মাসকাওয়াথ আহসান
সভ্য জগতের মানুষের সঙ্গে আমাদের মূল পার্থক্যের জায়গাটা হচ্ছে; সভ্য মানুষেরা অন্যতম একজন হয়ে সমাজে বসবাস করে। আর আমাদের মধ্যে কোন না কোনভাবে বিশিষ্ট হবার নেশা।
একারণেই ভি আই পি কালচারটা একমাত্র দক্ষিণ এশিয়ায় রয়ে গেছে; বিশেষ করে বাংলাদেশে।
এর মূল কারণ আমাদের সমাজে হিন্দু ধর্মের কাস্ট সিস্টেমের অধঃক্ষেপ রয়ে গেছে। মানুষের কী শ্রেণী বিভাগ হয়! মানুষ তো মানুষই; প্রত্যেকে সমান মর্যাদা ডিজার্ভ করে।
ধরুন হিন্দু ধর্মের এমন একটি লোক; তার যে কালচারাল লেভেল, বেশভূষা, মুখের ভাষা; তাতে তার বৈঠক খানায় দুই মিনিট বসা কিংবা এক মিনিট কথা বলতে ইচ্ছা হবে না; সে আমার ইনগ্রুপ নয়। কিন্তু ফেসবুকে সে মুসলমানদের গড়ে “ইতর” বলে গালি দেয়।
আবার ধরুন ইসলাম ধর্মের একটি লোক, তার যে কালচারাল লেভেল, বেশভূষা, মুখের ভাষা, তাতে তার বৈঠকখানায় দুইমিনিট বসা বা তার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলা সম্ভব না। সে আমার ইনগ্রুপ নয়। অথচ সে গড়ে হিন্দুদের “মালাউন” বলে গালি দেয়।
আমি ঐ যে কালচারাল লেভেলের কথা বলছিলাম না! ওতে অর্থনৈতিক শ্রেণী বা শিক্ষাগত যোগ্যতার স্থান নেই; আমি বলছিলাম ওদের যে বিদ্বেষ-মূলক সংস্কৃতি; ঐটির সঙ্গে আমার অপছন্দের এই সম্পর্ক। বেশভূষার সঙ্গে ধর্মীয় চিহ্ন প্রদর্শনের সম্পর্ক।
মানুষের জীবনে দুই ধরনের স্মৃতি থাকে। যারা তিক্ত স্মৃতিগুলো নিয়ত চর্চা করে; তারাই বিদ্বেষমূলক হয়ে ওঠে। আর যারা জীবনের সুন্দর স্মৃতি চর্চা করে; তারা হয় বন্ধুত্বের মানুষ।
আমি একই সঙ্গে কট্টর হিন্দুত্ববাদী, কট্টর ইসলামপন্থী ও বাংলাদেশের কট্টর প্রগতিশীলদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করি। আমি খুব ভালো করে জানি আমার মতো আনন্দময় শৈশব কৈশোর ওরা পায়নি। তাই তো বিজেপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ করে একটু আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখে; সেটা অনেক করে রেলিশ করে ওরা।
যে যৌবনের আনন্দ আমি যৌবনেই উদযাপনের সুযোগ পেয়েছি; ওরা সেই সুযোগ পেয়েছে যৌবন পেরিয়ে গেলে। ফেসবুকে বিগত যৌবনাদের লেট ইয়ুথের মচ্ছপটাই দেখছি দু”চোখ মেলে।
এদের সাইকি হচ্ছে, আরেকজনকে গালি দিয়ে সুপিরিয়র হতে চায়। এই সুপিরিয়রিটির বোধ এসেছে ইনফেরিয়র শৈশবের কারণে।
এই কারণে আমার পরামর্শ হচ্ছে, আপনার শিশুর জীবনের প্রথম দশবছর; আপনার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে একটু কষ্ট করে হলেও আনন্দময় করে তুলুন। তাহলে আর জামায়াতের তাবাররক-বিজেপির প্রসাদ আর আওয়ামী লীগের গোয়েন্দা হাজির বিরিয়ানি খাবার লোভ জন্মাবে না শিশু মনে।
এই যে ধরুন ছাত্রলীগের নেতা হাতিতে ও গাড়িতে করে ঘুরে, এর কারণ ওর দুঃখী শৈশব; অপ্রাপ্তির বেদনা।
আর আমাদের সমাজে বালক-বালিকাদের বন্ধুর মতো মিশতে শেখাতে হবে। নারীকে মহার্ঘ বস্তু করে রাখলেই; নেতা হলেই পিউ পাপিয়ার আসর বা প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মনের ঘিনঘিনে ব্যাপারটা সৃষ্টি হবে।
যে সমাজে নারী-পুরুষের মেলামেশাকে শৈশব-কৈশোর-যৌবনে বাধা দেয়া হয়; সেখানে বিকৃতি বেশি হতে বাধ্য।
আমাদের সমাজে একটা জিনিস এলারমিং; একাত্তরের খুনীকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে না মুসলমানদের একটি অংশের; গুজরাটের খুনিকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে না হিন্দুদের একটি অংশের। আওয়ামী লীগের ক্রসফায়ারকে অপরাধ বলে মনে হচ্ছে না চেতনা ধর্মের অনুসারীদের একটি অংশের।
