মাসকাওয়াথ আহসান
ভাগ্যবদলের উতসব আসে পাঁচবছর পর পর; ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হলে, বাচ্চু-কাচ্চু, সাচ্চু, হরেন, নরেনের ভাগ্য বদলে যায়। ভাগ্যের মাজারে “কৌন বানেগা স্লামডগ বিলিওনিয়ার” জুয়া খেলার আসর বসে। কে কতটা গভীর ও ঘন করে পূজা দিতে পেরেছে; নেচে গেয়ে প্রণতি জানাতে পেরেছিলো; কে ঐ ঠিক করে দেয়া শোকের ক্যালেন্ডার ধরে তারিখে তারিখে কেন্দে দিতে পেরেছিলো।
মাজারের খাদেমেরা যেন, “দুই কান্ধে দুই মুহরী লিখতে আছেন ডায়েরি”।
কোটাল পুত্রদের সাজ সাজ রবে রাজজ্যোতিষী, ভাগ্য নির্ধারণের তারিখ নির্ধারণ করে। অবশ্য তারিখ কেবলই আনুষ্ঠানিকতা; লাইলাতুল ইলেকশনের রাতে কোটাল পুত্রদের বুটের হালুয়া খেলে; আর রাজজ্যোতিষী গ্রহ-নক্ষত্র কিছু মুছে দিলে; লর্ড কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী পেয়ে যায় বাচ্চু-কাচ্চু-সাচ্চু-হরেন-নরেন।
লর্ড কর্নওয়ালিশ নামের হাতিটিকে শুধু কলার ভোগ দিলেই সে খুশি। কলার গাছ গুলোকে সে বন্দোবস্তী কলার বর দেয়।
রাস্তায় রাস্তায় ভোটসমনিয়ার তফশিল সম্প্রদায়ের বিজয় কাফেলা চলে; বালু বিজয়, নদী বিজয়, বালিশ ও কোলবালিশ বিজয়। ঠোঁঠা বাজারে খিঁচুড়ির ডেগ চড়িয়ে আগরবাতি জ্বেলে ফকির রাজা হবার বুজরুকি দেখানো হয়।
ধোপ-দুরস্ত পাঞ্জাবির ওপর কোট চড়িয়ে কাচ্চু মিয়ার অভিষেক হয় সাহেব হিসেবে। জনশ্রুতি আছে, একবার আরব থেকে এক আধ্যাত্মিক নেতা ব্যাঙ্গের পিঠে চড়ে মধুমতীতে ভেসে উঠলে; কাচ্চুর দাদা তাকে খিঁচুড়ি পূজা করেছিলো। সে তখন বর দিয়েছিলো, তোর ভাঙ্গা ঘরে চান্দের আলো হয়ে কাচ্চু আসবে; তখন তোরা শুধুই কাচ্চি খাবি আর বালি খাবি; সঙ্গে ঘাঘৌর নদী খাবি; যা পাবি তাই খাইবি।
আরবের গল্পটা খুব প্রয়োজনীয়; কাচ্চুর জন্য আরবের গল্পটা খুব দরকার হয়ে দাঁড়ায়; আর হরিদাসপুরের হরেনের জন্য মধ্য এশিয়ার গল্পটা খুব প্রয়োজন হয়। লোকে যদি বলে, আমব্রেলা ইঞ্জিনিয়ার আর বেগার ডাক্তার থিকা তুমরা বালি খাইয়া খাইয়া জমিদার সাজছো। তাই ভোটসমনিয়ার তফশিল সম্প্রদায়ের রাতের রাজাদের ঐ পূর্ব-পুরুষ আরব ও মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিলো; এরকম আজন্ম আর্যের গাঁজাখুরি গল্পটা বলতে হয়। বাজার থেকে কয়েক পোটলা ফেয়ার এন্ড লাভলি কিনে কাচ্চু বাড়ি ও হরেন বাড়ির লোকেরা সারাদিন মাখতে থাকে।
কৃষক ও শ্রমিকের মনে যতটুকু আশা ছিলো; এরা গরীব ছিলো; সুতরাং গরীবের দুঃখ বুঝবে; অথচ কোটাল পুত্র দিয়ে পাখির মতো কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষ খুনের রেকর্ড করে কাচ্চু ও হরেনেরা। কেউ অনেক করে চেপে ধরলে তখন ওমরাহ ও তীর্থে চলে যায় তারা। ফিরে এসে জিজ্ঞেস করে, কী অপরাধ আমাদের!
আগে যারা ভাগ্যদেবীর বর পেয়েছিলো; তাদের এখন দেখে চেনার উপায় নাই এরা পাটগাঁতি বাজারে চারটে শুকনো বেগুন আর কটকটি নিয়ে দিনমান বসে থাকতো। শুধু রেগে মেগে মুখটা খুললে বোঝা যায় কোন ক্ষেতের মূলা। তাইতো ছেলে-মেয়েদের তারা ইংলিশ-ভিংলিশ শিখিয়েছে । যাতে মুখ মুখলেই ধরা না পড়ে, এরা পয়সার হাটের রুপের রাণী, চোরের রাজার ছেলেমেয়ে।
বাচ্চু-কাচ্চু-সাচ্চু-হরেন ও নরেন পর্বত চুরি, সমুদ্র ডাকাতি করলে হবে কী! তাদের আছে “ভাবমূর্তি”-র ব্যারাম। বৃটিশ কিং চার্লসকে গালি দিলে অসুবিধা নাই, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুয়েত্তেরেসকে গালি দিলে ক্ষতি নেই। কিন্তু বাচ্চু-কাচ্চু-সাচ্চু-হরেন-নরেনকে গালি দিলেই তারা রেগে কাঁই হয়ে যায়; সেন্টার ফর রুথলেস ইন্টেলিজেন্স (ক্রাই)-এর ছোট চুল সুঠাম দেহী অথবা ভাতের হোটেলের কালা কালা চশমাদের লাগিয়ে দেয় ভাবমূর্তি উদ্ধারের কাজে।
চুরি-ডাকাতি-খুন-রাহাজানি-ধর্ষণে কারো কোন ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়না; পয়সার হাটে বাইজি বাড়ি বানিয়ে নেশায় চুর হয়ে পড়ে থাকলেও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়না; কেউ মুখ ফুটে এসব অন্যায়ের কথা বললে ভাবমূর্তির বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়।
লর্ড কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বালিশ মাথায় দিয়ে ফক্সফোর্ডের শেয়ালদের লাগিয়ে দেয় ভাবমূর্তি রক্ষা প্রকল্পে ভুল বানানে বিবৃতি লিখতে। সামান্য খুদ কুঁড়ো পেলেই শেয়ালেরা প্রশংসাগীতি রচনা করে; প্রগতির কাব্যকলা করে; ভোটসমনিয়ার রাত জেগে জাস্টিফিকেশনের ভাটের আলাপ ও টাইম মেশিন মেথডে ঠোঁটের আলাপ রচনা করে।
ভোটসমনিয়ার রাতে পুতিন-কিম জং উন, লুকাশেংকো, হুন সেন, রবার্ট মুগাবে “গণতন্ত্র-কলা”-র বর দেয়; চাড্ডিক্রান্ত মোদী সেকুলারিজমের স্বপ্ন দেয়, জোসেফ স্ট্যালিন মুচকি হেসে বলেন, জনগণের জন্য এটা জানাই যথেষ্ট যে তফশিল সম্প্রদায় বিজয় মিছিল করেছে; বাকিটা দেখে নেবে বাতাবি লেবুর বাগান।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।