খিস্তি দিয়েছে। মেতে উঠেছে ব্যক্তি আক্রমণে।
তাতে অবশ্য ঋতুপর্ণ ঘোষকে দমানো যায়নি। ছেলেবেলাটা যার সিনেমার সঙ্গে কেটেছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটা বছর যিনি সিনেমা খেয়েছেন, সিনেমা পরেছেন, সিনেমাকে গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়েছেন- তাকে নিজের স্টাইলে গল্প বলা থেকে রুখে দেবে, এমন সাধ্যি কার? হ্যাঁ, সেন্সরবোর্ডের কারণে একটা প্যারামিটার তো মেনে চলতেই হয়েছে। কে জানে, আজকের মতো ওপেন ওয়েব প্ল্যাটফর্ম পেলে ঋতুর সাহসের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সবটার দেখা হয়তো মিলতে পারতো! ঋতু জানতেন, বাঙালি তাকে ঘৃণা করতে পারে, অবজ্ঞা করতে পারে, কিন্ত উপেক্ষা করতে পারবে না। পরিচিতজনদের গর্ব করে বলতেনও- ‘এই শহর না আমায় নিতে পারবে, না ফেলতে পারবে!’
পথের নানান বাঁকে চেনা অচেনা প্রশ্নের মাঝে আমাদের রেখে চলে গেছেন তিনি। ওখানেই তাঁর বাহাদুরি। কিছু চাপিয়ে দিতে চাননি কোথাও, মেনে নয়, মনে নিতে বাধ্য করেছেন। বলেছিলেন কলকাতা তাকে কখনই বুঝে উঠতে পারবে না, আবার ভুলতেও পারবে না। কোথাও কোথাও নৈরাশ্য ঘিরেছিল তাঁকে। আজকের ঋতুপর্ণ পাগল কলকাতার মানুষ, বিশ্বের মানুষ, জানিয়ে দিচ্ছে তিরিশে মে-র কলকাতা কেমন করে সিনেমার ইতিহাসে অকাল বাদলের নিঃস্বতাকে ভরিয়ে তুলল। বিশ্বের বৈচিত্র্যের-মাঝে যিনি অদ্বিতীয়, নিখিলেরে নিশিদিন করে দূরে থেকে আজ তিনি আমাদের সবচেয়ে প্রিয়।
লড়াই করে আমাদের পরাণ জেতার খেলায় তিনি জয়ী। টলিউড থেকে বলিউড যে কোনও অভিনেতার কাছ থেকে নিজের দাবিগুলোকে টেনে বার করে আনার ক্ষমতা তাঁর ছিল। তাঁর নিজের ভিতরের মানুষ যেদিন নিজের শরীরের ভাষা বদলাতে চাইল, মন চাইল নিজের শরীর বদল করে কাজল চোখে, কেতাবি জোব্বায় আর পাগড়িতে রঙিন করতে সেদিন ঝড় উঠেছিল। তিনি তাঁর পরোয়া করেননি। তিনি ঝড়কে সাথি করেছিলেন।
কিছু মানুষের খেলা মৃত্যুর পরও আবহমানকাল ধরে চলতে থাকে। ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁদের একজন।
তিনি যেমন ধরিয়ে দেন বাঙালি জীবনের ‘উৎসব’, তেমনই চিনিয়ে দেন বাঙালির ‘অসুখ’। গতানুগতিক ফর্মুলা বদলে ভিন্ন ধারার এমন একটি সিনেমা দেখে দর্শক যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। সমালোচকদের প্রশংসা তো কুড়ালোই, বাণিজ্যিক সাফল্যও পেল সিনেমাটি।
ছোট্ট একটি দৃশ্যের মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করতেন দ্বন্দ্ব। দর্শককে নিয়ে যেতে পারতেন ভাবনার সিঁড়িতে। ঋতুপর্ণ শুধু একজন প্রতিভাবান পরিচালকই ছিলেন না, তিনি চিত্রনাট্যকার, গীতিকার এবং অভিনেতা হিসেবেও ছিলেন সফল।
কালের নিয়মে উল্টে যায় ক্যালেন্ডারের পাতা , আরও এক ঋতুহীন দিন আসে বাঙালির সামনে ৷ বছর সাতেক আগে এমনই এক মনখারাপের মেঘলা দিনে আচমকা বেজেছিল খেলা শেষের বাঁশি ৷ চলে গিয়েছিলেন বাংলা সিনেমার ‘দোসর’ ঋতুপর্ণ ঘোষ ৷
ঋতুদা, শুধুই চলচ্চিত্র কে ভালোবেসেই সিনেমা করতেন না, তিনি ঘর করতেন চলচ্চিত্র র সাথে।
ফিরবেনা তা জানি
তবু তোমার পথ চেয়ে
জ্বলুক প্রদীপ খানি …..
ঋতুপর্ণ ঘোষ বলতেন, শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় নাএই বামন সমাজে ঋতু অতিকায়, যার উচ্চতা আকাশছোঁয়া, ফলে ঋতুকে আমাদের কাছে কদাকার লাগার, ভাবার যথেষ্ট কারণ ও সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমাদের বনসাই মগজের চিন্তায় উদার আকাশে সম্মানের মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ঋতুপর্ণ ঘোষের কিছুই যায় আসেনা।
বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশের অনেকটাই জুড়ে আছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। এভাবেই বেঁচে থাকবেন তিনি, যতদিন বাংলা চলচ্চিত্র থাকবে, যতদিন পর্যন্ত বাঙালি থাকবে।
কিছু মানুষের খেলা মৃত্যুর পরও আবহমানকাল ধরে চলতে থাকে। ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁদের একজন।
ছটা ঋতুর ঋতুচক্রে
সবাই তো ফিরে আসে
আর একটা যে ঋতু ছিল
মেঘ পিওনের ছদ্মবেশে।
সে যে আর খেলায় নেই
হঠাৎ অসুখ, মৃত্যুশোক
রেনকোটে ফের বৃষ্টি নামুক
নৌকাডুবি মিথ্যে হোক।
এক সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ বলেছিলেন, আমার শহর আমাকে বুঝতেও পারেনি, আমাকে এড়িয়ে চলতেও পরেনি। সবসময় তিনি তার সৃষ্টি ও জীবন নিয়ে আলাপ-আলোচনা, সমালোচনা এবং গুজবের বিষয়বস্তু হয়ে থেকেছেন। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর ঋতুপর্ণ ঘোষ নারী বা পুরুষবাচক লিঙ্গীয় পরিচয় সম্পূর্ণ অস্বীকার করে জনপরিসরে হাজির হয়েছেন। নারী বা পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় তেমন পোশাকও পড়তেন না। যদিও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত টুইটারে জানিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ নারী শরীর নিয়ে মরতে চেয়েছিলেন। কামনা-বাসনাময় যে মানুষ্য জীবন তিনি যাপন করেছেন অকপটভাবে তার চলচ্চিত্র ভাষ্য নির্মাণের মাধ্যমে শিল্পী ও তার শিল্পর দূরত্ব যেমন তিনি ঘুচিয়েছে, আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি দাবি করেছেন, প্রবল পুরষতান্ত্রিকতার লিঙ্গীয় রাজনীতিকেও চ্যালেঞ্জ করে গেছেন।