মাসকাওয়াথ আহসান
তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপি আমাদের বলেছে ফাইনাল খেলা আগামী মাসে হবে। আমরা প্রস্তুত আছি ফাইনাল খেলার জন্য। আমরা প্রিপারেশন নিয়েছি ফাইনাল খেলার জন্য। কোথায় খেলবেন ফাইনাল খেলা বলেন। আমরা সেখানে যাব। আমরা আওয়ামী লীগ যাব না, যুবলীগকে সেখানে পাঠাব ফাইনাল খেলার জন্য। আমাদের ফাস্ট টিম পাঠাব না, সেকেন্ড টিম পাঠাব। প্রয়োজনে মহিলা আওয়ামী লীগকে পাঠাব। ওদের সাথে আগে খেলেন। তারপর আওয়ামী লীগ প্রয়োজনে আপনাদের সাথে খেলবে। যুব মহিলা লীগ যদি যেতে চায় যুবলীগ তাদের নিয়ে যেতে পারে। আমরা ফাইনাল খেলার জন্য প্রস্তুত আছি।
এর আগে তিনি বিএনপির নারী নেত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,
মহিলা নেত্রীদের সাজিয়ে রাত বিরাতে বিদেশিদের কাছে ধর্ণা দিয়ে কোন লাভ নেই।
তথ্যমন্ত্রী হচ্ছেন সরকারের মুখপাত্র। সেই সরকারের মুখপাত্র নারী সম্পর্কে একের পর এক মিসোজিনিস্ট বক্তব্য প্রদান করে চলেছেন।
কিছুদিন আগে এক তরুণ ক্রিকেটার যে ভারতের বিরুদ্ধে একটু ভালো খেলেছেন; এ ছাড়া তেমন পরিচিতি নেই তার; সেই ক্রিকেটারের অতীতে ফেসবুকে করা মিসোজিনিস্ট বক্তব্যের স্ক্রিনশট এনে ফেসবুকে প্রচার করে আওয়ামী লীগ সমর্থক একটি গোষ্ঠী।
অথচ দেশের তথ্যমন্ত্রী নারীসমাজ নিয়ে মিসোজিনিস্ট বক্তব্য প্রদান করলে “সাত চড়ে রাঁ” নেই সেই গোষ্ঠীটির।
একজন তরুণ ক্রিকেটার যার এখনো পাবলিকলি কথা বলার অভিজ্ঞতা তৈরি হয়নি; তার অতীতে লেখা ফেসবুক স্টেটাসের স্ক্রিনশট খুঁজে এনে তাকে মিসোজিনিস্ট রাক্ষস হিসেবে তকমা দিয়ে ৭২ ঘন্টা ধরে সাইবার ট্রায়াল করতে থাকা; এমনকী আজো আওয়ামী লীগের ফেসবুক প্রচারকরা সেই ক্রিকেটার বিষয়ক চেবানো চুইংগাম চিবিয়ে চলেছে; অথচ হাছান মাহমুদ এর আগে বিএনপি নেত্রীদের নিয়ে অসৌজন্যমূলক কথা বলে; গতকাল নিজদলের নারী নেত্রীদের নিয়ে অসৌজন্যমূলক কথা বলেছেন। সেক্ষেত্রে নীরব ঐ ক্রিকেটার প্রশ্নে ৭২ ঘন্টার জন্য হঠাত সভ্য হয়ে ওঠা লীগের সহমত ভাই ও শিবব্রতদাদা।
তরুণ ক্রিকেটারের সমালোচনায় ক্রিকেটার ও ইসলাম ধর্মকে একসঙ্গে মিসোজিনিস্ট বলে অভিযুক্ত করে সাইবার বুলি করেছে লীগের সহমত ভাই ও শিবব্রত দাদারা।
হাছান মাহমুদের মিসোজিনি; এমনকি তার আগে সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফরিদউদ্দীনের “বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী”-দের স্বাধীনতা প্রশ্নে তা-লে-বা-নি কালচার পছন্দ করার বক্তব্য; আর ছাত্র ও ছাত্রী উভয়ের রাতে হলে ফেরার ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক মিসোজিনিস্ট বিধান নিয়ে আওয়ামী লীগের সহমত ভাই ও শিবব্রতদাদাদের অনুশীলিত নির্লিপ্ততা খুব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে; এরা সিলেক্টিভ নারী স্বাধীনতার স্বপ্রণোদিত ম্যানেজার।
