মাসকাওয়াথ আহসানঃ
হানোফারে শরাফ ভাই-লিপি ভাবীর আলোর আড্ডায় দেখা হয়েছিলো সাব্বির খানের সঙ্গে। এর আগে সে আমার ইমেইল বন্ধু ছিলো। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক হিসেবে আন্দোলনের আপডেট পাঠাতো ইয়াহু গ্রুপ মেইলে। কখনো আলাদা ইমেইল; ডয়চেভেলেতে প্রচারের জন্য প্রেস রিলিজ।
ঢাকায় অমর একুশে বইমেলায় জাহানারা ইমাম আমাদের ‘স্পন্দনের স্টলে’ বসতেন। উনার আন্দোলনের লিফলেট বইমেলায় বিতরণ করতাম আমরা। উনার বই বিক্রি করতাম স্পন্দনে। যেহেতু স্পন্দনের সবাই জাসদ ছাত্রলীগের; আর আমি দিনের বেশিরভাগ সময় তাদের সঙ্গে; কাজেই আমাকে উনি জাসদের ছেলে ভাবতেন। কিন্তু এক দুপুরে স্টলে একা থাকায়; উনাকে বলেছিলাম, আমি কিন্তু তৃতীয় শক্তি। উনি বলেছিলেন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি তো আওয়ামী লীগ নয়; শেখ হাসিনা আমাদের কযটাকে সমর্থন করেন। আর খালেদা বিরোধিতা করেন। আমার বন্ধুরা ‘আম্মা’র মৃত্যুঞ্জয়ী স্কোয়াডের সদস্য ছিলো। কিন্তু আমি যেহেতু ইউনিভার্সিটিতে গোলাগুলি হলেই ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের সেমিনারে টেবিলের নীচে ঢুকতাম; বন্ধু মামুন সেটা বুয়েট-ডিএমসি ও টিএসসিতে জানিয়ে দিলে; আমাকে সফট মুভমেন্টে থাকতে অনুরোধ করে আহকাম-পরাগ আর বুয়েটের নাঈম। স্পন্দন স্টলের মূল উদ্যোক্তা মেহদি নিজেও ভীতু বলে পরিচিত ছিলো; আমি ভয়কাতুরের তালিকায় শীর্ষে চলে যাওয়ায় মেহেদি হাফ ছেড়ে বাঁচে।মেহদি আর আমি; এই দুই ভীতুর সঙ্গে জাহানারা ইমাম বেশি গল্প করতেন; আমাদের নার্ডি অবস্থাটা উনি নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন।
সুইডেন থেকে সাব্বির খান যখন জানালো শাহরিয়ার কবির পাকিস্তানে আসছেন; আমাকে উনার সঙ্গে থাকতে হবে। সিভিল সার্ভিসে প্রটোকল অফিসার হবার অনুশীলন তো আছেই; সুতরাং সমস্যা কী! করাচী দূতাবাসে তখন রুহুল আলম ভাই ডেপুটি হাইকমিশনার। উনি শাহরিয়ার ভাইকে তাঁর কাজে সহযোগিতা করেছিলেন। দূতাবাসে গিয়ে শাহরিয়ার ভাইকে বাসায় নিয়ে এলাম। উনার সুটকেসে নানা এয়ারলাইনসের স্টিকার দেখে মনে হলো, আগন্তক ছবির উৎপল দত্তের পাল্লায় পড়ে গেলাম। ভয়ে ভয়ে আছি, কখন কী প্রশ্ন করেন; তার উত্তর দিতে পারি কীনা। আমার স্ত্রী শাহরিয়ার ভাইয়ের সঙ্গে সহজেই গল্প করতে শুরু করলো। একটু পরেই মনে হলো, মুনাযযা উনার ভাতিঝি; আর আমি ভীতু এক ছাত্র। কঠিন প্রশ্নের ভয়ে যে কম্পমান।
