কাকন রেজা
পাঁচতারা হোটেল থেকে বের হচ্ছেন দুজন মানুষ, তাদের একজন গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত। সেসময়ে আমি এবং আরেকজন, অর্থাৎ দুজন হেঁটে যাচ্ছি সামনের ফুটপাত ধরে। আমার সাথেরজনও গণমাধ্যমে কাজ করেন। পাঁচতারা হোটেল থেকে বের হওয়ার মুখে সেই গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট মানুষটি আমার সাথেরজনকে দেখে রীতিমত আবেগাকুল হয়ে উঠলেন। দীর্ঘদিন দেখা নেই এমন আক্ষেপে তাকে দারুণ বিরহ কাতর মনে হলো।
সাথেরজন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। যেহেতু শুধু নামে পরিচয় করিয়ে দেয়া তাই বোধহয় তার আগ্রহ সৃষ্টি হলো না। অনেকটা উপক্ষোর দৃষ্টিতে আমাকে দেখলেন। বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা ইদানিংকালে কর্মীদের দিকে যেভাবে তাকান আর কী। যেন বোঝাতে চান, তোদের দিন শেষ। বলতে পারেন, পরীক্ষার অটোপাশের মত। এখন ভোটে আর কর্মীদের খুব একটা দরকার হয় না। ভোটের চরম উন্নয়ন হয়েছে। যে কারণে কর্মী আর ভোটারদের উপর নির্ভরতাও বহুলাংশে কমেছে।
যাকগে. আমি মোটামুটি উপেক্ষাতে অভ্যস্ত। উপক্ষো আমার গায়ে লাগে না। কারণ আমি ওই কথাটা জানি, ‘আমাকে উপেক্ষা করা যায়, অস্বীকার করা যায় না।’ এদেশে ‘আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী’ প্রবাদটি এমনি এমনি হয়নি। এখানে আগে ‘দর্শন’টারই প্রাধান্য। অর্থাৎ অর্থ-বিত্ত, পদ-পদবী এসবই প্রথম বিচারের বিষয়।
শেখ সাদি’র রাজদরবারের সেই বিখ্যাত গল্পের মতন। রাজার দাওয়াতের খাবার তিনি যখন জামার পকেটে তুলছিলেন তখন রাজা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি খাবার পকেটে তুলছেন কেন?’ শেখ সাদি’র জবাব ছিলো, ‘খাওয়াটা পোশাকের প্রাপ্য, কারন আমি যখন সাধারণ পোশাকে এসেছিলাম তখন আমাকে রাজদরবারে ঢুকতে দেয়া হয়নি।’ অর্থাৎ রাজদরবারে শেখ সাদি’র চেয়ে পোশাকটাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
এমন প্রচলন এখনো চলমান। সাম্প্রতিক কালে আমাদের অনেক নমস্য মানুষদের চাদর বা লুঙ্গি পরার কারণে এমন বিড়ম্বনার সম্মুখিন হতে হয়েছিলো। আমারও অভিজ্ঞতা রয়েছে। এক পাঁচতারা হোটেলে গিয়েছিলাম একটি কনফারেন্সে। সাধারণত আমি জিন্স টিশার্টে স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু ড্রেসকোড না মানার কারণে আমার প্রবেশাধিকার হরণ করা হয়েছিলো। অর্থাৎ জিন্স টিশার্ট সেখানে অচল, স্যুট সেখানে ‘দর্শনধারী।’
বৃটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেও ‘স্যার সিনড্রম’ থেকে আমরা বেরুতে পারিনি। ভূখণ্ডের মুক্তি মিললেও, সঙ্গত মানসিক মুক্তি আমাদের মেলেনি। মানসিক ভাবে আমাদের অনেকেই এখনো দাসই রয়ে গেছেন। আরেকজনের কথা বলি। তার সামাজিকমাধ্যমে প্রচুর ছবি আছে বিভিন্ন ‘গুণিজন’দের সাথে। স্বভাবতই মানুষ তাকেও ‘দর্শনধারী’দের কাতারে বিচার করে।
