মাসকাওয়াথ আহসান
মিডিয়াকর্মী হিসেবে জীবনের প্রথম দিনটিতে জাতীয় বেতার ভবনে আমাকে স্বাগত জানান আশফাকুর রহমান খান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই অকুতোভয় শব্দসৈনিক গোলাপি রোদের মধ্য নভেম্বর সকালে বসে বলছিলেন, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করার কথা; সেই ভাষণের স্পুল নিয়ে কলকাতা পালিয়ে যাওয়ার কথা। বেতার কর্মীদের সেই পাকিস্তানশাহীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার স্মৃতির অস্থিধারণ করে যে বাংলাদেশ বেতারের অভ্যুদয়; জাতীয় বেতার ভবনে একাত্তরের শব্দসৈনিকদের সেই দ্রোহের চেতনা নিয়ে তৈরি হতে থাকে আমার সাংবাদিকতা জীবন।
মাঝে মাঝে আগারগাঁওয়ের বেতার ভবনে বসে মনে হতো; আমি যেন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্র জাদুঘর ঘুরে দেখছি। এইখানে শব্দসৈনিক মোস্তফা আনোয়ার, আশরাফুল আলম, শাজাহান ফারুক, টি এইচ শিকদার অবসর পেলেই আমাকে ডেকে চা খেতে খেতে শেখাতেন সার্বভৌম মিডিয়া কর্মী হওয়ার কলাকৌশল। এখানে একাত্তরের শব্দসৈনিক বেলাল মোহম্মদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ পুরনো কমরেডদের সঙ্গে দেখা করতে এলেই ডাক পড়ত। এইভাবে আমি সেই যে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রের প্রত্ন করিডরে ঢুকে পড়ি; সেখানে কাকতালীয়ভাবে কালুরঘাট থেকে কলকাতার অগ্নিঝরা দিনগুলোর প্রায় প্রতিটি সৈনিকের সঙ্গে চলতে থাকে চিন্তা ভ্রমণ।
এমনকি কখনো জাতীয় বেতার ভবনের মাস্টার কন্ট্রোল রুমে গেলেও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রকৌশলী আবদুস শাকের, রাশীদুল হাসান, শরফুজ্জামানের সঙ্গে দেখা হতো। তারাও বলতেন যুদ্ধদিনের স্মৃতি। কী করে কালুরঘাটে ট্রান্সমিশন শুরু হলো। পরে সেখানে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আরও হামলার আশঙ্কায়; তারা পোর্টেবল ট্রান্সমিটার নিয়ে রামগড় হয়ে ত্রিপুরায় ঢুকেছিলেন। বাগাফায় বেলোনিয়া ফরেস্ট হিলে সে ট্রান্সমিটার চালু করেছিলেন।
কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান, একাত্তরের শব্দসৈনিক বেলাল মোহম্মদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, আবদুল্লাহ আল ফারুক বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেও; সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়া যেহেতু বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন; হয়তো সে কারণেই কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ব্যাপারে ৯৬-০১ আওয়ামী লীগ সরকারের একটি অনুশীলিত নিষ্ক্রিয়তা ছিল।
কিন্তু ইতিহাস যেহেতু আংশিক হয় না; খণ্ডিত ইতিহাস যেহেতু গ্রহণযোগ্যতা পায় না; তাই কালুরঘাট থেকে কলকাতা; স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সামগ্রিক ইতিহাসটাই আমি জানতে চেষ্টা করেছি।
২০০২ সালে ডয়চে ভেলেতে যোগদানের পর বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে পাই আবদুল্লাহ আল ফারুককে। ফলে জাতীয় বেতার ভবন ছেড়ে গেলেও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ছায়া আমার মাথার ওপর থেকে সরে না। ডয়চে ভেলেতে তাই কাজ করতে শুরু করি সার্বভৌম সাংবাদিকতার স্পিরিটে। জাতীয় বেতার ভবনের আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে শাজাহান ফারুক যেহেতু আমার মেন্টর ছিলেন; তাই তিনি তার বন্ধু আল ফারুককে ফোন করে খোঁজ নিতেন আমার পারফরমেন্স সম্পর্কে। আল-ফারুক বেশ পছন্দ করতেন আমার ডেসপারেডো স্টাইলের ব্রডকাস্টিং। দুই ফারুক শিখিয়েছিলেন নৈর্ব্যক্তিকতা, বস্তুনিষ্ঠতা আর সাহস। যে ব্যাপারগুলো তারা যুদ্ধ সাংবাদিকতার কালেও অনুশীলন করে এসেছেন।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র কালুরঘাটে বেলাল মোহম্মদ ও আবুল কাশেম সন্দ্বীপ বাংলা সংবাদ, সংবাদ ভাষ্য, কথিকার দিকটা দেখতেন; ইংরেজিতে এই কাজগুলো করতেন আবদুল্লাহ আল ফারুক।
এই লেখাটা লেখার আগেও জার্মানিতে আবদুল্লাহ আল ফারুককে ফোন করে একটু যুদ্ধদিনের উত্তাপ নিয়ে নিলাম। আল ফারুক শুধু কলকাতায় বসে কাজ না করে; যুদ্ধ সাংবাদিকতা করতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেতেন। ৬ নম্বর সেক্টর থেকে তিনি ওয়ার রিপোর্টিং করেছেন। নাহ কোনো রকম ভয়ভীতি কাজ করেনি তার মনে।