যে মানুষ বিশ্ব ঘুরেছেন, বিচিত্রার ডাকসাইটে নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন, বিশ্বসাহিত্য-বিশ্বচলচ্চিত্র-বিশ্বসংগীত যার হাতের মুঠোয়; তিনি যখন জিজ্ঞেস করেন, সুফিজমের ওপর ঐ বইটা পড়েছো! আমার অবস্থা কাহিল। উনি পাকিস্তানের বিভিন্ন সুফি কবির কবিতা কোট করছেন; মুনাযযাও অনায়াসে রিলেট করছে; কিন্তু আমি তো করাচীতে এসে ইংলিশ-ভিংলিশ নিয়ে আছি; ইউনিভার্সিটিতে পড়াই, রেডিওতে বাংলা সার্ভিস চালাই, ই-সাউথ এশিয়া তৈরির চেষ্টা করছি; ভয়েস অফ এমেরিকার আনিস আহমেদ স্যার আর সরকার কবির ভাইয়ের সঙ্গে তেত আ তেত করি; প্রেসক্লাবে যাই খুশিজল পানে; বন্ধুর বাসায় যাই ক্যারিওকি করতে।
এক বিকেলে মুনাযযা বাসায় নেই; শাহরিয়ার ভাইয়ের চায়ের তেষ্টা পেয়েছে; আমি ভাবলাম চা বাইরে থেকে আনিয়ে নিই; চা বানাতে পারিনা দেখে কিছুটা বিরক্ত কিছুটা কৌতুকের সুরে বললেন, এই ভালো মেয়েটা তোমার পাল্লায় পড়লো কী করে; বাসার সব কাজ করে, অফিস করে, রান্না করে; আর তুমি বসে থাকো প্রিন্স অফ বেঙ্গল হয়ে। আব্বার কথা মনে পড়ে গেলো, ঢাকায় নিজের এপার্টমেন্ট গুছিয়ে রাখতে না পারায় আব্বা এলে বিরক্তি ও কৌতুকে বলতেন, তুমি তোমার দাদার মতো হয়েছো; আমি তো কলকাতায় অনায়াসে ম্যানেজ করতাম কারমাইকেল হোস্টেল কক্ষ; সুন্দর গুছিয়ে রাখতাম। তোমার পড়ার টেবিলটা দেখলে মনে হয় ব্রিক ফিল্ড। চুলা ধরাতে পারিনা দেখে শাহরিয়ার ভাই নিজেই চুলা ধরালেন, চা বানালেন, আমাকে দিলেন; নিজে নিলেন।উনি নিশ্চয়ই ভেবেছেন, সাব্বির সারাক্ষণ কেন একে অত্যন্ত কাজের লোক বলে।
বুকশেলফে আমার বই দেখে পড়তে শুরু করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, উপন্যাস লেখার সময় তোমার ট্রেন ধরার তাড়া থাকে নাকি!এতো সুন্দর গল্প বলার ক্ষমতা; আরেকটু ধীরে ধীরে বলো। আমি খুলে বললাম, পাঁচ মিনিটে বিতর্ক শেষ করার অনুশীলন থেকে লেখার মাঝে এর ছাপ পড়েছে।এরপর উনি মানিক বন্দোপাধ্যায়, বিভুতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, সত্যজিত রায়ের গল্প বলার টেকনিকগুলো সম্পর্কে আলোচনা করলেন।
উনি পাকিস্তানে এসেছেন একাত্তরে যে পরিবারগুলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বন করেছিলো; তাদের কাছে রাষ্ট্রীয় দাওয়াত পৌঁছে দিতে। করাচীর আদি বামপন্থী কুট্টি ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেলেন। উনার শ্রমিকদের নিয়ে বিরাট এনজিও। সেখানে কড়া বাম নেতারা এলেন; সবাই শাহরিয়ার ভাইয়ের বন্ধু। এরপর একে একে সিদ্ধু প্রদেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা, বালুচিস্তানের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বালুচ নেতা বাজেঞ্জো ভাই বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলেন। সব আলোচনাতে সবাই একাত্তর নিয়ে অনুতাপ করে; কিন্তু শহীদের সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে। আমি রেগে ওয়াক আউট করি পীর পাগাড়ার বাড়ির আড্ডা থেকে। শাহরিয়ার ভাই বেরিয়ে এসে বলেন, রেগে গেলে কী হবে মাসকাওয়াথ! ভিন্নমত সহ্য করতে শেখো!
