মাসকাওয়াথ আহসানঃ
বছর দশেক আগে; ফেসবুকে রাজশাহীর স্কুল ও কলেজ জীবনের বন্ধুরা ফিরে আসতে শুরু করেছে একে একে। কলেজ জীবনের বন্ধু জাবীন জাহান একদিন ইনবক্সে বললো, আমাদের রাজকলের দিনগুলো নিয়ে লিখবে না!
জাবীনের একটি বাক্য; আমাকে সেই “সংস অফ ইনোসেন্সে’র সময়ে নিয়ে গেলো; ফেসবুকে শাহরিয়ার লীন, আতিকুর রহমান লাবু, সুলতান সাব্বির রনী, মশিউর রহমান কর্ণেল, ফেরদৌসী, শাহরিয়ার আলম, দার্শনিক লিটন, মাহবুব টুংকু; রাজশাহী কিংসের সেই দাপুটে কিশোর-কিশোরীরা কে নেই! মনে হলো ভার্চুয়াল ডরমিটরিতে আছি সবাই। লীন কবিতা বলে ঘুম ভাঙ্গায়; জাবীন সমুদ্র তীরে হেঁটে সকাল ঘোষণা করে; লাবু উদ্ভাবনের ক্লাস নেয়, কর্ণেল গান করে, ফেরদৌসী মনোবিদ্যার ক্লাস নেয়, রনি আড্ডা জমায়, শাহরিয়ার আলম বন্ধুদের নিয়ে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে পৌঁছে যায়; ইমন, সিজার, আতাউল, তুর্কী, মাসুম সবাইকে দেখি গ্যালারিতে। হাসান মুনির কিশোরদের নিয়ে টেবিল টেনিস খেলে। আসাদ ফুড ফেস্টিভ্যাল করে। পেশাজীবনে সবাই ভালো করেছে; কিন্তু ফেসবুকে আমাদের সঙ্গে সবাই শেয়ার করে সেইসব সংস অফ ইনোসেন্স। এক বিন্দু বদলায়নি একটিও।
লীন ও লাবু আমাকে সেই জার্মানিতে থাকতেই জানিয়েছিলো, শাহরিয়ার আলম রাজনীতিতে নেমেছে; এলাকায় জনসেবা করছে; সেলফ মেইড ম্যান, শ্রমে ঘামে উপার্জিত অর্থ জনকল্যাণে ব্যয় করছে। এক এগারোর দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কান্ডারী শ্রদ্ধেয় জিল্লুর রহমানকে সমস্ত সহযোগিতা করছে ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে।আমি খুশওয়ান্ত সিং-এর ট্রুথ লাভ এন্ড আ লিটল ম্যালিস পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি; প্রত্যন্তের নির্বাচন কেমন হয় তা দেখতে সাংবাদিক হিসেবে নয়; প্রার্থী হিসেবে যাবো! লীন বললো, বন্ধুর সঙ্গে সেইম সাইড করে কেউ! ও কী ভাববে খোকা ভেবেছিস”? আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম, রাজনীতি আমার জগত নয়; আমি সাংবাদিকতা করতেই যাচ্ছি। তাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের গ্রিন সিগন্যাল উপেক্ষা করে, মাহী বি চৌধুরীর সঙ্গে মিডিয়া বন্ধুত্বের সুবাদে বিকল্প ধারার নমিনেশান নিয়ে নির্বাচনী কৌতুকে নেমে পড়ি। “ডার্ক হিউমার আমার স্বভাব, লীন-লাবু-শাহরিয়ার ছোট বেলা থেকে; এর পৃষ্ঠপোষক। সিরিয়াসলি করা আমার রম্য ছোট বেলায় জাবীন কিংবা আতাউল মাঝে মাঝে ভুল বুঝলেও; বাকিরা ইঞ্চি ইঞ্চি রস উপভোগ করতো।
