ফাতিমা তুয যাহরা ও ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার
চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের ফলে পৃথিবীব্যাপী স্বাস্থ্যসেবায় আসাযুগান্তকারী পরিবর্তনের মধ্যে সিজারিয়ান সার্জারি অন্যতম। যা, মা ও শিশুর জীবন বাঁচাতে অপরিহার্য একটি চিকিৎসা পদ্ধতি । নিঃসন্দেহে একটি জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রে সিজারিয়ান সার্জারি স্বাভাবিক প্রসবের পরিবর্তে একটি জীবন রক্ষাকারী পদ্ধতি। কিন্তু, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এর (বিডিএইচএস) এর ২০১৭-১৮ এর তথ্যমতে, দেশে সিজারিয়ান অপারেশনের হার ৩১% এ পৌঁছেছে, যা ২০১১ সালের সিজারিয়ানের হারের দ্বিগুণেরও বেশি (১৫%)। এই প্রবণতা অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের একটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি নির্দেশ করে যা স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় মা ও নবজাতকের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর উচ্চ হারের সাথে যুক্ত। কম ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার জন্য সিজারিয়ান অপারেশনের ঝুঁকি ও ক্ষতির পরিমান অনেকাংশে বেশি। বর্তমানে ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া সিজারিয়ান অপারেশনের সংখ্যা মাতৃমৃত্যু কমাতে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখতে শুধু ব্যর্থ হচ্ছে না বরং মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের জটিলতা সৃষ্টি করছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে সিজারিয়ান অপারেশনের হার গ্রাম এলাকার তুলনায় বেশি। বাংলাদেশে ২০১৭-২০১৮ সালে পরিচালিত একটি সরকারি সমীক্ষায় দেখা যায় যে শহরে সিজারিয়ানের হার ৪৪% এবং গ্রাম অঞ্চলে ২৯%। এক্ষেত্রে, অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের হার এবং এর কুফলও শহরাঞ্চলেই বেশি দেখা যায়। যার কারন হিসেবে বেসরকারি হাসপাতালের আধিক্য এবং সেসব জায়গায় চিকিৎসাসেবার নীতিকে দায়ী করা হয়। বাংলাদেশের শহরগুলোতে অনেক চিকিৎসক মায়ের শারীরিক অবস্থা এবং ভ্রূণের অবস্থান নির্বিশেষে সিজারিয়ান প্রসবের পরামর্শ দিচ্ছেন বলে প্রায়শই অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক বেসরকারী হাসপাতাল মুনাফা অর্জনের প্রবণতার কারণে মায়ের স্বাস্থ্য ঝুঁকি উপেক্ষা করে সিজারিয়ান প্রসবের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকে। কোনো কোনো সময় গর্ভবতী মা ও তাদের পরিবারের মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা লক্ষ্য করা যায় যে, সিজারিয়ান অপারেশন আধুনিক বা সম্মানজনক। এর সাথে সিজারিয়ান বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য আরেকটি কারন হল প্রসব ব্যথার ভয় এবং এই বিশ্বাস যে সিজারিয়ান অপারেশন, পেলভিক ফ্লোর পেশীগুলির জন্য কম ক্ষতিকারক। এমন কি কিছু ডাক্তার স্বাভাবিক প্রসবের ঝুঁকি যেমন পেরিনাল টিয়ার কমাতে সি-সেকশনের পরামর্শ দেন যদিও এই ঝুঁকিগুলো মা ও শিশু কারো জীবনের জন্যেই হুমকি নয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, সিজারিয়ান অপারেশনের ক্ষেত্রে, অপারেশন পরবর্তী সংক্রমণ এবং রক্তপাত মাতৃ মৃত্যুর হার বাড়িয়ে দেয়। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে প্রতি ১০০,০০০ জন্মের জন্য মাতৃমৃত্যুর হার ২০০১ ছিল ৩২২। পরবর্তীকালে ২০১৫ তে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৯৬ তে। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ গাইনোকোলজি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্স-এ প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্মদানকারি মায়েদের মৃত্যুর ঝুঁকি স্বাভাবিক প্রসবকারি মায়েদের তুলনায় বেশি। সমীক্ষাটিতে আরও দেখা গেছে যে একজন মায়ের আগের সি-সেকশনের সংখ্যার সাথে তার মৃত্যু ঝুঁকিও বেড়েছে। মৃত্যু ঝুঁকি ছাড়াও অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশনের কারনে মায়েদের মধ্যে আইসিইউতে ভর্তি, রক্ত সঞ্চালন, হিস্টেরেক্টমি ইত্যাদি জটিলতা বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় বেশি সংক্রমণ, রক্তপাত, রক্ত জমাট বাঁধা এবং দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকার ঝুঁকি ইত্যাদি কারনে সিজারিয়ান সার্জারি ভবিষ্যতে গর্ভধারণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাছাড়াও প্রসবজনিত বিভিন্ন সমস্যা যেমন প্লাসেন্টা প্রিভিয়া এবং জরায়ু ফেটে যাওয়ার ঝুঁকিও বাড়াতে পারে।
অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের ক্ষতিকারক প্রভাব শুধু মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং নবজাতকের স্বাস্থ্য, এমনকি জীবনের জন্যেও হুমকি স্বরুপ। গর্ভাবস্থার ৩৯ তম সপ্তাহের আগে জটিলতাহীন রুগীর ক্ষেত্রে সিজারিয়ান অপারেশন, নবজাতকের ক্ষণস্থায়ী ট্যাকিপনিয়া (ঞঞঘ) এবং শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা সিন্ড্রোম (জউঝ) এর উচ্চ ঝুঁকির কারন, যা নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (ঘওঈট) ভর্তির মতো গুরুতর অবস্থা তৈরি করতে পারে। গবেষণায় জানা যায়,স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম নেয়া শিশুদের মধ্যে হাঁপানি এবং অতিরিক্ত ওজনের সম্ভাবনাও বেশি। স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা এবং পুষ্টির একটি জার্নালের তথ্যানুযায়ি, বাংলাদেশে সিজারিয়ানে জন্ম নেয়া নবজাতকের মৃত্যুহার স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেয়া নবজাতকদের তুলনায় বেশি ছিল। সেই সাথে, সিজারিয়ান নবজাতকদের কম জন্ম ওজন এবং নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল। এমনকি, সিজারিয়ান প্রসব বুকের দুধ খাওয়ানোকেও ব্যাহত করতে পারে, যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ও পুষ্টি ব্যাহত করে। সিজারিয়ান শিশুরা, জন্মের সময় উপকারী অণুজীবের সংস্পর্শে আসা থেকেও বঞ্চিত হয় যা, নবজাতকের সংক্রমণ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়াতে পারে। শুধু তাই নয়, শহরাঞ্চলে অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান এবং এ কারনে সৃষ্ট বেসরকারি হাসপাতালের আধিক্যের কারনে গ্রাম অঞ্চল এবং সুবিধাবঞ্চিত এলাকাগুলোতে চিকিৎসক সংকটসহ নানাধরনের অসমতা তৈরি হচ্ছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্যে একটি বড় হুমকি।
বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান ডেলিভারি রোধ করার জন্য বহুমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে মূল সমস্যাগুলি সমাধান করতে হবে। বহুমুখী পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী এবং জনসাধারণকে সিজারিয়ানের ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত করা এবং কুসংস্কার মোকাবেলা করা যা অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করতে পারে। সেই বাংলাদেশে সিজারিয়ান ডেলিভারির উন্নত ও সময়োপযোগী মনিটরিং এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবী। বর্তমানে, সিজারিয়ান অপারেশন যথাযথ ব্যবহারের জন্য কোনও জাতীয় নির্দেশিকা নেই, এবং এগুলো প্রয়োগের কারণগুলি পর্যবেক্ষণ করার জন্যও কোনো ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে একটি জাতীয় মান এবং পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান প্রতিরোধ করার জন্য চিকিৎসকদের জবাবদিহি করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। তাছাড়া উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা সনাক্ত করতে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে, প্রসবপূর্ব সেবার মান উন্নত করার কোনো বিকল্প নেই। মাতৃ স্বাস্থ্যের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব, চিকিৎসকদের নৈতিক দ্বায়িত্ববোধ এবং সিজারিয়ান অপারেশনের সঠিক প্রয়োগই মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্যে নিরাপদ বাংলাদেশ নির্মাণের প্রথম ধাপ।
লেখক:
ফাতিমা তুয যাহরা (গবেষণা সহকারী)
এমিনেন্স এসোসিয়েট ফর সোশ্যাল ডেভোলাপমেন্ট
ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার (সি ই ও)
এমিনেন্স এসোসিয়েট ফর সোশ্যাল ডেভোলাপমেন্ট
it is an amazing article.
very detail oriented
comprehensive