মাসকাওয়াথ আহসানঃ
২০০২ সালের সেপ্টেম্বর জীবনে প্রথমবারের মতো ফ্রাংকফুর্ট বইমেলা কাভার করতে গেলাম ডয়চেভেলের সাংবাদিক হিসেবে। মওলানা জালালউদ্দীন রুমীর কবিতা ও দর্শন নিয়ে একটি আলোচনায় তিল ধারণের ঠাঁই ছিলো না। এটা দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটছিলো না। পশ্চিমা দুনিয়ার বাঘা বাঘা ক্রিটিকরা রুমীর দুনিয়াকে মেলে ধরছিলেন; রুমীর ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে পড়ছিলো অডিটোরিয়াম জুড়ে। জায়ান্ট স্ক্রিণে চলছিলো হুইরলিং ডারবিশ রুমীর ধামাল নৃত্যের আবছায়া।কয়েকটি জার্মান তরুণি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে নাচতে শুরু করে।
ডয়চেভেলের জার্মান সহকর্মী কারেন ফিশার আমার হাতে ওর ব্যাগ আর রেকর্ডার গছিয়ে দিয়ে ধামাল নৃত্যে যোগ দেয়। আমাদের ঈশ্বরদীর অদূরে ছেউড়িয়ায় লালনের আনন্দগৃহে এই নাচ আমি দেখেছি। আত্মা নাচতে নাচতে পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের আকাংক্ষায় তুরীয় আনন্দে বা ট্রান্সে চলে যাবার নাচটিই সৃষ্টিকর্তাকে খোঁজার মুদ্রা। লালনের “মিলন হবে কতদিনে, আমার মনের মানুষেরও সনে” রুমীরও দর্শন। তুরস্ক থেকে সিরিয়া-লেবানন-ইরান-ইরাক-আফঘানিস্তান-পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশ; এই মানবিক সম্মিলনীর সুর; সম্প্রীতির দর্শন ছড়িয়ে আছে।
রাতে ট্রেনে কোলনে ফেরার পথে কারেন আমাকে বললো ওর রুমী অন্বেষণের গল্প। আফঘানিস্তান-ইরান-তুরস্ক; যেখানে যেখানে পায়ের চিহ্ন পড়েছে; সেইখানে ঘুরে বেড়িয়েছে সে। যুদ্ধ সাংবাদিকতায় কারেন ছিলো মানুষের পক্ষে। তাই ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশানে মানুষের ঐক্যসূত্র খুঁজেছে সে রুমীর দর্শনে। ওর মুখেই প্রথম শুনলাম, রুমী ইউরোপে বেস্ট সেলার পোয়েট।কারেন আক্ষেপ করে বলেছিলো, যুদ্ধবাজদের যদি রুমীর কবিতা পড়ানো যেতো; উহ ভাল্লাগেনা এই হানাহানির পৃথিবী।
ওয়ান ইলেভেনের পরে; ইসলামোফোবিয়া যখন ইসলাম ধর্মকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে; কট্টরপন্থী খ্রিস্টান-ইহুদিরা যখন, ইসলামকে টেররিজমের তকমা দিয়েছে; তখন কারেন এই পলিটিক্যাল হিপোক্রেসিটা সহ্য করতে পারতো না।
ওর মাঝে একটা অন্তহীন রেস্টলেস নেস দেখে বললাম, চলো কফি খেয়ে আসি। কারেন বললো, তার চেয়ে চলো বিয়ার খাই। মেয়েরা বিয়ার খেলে ক্লাস টেনের বালিকার মতো হয়ে যায়। তখন তার আব্বু-আম্মুকে মনে পড়ে; হারিয়ে যাওয়া কৈশোরের প্লেগ্রাউন্ডের দিনগুলো মনে পড়ে। কথা বলার সময় ভলিউম একটু বেড়ে যায়। কারেন “ওয়ার অন টেরর”-এর বিরুদ্ধে লেকচার শুরু করে। আশেপাশের লোক অবাক হয়ে তাকায়। কিন্তু ডয়চেভেলের মাইক্রোফোন টেবিলে দেখে আঁচ করে, এরা সাংঘাতিক; তখন নিজেদের গল্পে আবার ব্যস্ত হয়ে যায়।