হাছান মাহমুদ ও ফরিউদ্দীন দুজন বয়স্ক মানুষ; বেশ কিছু শিক্ষা সার্টিফিকেট আছে তাদের; গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত তারা। তারা নারী সম্পর্কে এরকম আদিম দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করলে; তা সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বাংলাদেশের নারীসমাজ শিক্ষা-অর্থনীতি-বিজ্ঞান-ক্রীড়া-সমাজ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাদেরকে হাছান মাহমুদ “বি টিম” বলছেন। তিনি অষ্টাদশ শতকের সেই অচল চিন্তার লোক যারা ভাবেন, পুরুষ হচ্ছে এ টিম।
হাছান মাহমুদ ও ফরিদউদ্দীন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সহমত ভাই, শিবব্রত দাদা, সরকারি নারীবাদীদের এই নীরবতা অপরাধমূলক। এরা একটি সম্মিলিত মিসোজিনিস্ট ঐক্য।
যদি নারী অধিকার ও মর্যাদার বিরুদ্ধে কোন কথা আওয়ামী লীগের বাইরের কেউ কখনো বলেন; অথবা অতীতে বলেছেন; তা নিয়ে ফেসবুকে চুইংগাম চিবিয়ে এরা লোকজনকে ব্যস্ত রাখে সরকারের স্বৈরাচারি শাসনের বিরুদ্ধে চলমান আলাপটাকে তাদের পছন্দের বিষয়ে রাখতে; যেখানে সমালোচনাটাকে “ইসলাম”, “বিএনপি” হয়ে “মুঘল” আমল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায়।
এই নেসেসারি ইউলিশান প্যাটার্নে নরেন্দ্র মোদী সমর্থক শিবব্রতদাদাদের অংশগ্রহণ থাকে চোখে পড়বার মতো। হিন্দু তা-লে-বা-ন এসে মুসলিম তা-লে-বা-নদের গালি দিয়ে “প্রগতিশীল”-এর ভং ধরার যে ভিলেজ পলিটিক্স এই সমাজে শত বর্ষের রাজনীতি; এর ডিজিটাল রুপ আমরা খুব স্পষ্ট করে দেখি সোশ্যাল মিডিয়ায়।
ভিলেজ পলিটিক্সের লোকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা কুঁচ কুঁচ করে প্যাঁচ মারাকে “বুদ্ধি” বলে মনে করে। কিন্তু একবিংশের নাগরিক সমাজের লোকের সামনে এসব চিকন বুদ্ধি খুব সহজেই ধরা পড়ে যায়।
বাংলাদেশের মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসী গোষ্ঠীর শান্তি প্রিয় মানুষেরা এইসব ভিলেজ পলিটিক্স থেকে শতহস্তে দূরে থাকেন। তাদের কাছে নারী অধিকার বিষয়টি সহজাত। যার একটি কন্যা সন্তান আছে; তাকে কোন অর্ধশিক্ষিত ফেসবুক পিকেটারের মুখের ঝাল খেয়ে নারী অধিকার বুঝতে হয়না।
বাংলাদেশের নারী জাগরণের প্রতীক বেগম রোকেয়া, বাংলাদেশের নারী জাগরণের পত্রিকা “বেগম”-এর সম্পাদক নূরজাহান বেগম, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রাণ দেয়া বীর নারী প্রীতিলতা, মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ নারী সাংবাদিক মেহেরুন্নিসা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নাগরিক আন্দোলনের সূচনাকারী জাহানারা ইমাম, বাংলাদেশ রাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, মতিয়া চৌধুরী, আইভী রহমান, জোহরা তাজউদ্দীন, সাজেদা চৌধুরী থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতীক সেলাই বোন, কৃষক মা; বাংলাদেশ নারী ফুটবল ও ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়েরা; আজকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্রিয় সাহসী নারীরা; এরাই বাংলাদেশের “এ” টিম।