আল ফারুক বলছিলেন, কালুরঘাটে আর কাজ করা যাবে না; এটা বোঝা যাচ্ছিল যখন পাকিস্তান দখলদার বাহিনী চট্টগ্রামের দখল নিয়েছিল। তাই তারা রামগড় হয়ে ত্রিপুরা চলে যান। বিএসএফ তাদের একটি ট্রান্সমিটার দিলে বিএসএফ ক্যাম্পে বসেই তারা দুটি অধিবেশন চালাতে থাকেন। পরে আগরতলায় একটি বাড়িতে তারা কাজ করার ও থাকার সুবন্দোবস্ত পান। সেটা স্টুডিওর মতো ব্যবহৃত হয়। আর অনুষ্ঠান প্রচার হতে থাকে বেলোনিয়া ফরেস্ট হিল থেকে। তিনি উল্লেখ করেন, ২৪ মে পর্যন্ত সেখানে কাজ করেন তারা। কিন্তু প্রয়োজন ছিল আরও শক্তিশালী প্রচার যন্ত্র; যা পুরো বাংলাদেশে সংবাদ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। একটা বিষয় বেশ লক্ষণীয় যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এসব সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো রকম ডিকটেশন দেননি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শব্দবন্ধের গুরুত্বের দিকটিও সেখানে।
২৫ মে কলকাতা থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যাত্রা শুরু করে। সেখানে গিয়ে পরিচিত অনেককে পেয়ে যান আল ফারুক। এতদিন অল্প কজন মানুষ যে কাজ করতেন; তখন অনেক মানুষ জুটে যায় কাজগুলো ভাগাভাগি করে করার জন্য। আর বন্ধু শাজাহান ফারুককে পেয়ে ফারুক বন্ধুদ্বয়ের সময়টাও হয়ে ওঠে খানিক আনন্দময়।
ক্রান্তি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে; এর সংগঠক কামাল লোহানীর সঙ্গে তাদের সখ্য ছিল। কামাল লোহানী কলকাতায় সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইংরেজি শাখায় ছিলেন আলমগীর কবির ও আলী যাকের।
কলকাতায় যুদ্ধ সংবাদ পাওয়ার বিশেষ সুবিধা ছিল। যেহেতু লাখো শরণার্থী এসে জড়ো হচ্ছিলেন, তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছিল সংবাদ। যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ চলছিল নিয়মিত। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বেতার কেন্দ্র মনিটর করেও পাওয়া যাচ্ছিল নানা রকম সংবাদ ও বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের নানা খবরাখবরও থাকত।
২০০৫ সালে ডয়চে ভেলেতে ‘৩৫ বছরে বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠান নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আল ফারুক। সে সময় বাংলাদেশে অনভিপ্রেত ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল। খণ্ডিত ইতিহাস আর ইতিহাস বিকৃতির দলীয় প্রবণতা থেকে ইতিহাসের মুক্তি খুঁজতে আল ফারুকের অভিভাবকত্বে নিরলস এক গবেষণার সুযোগ পাই। বেলাল মোহম্মদ, ইতিহাসবিদ আফসান চৌধুরীর সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করে আমরা চেষ্টা করি ঐতিহাসিক সত্য তুলে আনতে। কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিটি ঘোষণাই প্রচার হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে। কারণ যৌক্তিকভাবেই সুপ্রিম লিডার হিসেবে এই একটি নামই পরিচিত ছিল বিশ্ববাসীর কাছে।
বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলো ইতিহাস রচনাকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। ফলে তাদের লেখা ইতিহাসের গন্তব্য হয় আঁস্তাকুড়ে। ইতিহাস আসলে সবচেয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তৃতীয় এক শক্তি।
নৈর্ব্যক্তিকতা ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার চারুপাঠ আমি পেয়েছি একাত্তরের বেতার সাংবাদিক ও ব্রডকাস্টারদের কাছ থেকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রধান শিক্ষা হচ্ছে সময় যত প্রতিকূলই হোক, জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ। শাসক-শোষক-পরিতোষকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ প্রচারের মধ্যেই সাংবাদিক জীবনের সার্থকতা। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সৎ ও নির্ভীক হলে যে সাংবাদিক তার অমরতার আয়োজন করতে পারেন; এর উজ্জ্বল উদাহরণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র; আমাদের বাংলাদেশ সাংবাদিকতার বাতিঘর।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।