জীবনে বিতর্কে-লেখালেখিতে-প্রেমে ও বন্ধুত্বে জিততে জিততে; আমি হেরে যাবার উপলক্ষ্য খুঁজি। নির্বাচনী মাঠে দেখা হলে, শাহরিয়ার তাই বিষণ্ণতার শহর-মঙ্গা ক্যারাভান নিয়ে গল্প করে। আমার প্রকাশিত গ্রন্থ আমার বন্ধুরা সবাই সংগ্রহ করে। লাবু ও লীন বন্ধুদের অবগত করে আমার নতুন লেখা কিংবা গ্রন্থের খবর। দুজনেই কবি; তারা বন্ধুদের সাফল্য উদযাপনের ঔদার্য ধারণ করে।ইলেকশনের দিন আমি যাইনি এলাকায়; ফলাফলের পর শাহরিয়ার ফোন করে বলে, তোমার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আমি পূরণ করবো।
আমার মাল্টিমিডিয়া অভিজ্ঞতার কারণে ও চেয়েছিলো, আমি ওর উদ্যোগে মিডিয়া গড়ে তুলি। সেটা নিজে বলেনি; মিডিয়া সংশ্লিষ্ট অন্যবন্ধুরা জানায়; দেশ ছাড়ার আগে। এসময় ই-বাংলাদেশের দায়িত্ব নিতে অমি রহমান পিয়ালও অনুরোধ করে এর উদ্যোক্তার পক্ষ থেকে।আমার তখন পায়ের তলায় সর্ষে; ইউরোপে বসে পাকিস্তান-আফঘানিস্তান-ইরাক-মধ্যপ্রাচ্য কাভার করে; ‘কি এই ওয়ার অন টেরর” তা জানার সুযোগ খুঁজছিলাম। করাচিতে ইউনিভার্সিটিতে মিডিয়া ও ফিল্ম পড়ানোর সুযোগ পেয়ে তাই চলে যাই। দূর থেকে কিছুকাল দ্য এডিটর ও ই-বাংলাদেশ চালাই।
আব্বা একদিন ফোন করে বললেন, শাহরিয়ার হেলথ ক্যাম্প করছে বাঘা-চারঘাটে; ওর আব্বা প্রবীণ হিসেবে সমাজ সেবা করছেন। খুব ভালো কাজ করছে ছেলেটি। আব্বা খুব কড়া শিক্ষক; উনি সাধারণত অনেক মুগ্ধ না হলে প্রশংসা করেন না। সবশেষে ২০১৬ সালে আমার “প্যাসেজ টু হেভেন” পড়ে তবেই বলেন, হ্যা তুমি কাজটা পারো; লিখতে থাকো; থেমো না।
শাহরিয়ার আমার অনুপস্থিতিতে লীন, হুমায়ূন রেজার সাহায্য নিয়ে মিডিয়া গড়তে এগোয়; মেধাবী সাংবাদিকদের তৈরি কনসেপ্ট পেপার আমাকে দেখায়। সবই পারফেক্ট কাজ। রাজশাহীর শিক্ষকেরা আমাদের শিখিয়েছিলেন, পারফেকশনিস্ট হতে হবে; দেয়ার ইজ নো শর্টকাট টু সাকসেস।
ফেসবুকে আমি আওয়ামী লীগ সমালোচক; ২০০২-০৬ যেমন বিএনপির সমালোচনা করে সতত হে নদ, অদ্ভুত আঁধার এক উপন্যাস লিখেছি।আওয়ামী লীগের সহমত ভাইয়েরা শাহরিয়ারের কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে, ও বুঝিয়ে বলে, গণতন্ত্রে শিক্ষিত সমালোচক শত্রু নয়; বরং বন্ধু।আমাকে নাগরিক সমাজের বন্ধুরা অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের নেতার সঙ্গে এতো ঘনিষ্টতা কেন।শেষে একদিন শাহরিয়ার আমার পোস্টে কমেন্ট করলে; নাগরিক সমাজ সেখানে তাকে নানা তিক্ত কথায় জর্জরিত করলে, আমি স্পষ্ট করি, আমরা রাজশাহী শহরে বেড়ে ওঠা ক্লাসমেট; সাংস্কৃতিক কর্মী; সুতরাং এই সামাজিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক সম্পর্কের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দাবী করে।