যে মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে রিক্ত যার মস্তিষ্ক পুষ্টির অভাবে বিকশিত হয়নি; যে মানসিকভাবে দুর্বল; তার মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চেতনার কাঁপন বেশি। ইসলাম, হিন্দু , আওয়ামী লীগ ধর্মের নেতা সেজে ধর্ম ও দেশপ্রেমের স্বপ্রণোদিত ম্যানেজার হয় মানুষ আয়োডিনের অভাব থেকে। ধর্মান্ধতা ও দলান্ধতা চোখের অন্ধত্বের চেয়েও অধিক অন্ধত্ব।
হুট করে এক প্রজন্মে ধর্ম বেত্তা কিংবা ইতিহাস ও জাতীয়তাবাদ বেত্তা হওয়া যায় না। এর প্রস্তুতি লাগে। জীনগত শক্তি লাগে। মানে পরিবারে কয়েক পুরুষ ধরে ধর্ম-দেশ-মানুষ দর্শনের চর্চা লাগে। ক্লাস ওয়ান থেকে ভর্তি হয়ে ধীরে ধীরে যেমন ক্লাস টেনে পৌঁছায় মানুষ; জীন বিকশিত হয় ঠিক সেইভাবে।
একজন বাউলের মধ্যে যে দর্শনের বিকাশ দেখি; তা হঠাত আলোর ঝলকানির মতো আসেনা। তার পরিবারে লোকজ দর্শন চিন্তার উদ্ভাস থাকে। হয়তো দুই তিন পুরুষ দার্শনিক ভাবনা ভাবতে ভাবতে চতুর্থ পুরুষে এসে একজন লালন কিংবা হাসন রাজা জন্মে। আমরা হুট করে বলি গরীব কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কিংবা দুখু মিয়া। আর্থিকভাবে অসচ্ছল হলেও তাদের দুটি পরিবারে শিক্ষা ও দর্শনের চর্চা ছিলো ধারাবাহিকভাবে। ভাগ্য বিড়ম্বিত হলেও ঠিকই সুকান্ত ও দুখু মিয়া পৃথিবীর বুকে দাগ রেখে গেছেন।
ফ্রিডেরিশে নিটশে ও বার্নার্ড শ; এই খানিকটা অপ্রিয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন; যাতে মানুষ ধীরে ধীরে নিজেদের পরিবার ও সন্তান পরিচর্যা করে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে মোটামুটি একটি সুষম সমাজ তৈরি করতে পারে। কার্ল মার্ক্সের সাম্য চিন্তাকে সামাজিক গণতন্ত্রে রুপ দিয়ে জার্মানিতে কল্যাণ রাষ্ট্র রচনা সম্ভব হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থায় নিটশের চিন্তাকে খানিকটা গুরুত্ব দিয়ে।
সুতরাং ফেসবুকে হঠাত সৌদি পোষাক পরে কিংবা ভারতীয় পোষাক পরে; অথবা জিনস “পতাকা আঁকা” টি শার্ট পরে; হাতে ধর্ম গ্রন্থ বা দুইখান ইংরেজি বই নিয়ে ঘুরে তারপর এসে লোকজনকে জোর করে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের ইনজেকশান দেয়ার যে চেষ্টা; এগুলো শেষ বিচারে ড মাহফুজুর রহমানের সংগীত প্রচেষ্টার মতোই।
লোকটার একটা টিভি চ্যানেল আছে, গীতিকার-সুরকার-বাদ্য যন্ত্র-ক্যামেরা-লাইট-একশন-মিউজ সবই আছে; শুধু সুর নেই গলায়।
কাজেই ১৫ মিনিটের খ্যাতিতে গৌণ সেলিব্রেটি হুরমতী আপা এসে যে ভয় দেখান, আমার মতের সঙ্গে যাদের আড়াই ইঞ্চি মিলবে না; তাদের আনফ্রেন্ড করবো! আপার কিন্তু একচুয়ালাইজেশান দরকার। আপা বেগম রোকেয়ার মতো প্রজ্ঞাবান নন, মাদাম কুরির মতো বিজ্ঞানী নন, ভার্জিনিয়া উলফের মতো সাহিত্যিক নন, কেইট উইন্সলেটের মতো আকর্ষণীয় নন; কাজেই হুরমতী আপা ফ্রেন্ড করলেই কী আনফ্রেন্ড করলেই কী!
গ্রাম্য ব্রাণ্মণ কিংবা পীরের মতো নিজেকে ভি আই পি না ভেবে অন্যতম হয়ে বাঁচতে শেখাই সভ্যতার লক্ষণ। টি এস এলিয়ট বলেছেন, মানুষের নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার স্বভাবটাই বেশিরভাগ গোলমালের মূলে।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া