তাদেরকে “বি টিম” মনে হয় যে হাছান মাহমুদের তিনি আসলে মধ্যযুগীয় চিন্তা লালন করছেন।
এই ফেসবুকেই লক্ষ্য করুন, মহিলা আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতাদের টাইম লাইনে গেলে রুচির মোহন ছোয়া পাবেন। মনে হবে এরা মুজিবাদর্শের মানুষ। এরা স্বদেশপ্রেম ও সরকারের উন্নয়নের তথ্য এমনভাবে প্রচার করেন; যার মাঝে সুরুচি, পরিমিতি ও বাস্তববোধ আছে। মহিলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সরকারকে জনপ্রিয় রাখা বা এর গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখার পেছনে কাজ করে চলেছেন নীরবে।
আর আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে ২০০৯ সালের পর হাইব্রিড আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠা “দুধের মাছি” লোকেরা দেখবেন, দেশের মালিক সেজে সাধারণ মানুষকে ধমক দিয়ে দেশপ্রেম শেখাচ্ছে। শিবব্রতদাদারা তাদের পূজার মন্ত্রপাঠের মতো করে জাতীয় সংগীত পাঠ শেখাচ্ছে; পূজার বেদির মতো করে স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনারের পবিত্রতা এমন করে তুলে ধরছে যেন; দেশটা কেউ তাকে বর্গা দিয়েছে। অথচ এই দেশকে পাকিস্তানি খুনে সেনাদের হাত থেকে লড়াই করে মুক্ত করেছে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষ। কাজলরেখা গল্পের কাজলরেখার মতো নিরলস পরিশ্রম করে যুদ্ধাহত দেশকে গ্রাউন্ড জিরো থেকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে। এই দেশপ্রেমিক জনগণকে এসে “এটা ওটা শ্যাটা” বলে তকমা দেয়ার খেলা খেলে খেলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছে এই ক্ষমতার দুধের মাছি সহমত ও শিবব্রত চক্র কাঁকন দাসীরা ।
এই মধ্যস্বত্বভোগী সহমত ভাই, “লালসালু” উপন্যাসের মজিদের মতো সমাজের স্বপ্রণোদিত ম্যানেজার হয়েছে যেন। শিবব্রতদাদা যেন সেই “অন্তর্জলী যাত্রা” চলচ্চিত্রের ‘বিবাহোন্মুখ জরাগ্রস্ত জাঢ্য জরদ্গব বৃদ্ধের মতো আয়না সামনে ধরে বলছে, আমি কী সুন্দর!
দুটি সার্টিফিকেট, একটু ফর্সা কাপড়, রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত শুনে মাথা দোলানো শিখে “হাওরে পদ্ম”গুলো প্রগতিশীলতার থাড়ুদার হয়েছে। মনের মধ্যে যার সংকীর্ণতার ও দলান্ধতার ছুঁচোর কেত্তন, চেহারায় যার ক্রসফায়ার ও গুম সমর্থনের বিকৃতি, হাতে যার জনগণের “ভোট” হত্যার রক্ত; তার সাহস কত বড়; জনগণকে এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, প্রগতিশীলতা শেখায়। এইসব অপরিণামদর্শী, বিদ্বেষের দোকানী নরভোজির মুখে সভ্যতার বিলাপ পরাবাস্তব কষ্টকল্পনা মাত্র।
The eyes of others our prisons; their thoughts our cages.
–Virginia Woolf
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।