ঢাকা থেকে আমার সাংবাদিক বন্ধুরা শাহরিয়ারের ব্যাপারে পজিটিভ ফিডব্যাক দেয়। ওর পিতা-প্রপিতামহ এনলাইটেনড মানুষ; বিদ্যানুরাগ ওদের ফ্যামিলি ট্র্যাডিশন। ওর বাবা রেল বিভাগে কাজ করতেন। আজ ইন্টারনেট যেমন তথ্যের বাহন, রেল যোগাযোগ তেমনি এক আলোর বাহন ছিলো; তথ্য সঞ্চালনে। ফলে রেলবিভাগের লোকের সন্তানেরা শিক্ষিত হতে বাধ্য। আধুনিকতা আর ঔদার্য; রেল-সমাজের সহজাত বৈশিষ্ট্য।
শাহরিয়ারও সরকারি কাজে গিয়ে সরকারি গাড়িতে না ঘুরে ট্রামে-ট্রেনে ঘোরে; আমাকে ইনবক্সে বর্ণনা দেয়; ও যেখানে যাচ্ছে; সেখানে আমিও গিয়েছি এমন মিলে যায় কখনো সখনো; ফলে গল্প জমে যায়। দামী রেস্তোরায় না গিয়ে স্ট্রিট ফুড খায়। রাজশাহীতে আমাদের কাজই ছিলো স্ট্রিট ফুড খাওয়া। কলেজিয়েট স্কুলের রাজ স্যার আমাকে সাহেবনগরে রাস্তার ধারে পেয়াজু খেতে দেখে; রিক্সা থেকে নেমে বলেছিলেন, ধুলো-বালি না মিশলে; খাবারের টেস্ট পাওনা নাকি!
চারিদিকে যখন রাজনীতিকদের সম্পদ বাড়ছে; শাহরিয়ারের সম্পদ তখন কমছে, শিক্ষা ও মিডিয়ায় ইনভেস্ট করলে; সেখান থেকে লাভ আসা কঠিন। আর সরকারের উন্নয়ন বাজেটের অপেক্ষা করলে, এলাকার কাজে দ্রুতি আসে না; ফলে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় শাহরিয়ার। সাধারণত আমার তীব্র সমালোচনায় সে কখনো রাগ করে না; কেবল একবার বললো, আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া দিলেই তো পারো। যারা দলের কেউ নয়; স্বপ্রণোদিত হয়ে ফেসবুক গরম করছে; তাদের কথা-বার্তায় কী এসে যায় তোমার!
আমাদের রাজশাহীর কিছুটা জুনিয়র ছেলে শাহরিয়ারের কাছে এসে গাল ফুলিয়ে বলেছিলো, আমি সুচিন্তিত মতামত দিই; আর উনি একে জাস্টিফিকেশানের ধারাপাত বলে উড়িয়ে দেন। শাহরিয়ার একদিন বললো, পাভেল, ছেলেটা রাজশাহীর; ওকে ছেড়ে দাও। বন্ধুর অনুরোধে আমি আর ঐ অনুজপ্রতিমকে নিয়ে খাট্টা-তামাশা করিনা।
ই-সাউথ এশিয়ার সাংবাদিকরা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে, আমি বিভিন্ন দূতাবাসের সার্ভিস সম্পর্কে নানা পর্যবেক্ষণ জানাই। শাহরিয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়। নাগরিকেরাও কীরকম বিদেশে নাগরিকত্ব পেতে “মুসলমান হয়েও নিজেকে হিন্দু পরিচয় দিয়ে দূতাবাসে ব্লাফ দিয়ে সার্টিফিকেট নিতে আসে, এরকম মজার ছোট ছোট কেসস্টাডি জানায়। আমি বুঝতে পারি, সমস্যা দূতাবাসে কিছু কর্মীরও আছে; আবার সার্ভিস নিতে আসা নাগরিকেরও আছে। সততার ক্ষেত্রে সামষ্টিক সমস্যার কারণেই বাংলাদেশের যতদূর যাবার সক্ষমতা আছে; ততদূর যেতে পারেনি দেশটি।