কারেন আফঘানিস্তানের ভাগ্যহত মানুষের বেদনায় বুশ আর ব্লেয়ারকে শাপ-শাপান্ত করে। আমি বলি, এটা পার্স্পেকটিভের ব্যাপার। টুইন টাওয়ার হামলায় যারা মারা গেছে; তাদের স্বজনের বেদনার কথাও মনে করিয়ে দিলাম। কুরোশাওয়ার “রশোমন” ছবিটার কথা বললাম; একই ঘটনা চারজন মানুষের বর্ণনায় চার রকম। প্রত্যেকে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বোধের আলোকে যে কোন ঘটনাকে দেখে। সুতরাং সভ্যতার সংঘর্ষটাকে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-ইহুদি-বৌদ্ধ-অবিশ্বাসী সবার জায়গা থেকে দেখতে হবে।কারেন মুসলমানদের প্রতি এতো অনুরক্ত; আর রুমী মুসলমান; ফলে ভ্যান্টেজ পয়েন্ট থেকে ওয়ার অন টেররকে দেখার বিষয়ে যুক্তি দেয়ায়, সে খুব শীতল আর গম্ভীর হয়ে বলে, তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
ট্রেন চলছে, আমি রুমীর কবিতা পড়ছি মন দিয়ে। জানালার বাইরে অন্ধকার; তবু কারেন সেদিকে তাকিয়ে; যেন আমাকে দেখতে না হয়।কিন্তু বাইরে অন্ধকার হলে জানালাটা আয়নায় পরিণত হয়। ফলে কারেন আমার রিএকশান লক্ষ্য করছে। আমি নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে রুমীর কবিতা পড়ছি। জীবনে দুঃখ নাই; তবু রুমীর কবিতা এতো শান্তিদায়ী যে পড়ে মনে হয়; একটু দুঃখ থাকলে ভালো হতো। বুঝতে পারতাম কীভাবে বেদনার মাঝ দিয়ে পরমাত্মার বার্তা আসে; আর তাতে হৃদয় প্রশমিত হয়।
একটু পর কারেন আমার ব্যাগে মুখ উঁচিয়ে থাকা বইটা দেখিয়ে বলে, রুমীর কবিতা না পড়ে তোমার ঐ ম্যাকিয়াভেলির প্রিন্স বইটাই পড়া উচিত। এটা নতুন কোন কথা নয়। আমার ওপর রাগ হলে, ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের বন্ধু জুয়েল আর টিটো ব্যালকনিতে বসে আমাকে “ম্যাকিয়াভেলি” বলে ডাকতো। ওদের কিশোর কুমারের গান শোনার পূর্ণিমা রাতে আমি বিছানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি বলে। আমরা থ্রি ইডিয়টস মোহম্মদপুরে একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকতাম।। কারেনকে বললাম, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বন্ধুরা আমাকে ম্যাকিয়াভেলি বলতো।
এবার সে আনন্দে বিয়ারের বোতল ঠোকাঠুকি করে। তারপর বলে, তুমি আফঘানিস্তানে গেলে; মানুষের কষ্ট দেখলে বুঝতে আমি কী বলছি। আমি বললাম, কষ্ট দেখতে আমার আফঘানিস্তানে যেতে হবে কেন! দক্ষিণ এশিয়া তো রীতিমত কষ্টের গোডাউন। জন্ম থেকেই আমরা জ্বলছি। জন্মেছো কল্যাণ রাষ্ট্রে; তাই রোমান্টিকতা দেখাচ্ছো কষ্ট নিয়ে।আবার ফ্রাইং প্যান হয়ে যায় কারেন। আমার রাশি খারাপ। কোনদিন কোন মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে আমার লং জার্নি আনন্দের হয়নি।