একাত্তর সম্পর্কে নাগরিকদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং বুঝতে উনি প্রামাণ্য চিত্র ধারণের সিদ্ধান্ত নিলেন; মুনাযযা ক্যামেরাম্যান জোগাড় করে দিলো জিও টিভি থেকে। শাহরিয়ার ভাই, তারা যে টাকা পারিশ্রমিক চায়; তার চেয়ে অনেক বেশি দেন। হুজুর টাইপের এক চিত্রগ্রাহক, সবজায়গায় হালাল ওয়াশরুম খোঁজে আর বিসর্জন স্থগিত করে; ক্যামেরা ধরে ঘামতে থাকে; আমি রাগ সংবরণ করতে পারিনি। কারণ এই শহরে সর্বত্র কমোড; আমি কোত্থেকে ভূমি সংলগ্ন প্যান এনে দেবো! শাহরিয়ার ভাই আমার রেগে যাওয়া পূরণ করলেন, আবার ক্যামেরা পারসনকে বেশি পারিশ্রমিক দিয়ে। বোঝালেন, কমোডে বসে পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে একান্ত কাজগুলো করলে তা হালাল। যা কিছু পরিচ্ছন্ন তাই হালাল।এই শহরময় মাফিয়াদের ভিক্ষুক র্যাকেট; আমি নিজে দেখেছি এক ভিক্ষুককে দামী গাড়ি থেকে নেমে চাকাওয়ালা বাক্সে বসে ভিক্ষার নাটক করতে । কিন্তু শাহরিয়ার ভাই কোন ভিক্ষুককে বিমুখ করেন না। বলেন, অনেক অসাম্য সমাজে; জীবে দয়া করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। উৎপল দত্ত আর গান্ধীজীর এমন সোনালি গড় আমি আগে দেখিনি। আমাকে ধমকালেন উর্দু না শেখায়; বললেন, এভাবে সাংবাদিকতা-উপন্যাস কিচ্ছু হবে না। মানুষের সঙ্গে তাদের ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করতে হবে।
রেকি করে দেখলাম আমরা, একাত্তর সম্পর্কে এদেশের বেশিরভাগ মানুষের ধারণা অস্পষ্ট। উনি বললেন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যেহেতু আন্তর্জাতিক সেকুলার ফোরাম; পাকিস্তানে এর কমিটি করতে হবে। আমি যেহেতু বিদেশী এখানে; সরাসরি এতে সংযুক্ত হলে ব্যাপারটা “ডেভিড বার্গম্যানে’র মতো বে আইনি কার্যক্রম হয়ে যাবে; তাই মুনাযযা এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হলো। সভাপতি হলেন, পাকিস্তান পিপলস পার্টির শীর্ষ নেতা, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার ইকবাল হায়দার। সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ফয়েজ কাজির ছেলে জাভেদ কাজি সহসভাপতি হলেন। খ্যাতিমান নৃত্য শিল্পী ও বিশেষজ্ঞ সীমা কিরমানি থাকলেন নির্বাহী কমিটিতে।
