ফাইন আর্ট
তোমার সহিংসতাটুকু আমিই তোমার হয়ে
সেরে আসি বাইরে গিয়ে। তবেই-না তুমি
সম্পূর্ণ অহিংসরূপে দিবানিদ্রা যাও।
সন্ধ্যাবেলা জেগে উঠে বলো– বাহ্! করেছ কী কাণ্ড!
বাইরে কী অপরূপ রক্তবিকিরণ!
স্প্রাং রিদমের তালে-তালে জম্বি ছন্দে চলছে যজ্ঞ মনুমেধ–
ওই যে থ্যাঁতলানো দেহ– প্রতীকপ্রতিম, ছিটকে-পড়া ঘিলু– রূপকসমান
পোড়ানো হাত-পা মুখ-মাথা– উপমেয়হারা উপমান,
কাটা মুণ্ড, ফাটা জিভ, বিমূর্ত চিত্রের মতো নাড়িভুঁড়ি, অনুপ্রাস,
থকথকে কূটাভাস, চকচকে চিৎকার, সত্রশিখা, উগ্র আগ্নেয় তুফান…
থেকে-থেকে যজ্ঞপটে জেগে ওঠে ভৌতিক জবান।
যোজনগন্ধার গন্ধকাহিনির মতো চমৎকার
রক্তের সুবাস ভেসে আসছে জানালায়।
সেইসঙ্গে এও বলো–
জীবাণুনাশক দিয়ে মুছে ফেলো সব আর্ট, তাড়াতাড়ি।
বিমূর্ত চিত্রের রূপ– মূর্ত তো থাকে না বেশিক্ষণ।
পচে। গলতে থাকে। চণ্ড গন্ধ হয়। জীবাণু ছড়ায়…
নাম
তারপর চুপচাপ চলে যাব কোনো একদিন,
দূরসম্পর্কের সেই মাথানিচু লাজুক আত্মীয়টির মতো,
নিজের নামটিকেই ভুলে ফেলে রেখে, তোমাদের কাছে।
গিয়ে বার্তা পাঠাব— এসেছি তাড়াহুড়া করে,
ভুলে গেছি তাই।
পাঠিয়ে দিয়ো তো নামটিকে।
উত্তর পাব না কোনো।
কিছুদিন অনাথের মতো ঘুরে ফিরে
আমার সে-নামও নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে একদিন তোমাদের ছেড়ে।
আমিও বিলীন, আর নামও লুপ্ত, থাকবে শুধু তিলেক শূন্যতা।
আর তা পূরণ করতে এসে যাবে অন্য এক ভাবী বিলুপ্ততা।
অপ্রাকৃত
ছোট্ট একটি ট্রেন— কিশোরী-বয়সী। অসুস্থ, অর্ধবিকল।
পরিত্যক্ত লোকোশেড ছেড়ে
নিশীথে বেরিয়ে পড়ে একা, নিশ্চালক।
সারারাত কোথায়-কোথায় কোন পথে ও বিপথে ঘুরে বেড়ায়…
কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, গ্রাম-গঞ্জ-শহর পেরিয়ে…
রেললাইন ছেড়ে নেমে যায় মাঠে। চলতে থাকে মাঠের ভেতরে
পৌষের শূন্য শীতার্ত মাঠ…
সুখী মানুষেরা ঘুমে। অসুখীরা নির্ঘুম, ঊনপ্রাকৃতিক—
দীর্ঘনিশ্বাসের আতশবাতাসে একাকার তাদের ঐহিক-পারত্রিক।
ঘুমে-ঢুলুঢুলু স্টেশনের বিধ্বস্ত কোণে
কয়েকজন নির্দন্ত নুলা ভিখারি সোল্লাসে মেতেছে সম্মিলিত স্বমেহনে।
পথ থেকে এক পথকিশোরকে গাড়িতে উঠিয়ে নিচ্ছে দুই সমকামী
সদ্যমৃত শিশুর লাশ তুলে নিয়ে পালাচ্ছে এক শবাহারী।
কাঁপতে কাঁপতে এগোচ্ছে চোখবাঁধা এক হতভাগা,
ক্রমে ক্রসফায়ারের দিকে।
তা দেখতে পিছু নিয়েছে দুই রোঁয়া-ওঠা ঘেয়ো ক্ষুধার্ত কুকুর
আর রাজ-রহমতে সদ্য-ছাড়া-পাওয়া এক মৃত্যুসাজাপ্রাপ্ত খুনি।
বাসায় বাসায় বন্দি, নির্যাতিতা শিশু পরিচারিকাদের স্ফুট-অস্ফুট কান্না…
এসব কোন অ্যাবসার্ড নাটকের নিষ্ঠুর নাট্যায়ন, ঘূর্ণমান নাটমঞ্চে!
শেষ অঙ্ক থেকে পিচকারির বেগে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে সমাপ্তিসংগীত—
পরাজিত মানুষের শোচনা ও খুনির নৈশ নিভৃত অনুশোচনা
এ-দুয়ের মিশ্ররাগে জেগে-ওঠা এক নিষ্করুণ গান।
প্রাকৃত-অপ্রাকৃতের ভেদ ভুলিয়ে-দেওয়া সব দৃশ্যনাট্য ঠেলে
উজিয়ে চলেছে সেই পালিয়ে-বেড়ানো ট্রেনটি।
কেউ কি দেখেছে ট্রেনটিকে?
—কেউ না।
শুধু পরান মল্লিকের চির-রোগা রাতজাগা ছেলেটি বারবার বলে যাচ্ছে—
“অনেক রাতে জানালা খুলে দেখি-কি,
আগাগোড়া ফিনফিনে কুয়াশা-কালারের হিজাবে মোড়া
নূপুর-পরা এক ঘরপালানো বউ
ত্রস্তপায়ে ঝুমঝুম শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে দূরে
আরো অধিক কুয়াশার ভেতরে।”
কিন্তু কেউ বিশ্বাস করছে না তার কথা।