একদিন সেই ‘দর্শনধারী’ তার ‘গডফাদার’ এর সাথে এক ‘দর্শনধারী রেস্তোরাঁ’য় বসে কফি খাচ্ছিলেন। ওহ, গডফাদার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে নিই। এখন ‘দর্শনধারী’দের আলাদা আলাদা গ্যাং সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই গ্যাংয়ের আড়ালে একজন গডফাদার থাকেন যিনি সেই গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি সাধারণত এত প্রকাশ্য হন না। যেমন, বিভিন্ন গণমাধ্যমের মালিকদের চেহারা ততটা দেখা যায় না, যতটা তার কর্মচারীদের দেখা যায়। সেই গডফাদারটি তেমনই একজন। কফির বিল এলো, দেখা গেলো একটা বিল হয়েছে। আরেকটার করা হয়নি। জিজ্ঞেস করা হলো ম্যানেজারকে কারণটা। তিনি জানালেন ওই ‘দর্শনধারী’কে চিনেন বলেই তার বিলটা নেয়া হয়নি, শুধু গডফাদারের বিলটা নেয়া হয়েছে। বোঝেন অবস্থা, ‘দর্শনধারী’র কাছে গডফাদারও ফেইল। অর্থাৎ ‘দর্শন’টাই মুখ্য, বাকি সব গৌণ।
আপনার ‘বিখ্যাতজন’দের সাথে ওঠা-বসা ক্ষেত্র বিশেষে শোয়াও থাকতে হবে। না হলে, আপনিও অখ্যাত, গৌণ। এ অবস্থার কারণেই আমাদের দেশে প্রদর্শনবাদীতার এত আধিক্য। আরেক ‘দর্শনধারী’র কথা বলি। তার সাথে এক বিখ্যাত লেখকের হাসিমুখ ছবি দেখে বললাম, উনার কতগুলি বই পড়েছেন? উনি বললেন, ‘সব বই পড়া। উনার বই বেরুলেই আমি পড়ে ফেলি।’ একটা বইয়ের নাম জিজ্ঞেস করলাম যেটা এ মেলায় বেরিয়েছে। উনি বললেন, ‘পড়েছি।’ বইটি উপন্যাস এবং তার একটি চরিত্রের বিষয়ে জিজ্ঞেস করাতেই ফেঁসে গেলেন ‘দর্শনধারী’। অর্থাৎ সেই লেখকের বই পড়ার দরকার নেই, তার সাথে ছবি থাকলেই হলো।
ঘটকের গল্পটা মনে পড়ে যায়। পাত্রীর বাবা প্রশ্ন করছেন, ‘ছেলে নামাজ রোজা করে তো?’ ঘটক জানেন পাত্র ‘পোস্ট মডার্ন’, এসবের ধারেকাছে নেই। কিন্তু চালাক ঘটকের উত্তর ছিলো, ‘আরে ছেলের নামই তো রমজান।’ বোঝেন অবস্থা।
সাহেদ, সাবরিনারা এ কারণেই সম্ভবত আকৃষ্ট হয়েছিলেন ছবি তোলার প্রতি। ‘দর্শনধারী’ হবার প্রতিযোগিতায় তারা সফলও হয়েছিলেন। যে কারণেই টিভির টকশো’র আলোচকের আসনও তাদের দখলে ছিলো। নূরুল কবীরদের মতন মানুষেরা উপক্ষিত হলেও সাহেদ ছিলেন সাদরে গৃহিত। অর্থাৎ দর্শনে বিমোহিত হয়েছিলেন টকশো’র কতৃপক্ষগণও। ভেতরে কিছু থাকুক না থাকুক উপরে ঝকমকে থাকলেই হলো।
বিখ্যাতজনদের সাথে পরিচিতি আর ছবি থাকাটা সে কারণেই জরুরি। তবে মুশকিলে পড়তে হয় অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতন হলে। তখন বোঝা যায় দামি প্যান্টের নিচে জাঙ্গিয়ার কী করুণ অবস্থা। ‘উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’ কথাটা প্রচলনের মাহাত্ম্য এ থেকেই বোঝা সম্ভব। আর আমাদের এখন নিশ্চিত ‘সদরঘাটকাল’ চলছে।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।