আমাদের দুজনের আড্ডা বিষয় শৈশবের মতো, আর্ট-কালচার-লিটেরেচার-ট্রাভেলিং; বন্ধুদের নিয়ে রস গল্পের ইতিউতি। সবার বয়স হয়েছে; কিন্তু “রঙের মেলায়” বায়েস্কোপ দেখার নেশা যায়নি। কিছুদিন আগে রাজশাহীর ছেলেরা মাদকাসক্তির ভয়াল থাবা নিয়ে একটি টেলিফিল্ম বানানোর খবর দিয়ে শাহরিয়ার বললো, আমরা বন্ধুরা মিলে সেই ১৯৮৭ সালে টেলিফিল্ম বানিয়েছিলাম। কী নাম যেন ছিলো! আমি মনে করিয়ে দিলাম ‘ক্ষয়’। অনেক আনন্দে সে আমাদের ঐ একই বিষয়ে বানানো ‘ক্ষয়’ টেলিফিল্মের কথাটুকু লিখে; রাজশাহীর নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাতা টিমটিকে উইশ করলো ফেসবুকে।
সেদিন জাতিসংঘের এক সিনিয়র ভাইয়ের ইয়েমেনে অপহৃত হবার ঘটনায় ওর সক্রিয়তা প্রত্যাশা করায়; ও জানালো এক মুহূর্ত নষ্ট করেনি। উনার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছে। জাতিসংঘের উদ্ধার প্রক্রিয়াও মনিটরিং করছে। এই আলোচনা শেষ হতেই বললো, তোমরা তো ব্রেকিং নিউজ দেও অহোরহো; সব সময় স্পর্শকাতর ঘটনার প্রয়োজনীয় গোপনীয়তা কী রক্ষা করো! তারপর সেই রাজশাহী স্টাইলে বললো, এই কথা বলাতে তো আবার অনেক কথা শুনাবা! আমি স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে হেসে ফেললে, জানায়, মরক্কোতে এসেছি; এপারেন্টলি সুন্দর দেশ। আমি জিজ্ঞাসিলুম, ছবি দিবানা।
ফটোগ্রাফির হাত বেশ ভালো তার। কিছুক্ষণ পর একটা মসজিদের প্যানারোমিক ভিউ পেলাম।আমার মনে পড়লো কমনওয়েলথ টুরে মাল্টা গিয়ে, ফেরিতে করে কেবল ক্যাসাব্লাংকা মুভিতে দেখা সেই আলো ঝলমল সাঁঝের আমেজ নিতে গিয়েছিলাম। কয়েক ঘন্টা পর সেই ঐতিহাসিক রেস্তোরার ছবি দিলো। জানালো, ঐ বিল্ডিং-এর সামনে সুটিং হয়েছিলো মুভিটির; আর হলিউডে স্টুডিওতে স্যুট করা হয়েছিলো বেশিরভাগ। এমেরিকান এক টুরিস্ট এজেন্ট সেই মুভির মিজ এন সিন মিলিয়ে রেষ্টুরেন্ট রেনোভেট করেছেন, রেষ্টুরেন্টের প্যানারোমিক ভিউ; পিয়ানিস্টের ছবি পাঠালো। ক্যাসাব্লাংকা মুভিতে মিউজিশিয়ান চরিত্রটি ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই পিয়ানিস্টের সঙ্গে ওর একটা ছবি পাঠালো।
আজ সকালে শাহরিয়ার লীন ফোন করে, ওর লেখা কবিতার “একটি শব্দ” নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করে বললো; আজ শাহরিয়ারের জন্মদিন; ওর ওখানে যাবো একবার ভাবছি। আমাদের বয়স হচ্ছে; প্রাক-বৃদ্ধ হচ্ছি; কিন্তু বন্ধুত্বের আড্ডায় আমরা বাঁচিয়ে রাখি শৈশব; রাজকলের আনন্দযজ্ঞ।