এরপর এক দাড়িওয়ালা জার্মান বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে আইলের ওপাশের সিটে বসলেন। ভদকা অর্ডার করলেন। খুলে বসলেন টলস্টয়ের ছবি অলা বই। দেখলে মনে হবে যেন; টলস্টয় বসে টলস্টয়ের বই পড়ছেন।
টলস্টয় এসে যাওয়ায় আমি বড় বাঁচা বেঁচে যাই। এরপর ঘুমের অভিনয় করে কোলন পৌঁছে যাই। হয়তো একটু ঘুমিয়েও পড়েছিলাম; কারেন ডেকে তুলে। ট্রেন থেকে নেমে ট্যাক্সিতে ওঠার আগে কারেন বলে, সরি ধামাল নেচে অতিরিক্ত ট্রান্সে চলে গিয়েছিলাম। রুমীর হাত ধরে একটু ভাব এসে যাওয়ায় তোমার সঙ্গে রাগারাগি করলাম।
আমি বললাম, রেস্টলেস ভাবটা কমাও। কোথায় শান্তি খুঁজছো; শান্তি তো তোমার মাথার মধ্যে। রুমীর কবিতা উদ্ধৃত করায় সে অনেক আনন্দিত হলো। বললো, চলো আমার বাসায় যাই। বাকি রাত ব্যালকনিতে বসে গল্প করে কাটাই। আমার বুকশেলফ ভর্তি রুমী। তোমাকে পড়ে শোনাবো।
আমি বললাম, তুমি হচ্ছো সেইসব বাচ্চাদের মতো; যারা চায়; অনন্তকাল ধরে পার্টি চলবে। কেবল এলাম ডয়চেভেলেতে প্রতিদিনই তো দেখা হবে। ট্যাক্সিতে ওকে ওর বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে যাই কোবলেনসারস ট্রাসেতে আমার ডর্মে।
পরে অফিস খুললে একদিন কলকাতার ডাকসাইটে সাংবাদিক সুপ্রিয়দা কারেনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বলেন, ও এক্সসেপশনাল মেয়ে। যুদ্ধ সাংবাদিক। সুপ্রিয়দা কোন মেয়ে জার্নালিজম জানলে তাকে খুব রেস্পেক্ট করতেন। আর কাজটা না জানলে, তাদের ওপর চটে থাকতেন।
কারেন মুচকি মুচকি হাসলে; আমি গম্ভীর থাকি। কারণ আমি জানি আরো অনেকেই কারেনের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেবেন। কারণ কারেন তারকা সাংবাদিক হয়ে উঠছে। আফঘানিস্তানে গিয়ে তাঁবু খাটিয়ে ঘুমানোর মতো সাহস ওর। কারেনের সাহসিকতার জন্য সুপ্রিয়দা একবার বনে একটা ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে ট্রিট দেন। সুপ্রিয়দা কাউকে কোথাও ট্রিট দিলে আমাকে তার ছোট ভাই বলে সাথে রাখেন।
সুপ্রিয়দা অত্যন্ত পাকা লোক। আমার ধারণা কারেনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের কথা উনি জানতেন। সে কারণেই হয়তো ঐ সাঁঝে অনেক জোর করে আমাকে নিয়ে যান। কারেন রুমী শোনায়; তো সুপ্রিয়দা ফিররাখ গোরাকপুরী শোনান। শেষে তিনজন আরেকটি পানশালায় গিয়ে মির্জা গালিবের সঙ্গে দেখা করি। খোদা কোথায় নেই; কী উপাসনালয়ে; কী পানশালায়!
আগামীকাল সকালে রুমীকে আবার খুঁজতে যাচ্ছি তুরস্কে। কনিয়েতে রুমী জাদুঘরে কবির পান্ডুলিপি স্মৃতিচিহ্ন অথবা যেখানে হুইরলিং ডারবিশ আকাশের দিকে হাত তুলে বলেছেন, মিলন হবে কত দিনে! আমিও আমার “মনের মানুষ” রুমীকে খুঁজতে যাচ্ছি।