প্রেসক্লাব যেহেতু আমার উইকএন্ড আড্ডার সরাইখানা; আমাদের লিবেরেল ডেমোক্র্যাট প্যানেল প্রেসক্লাব চালায়; প্রেসিডেন্ট ফারহান আর কবি ফাজিল জামিলি সব আয়োজন করলো। অডিটোরিয়াম, লনে চাঁদোয়া টাঙ্গিয়ে হাইটি; সব জোগাড় করেছে কবি জামিলি গভীর আন্তরিকতায়। শাহরিয়ার কবিরের একুশে অগাস্ট নিয়ে তৈরি প্রামাণ্য চিত্র দেখে সবাই আক্ষেপ করলো; এতো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এমন পাকিস্তানের পথে হেঁটেছে; এ কী ভাবা যায়! পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের চোখে বাংলাদেশ শিক্ষা-সংস্কৃতির আলোয় দেদীপ্যমান দেশ। শাহরিয়ার ভাই ইনক্লুসিভ মানুষ, বললেন, ধর্ম তো অত্যন্ত সুন্দর ব্যাপার; জিহাদ তো নিজের ভেতরের নফসের সঙ্গে লড়াই; আমাদেরকে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়তে হবে। দাড়ি টুপি দেখলেই মানুষটা উগ্র; এমন ইসলামোফোবিয়া প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। তুরস্ক থেকে পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশ শান্তির ইসলামের ভিত্তিভূমি। দক্ষিণ এশিয়ায় সেই বুল্লে শাহ, শাহ লতিফ ভিটাই, জালালউদ্দীন রুমী, কবীর দাদু, লালনের ঐতিহ্য পুনরাবিষ্কার করতে হবে।
ডান সমর্থক বিবিসির এক বাঘা সাংবাদিক ঐ অনুষ্ঠানের পরে হাইটির সময় শাহরিয়ার ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে তার একটা রুপান্তর হলো। সেকুলার আন্দোলনে জড়িয়ে গেলো। জাভেদ কাজির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে এখন সে। শাহরিয়ার ভাই জামায়াত নেতা মওদুদীর ছেলের সঙ্গে মেশার পর তিনি সেকুলার ফোরাম পাকিস্তানের সক্রিয় কর্মী হয়ে পড়লেন।
উনার পাকিস্তান সফর সফল হবার পর; ফিরে যাবার আগের রাতে আমাকে নিয়ে আবার বসলেন। আমার প্রেসক্লাবের বন্ধুমহল, কবি ফাজিল জামিলি, ই-সাউথ এশিয়ার উপদেষ্টা সম্পাদক ফয়সাল সিয়ানি; চিত্রকর ও কার্টুনিস্ট ফিকা ভাই, বিবিসি ফেরত ডনের সাংবাদিক-সুফি গায়ক মুসাদ্দিক সাওয়ালের সঙ্গে গল্প করে ভালো লেগেছে। আমি যে এতো অপদার্থ নই; তা বুঝে গেছেন মনে হলো।
জিজ্ঞেস করলেন বাংলাদেশ রাজনীতি সম্পর্কে। বিএনপিকে অপছন্দ ধর্ম নিয়ে রাজনীতিকে তোষণ করায়। আওয়ামী লীগকে অপছন্দ ভিন্নমতকে গান্ধা কইরা দেয়ার গ্রাম্য অভ্যাসের কারণে। বিএনপি শাহরিয়ার ভাইকে কারাগারে নিয়েছে; সে অভিজ্ঞতা তিক্ত। কিন্তু প্রয়োজনে আওয়ামী লীগকে কড়া কথা বলতে ছাড়েন না উনি। স্পষ্টবাদী মানুষ। বহুত্ববাদী সমাজ চান। মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রতি গভীর ভালোবাসা উনার। খোদার সঙ্গে আধ্যাত্মিক যোগসূত্র পাকা তাঁর; শুধু আপত্তি ধর্মের স্বপ্রণোদিত ম্যানেজার নিয়ে।রুমীর আধ্যাত্মিকতা নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণের স্বপ্নের কথা বললেন। বিদায় নেবার সময় আরেকবার বললেন, ইনক্লুসিভ হতে হবে; সামষ্টিক সুষম সমাজই আমাদের স্বপ্ন।