কাকন রেজা : দীর্ঘক্ষণ খালি বইয়ের স্টল দেখে বিরক্ত হচ্ছিলাম, চা খাবো। চায়ের খোঁজে বেরিয়েই অন্তর্দৃষ্টি খুলতে লাগলো। দেখলাম সারা মেলায় চায়ের দোকান নেই, কফির দোকান আছে। আমাদের দেশের সত্যিই উন্নয়ন ঘটেছে, চা’কে হঠিয়ে কফি জায়গা করে নিয়েছে। অনেকটা চোরকে হঠিয়ে ডাকাতের রাজত্ব দখলের মতন। কফি’র দোকানেও লাইন দিতে হয়। দেখলাম লম্বা লাইনে মানুষজন কফির জন্য দাঁড়িয়ে।
আহা, বইয়ের খালি স্টলগুলোর জন্য মায়া লাগতে লাগলো। দেখলাম, স্টলের বিক্রয়কর্মীদের তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি। কী আর করার। সারাদেশের অধিকাংশ মানুষ যখন দ্রব্যমূল্যে দিশেহারা। বিপরীতে তারা মুখ খুলতে ভয় পায়। জান ও জবানের সংকট বিষয়টি এখন আর অপ্রকাশ্য নয়। অথচ সেই প্রয়োজনীয় কথার বিপরীতে যখন ‘বুদ্ধিজীবী’ থেকে ‘ক্ষমতাজীবী’দের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় একজন সাবেক পর্নতারকা, তখন স্বাভাবিক ভাবেই বইমেলায় বইয়ের চেয়ে কফির চাহিদা বেশি হয়ে ওঠার কথা। উত্তেজনা সবাই চায়।
হ্যাঁ, বইমেলার কথা বলছিলাম। শুক্রবারের বইমেলা। যেখানে মেলা জমজমাট কিন্তু বই অনেকটাই নেই। কেন নেই, তার দৃশ্যচিত্রটা বলি। মেলার বাইরে গেটের পাশে চায়ের দোকানে কাপ হাতে দেখছিলাম মেলা থেকে বের হওয়া মানুষজন। দশজনে একজনের হাতে বই রয়েছে। বই হাতে সেই জনদের এক এক করে জড়ো করলে, তার দশজনের মধ্যে আবার একজনের হাতে একের অধিক বই। অনুপাতটা দেখেন। সেজন্যই বললাম মেলা আছে কিন্তু বই অনেকটাই নেই।
মেলায় মজা পাচ্ছিলাম একশ্রেণির লেখকদের দেখে। তারা নিজ বইয়ের প্রকাশনা’র স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, পরিচিত কেউ গেলেই রীতিমত পাকড়াও করে নিয়ে হাতে নিজের বই ধরিয়ে দেন। যার হাতে দেন তার মুখটা যদি দেখতেন। তার কষ্টার্জিত হাসি দেখে মনে হয়, বই নয় হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে, বাঁশটা খালি বাকি রয়ে গেছে। একজন মানুষ যখন বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেন তখন তার আত্মসম্মানবোধটাও প্রবল হয়ে ওঠে। ‘একজন সত্যিকার লেখক আর যাই দেন, নিজের মর্যাদাবোধটা জলাঞ্জলি দেন না’- এমন ধারণাটা আমার মেলায় আসলেই প্রবলভাবে ঝাঁকি খায়। কথিত লেখকদের অনেকটা ফেরিওয়ালা মনে হয়, ‘বই আছে গো, বই’।
একজনকে দেখলাম, এক রমণীর হাতে তার বই ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলছেন। সকালেই দেখলাম ফেসবুকে সেই ছবি। নিচের বর্ণনা অনেকটা এরকম, ‘এই সুন্দরী রমণী আমার বই সংগ্রহ করতে মেলায় এসেছেন।’ বোঝেন অবস্থা। বিজ্ঞাপনী সংস্থা, যারা স্ট্রাগল করছেন, তারা ছোট প্রজেক্ট হিসেবে এসব লেখকদের নিতে পারেন। তারাও আপনাদের ভালো ক্লায়েন্ট হয়ে উঠবেন নিশ্চিত।
চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে, কিংবা কেউ কোনোভাবে টাকা পয়সার মালিক হলে একটা বই বের করা বোধহয় জরুরি হয়ে ওঠে। অন্তত মেলায় গিয়ে এমন লেখকের সংখ্যাধিক্যে এই ধারণাটা পোক্ত হলো। সেই সাথে যোগ হলো, এমন লেখক অনেকেরই বই বিক্রির চেয়ে নিজের স্বাক্ষর সহকারে বই বিলানোটাই বেশি প্রিয়।
শেষে কবিদের কথা বলি। একজন প্রকাশক বলছিলেন, ‘প্রকাশের দিক থেকে কবিতার বইয়ের সংখ্যা বেশি এবং বিক্রির দিক থেকে কম’। কবিতা একটা জটিল বিষয়। সাহিত্যের সবচেয়ে কঠিন শাখা। সুতরাং জটিল বিষয় বোঝার মতন পাঠক কম, তাই বিক্রি কম, এটা নয় বুঝলাম। কিন্তু জটিল বিষয় লেখার মতন এত জিনিস থুক্কু কবি বেশি কেন, এই জটিল বিষয়টি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বোঝা সম্ভব হলো না। না বুঝলেও পাশেই এক কবির একজন পাঠককে তার কবিতা বোঝানোর কসরতটা বেশ মনে ধরলো। তিনি নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। সম্ভবত তার প্রাণান্তকর চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছিলো। পাঠকের বিভ্রান্ত হাসি অন্তত তাই বলে।
সেই হাসি দেখে কবি না বুঝলেও আমি এটুকু বুঝেছি, কবিতার মতন মেলাও দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে মানুষের কাছে। যারফলেই কফির দোকানে লাইন আছে, বইয়ের দোকানে নেই। করোনা’র আগের এক মেলার হিসেব অনুযায়ী সম্ভবত চৌদ্দ হাজার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে বাংলা একাডেমি’র কাছে মানসম্মত মনে হয়েছে সাতশ’র মতন বইকে। বাংলা একাডেমি’র মান নিয়েও অনেকে কথা বলেন, সেই কথার মধ্যে তাদের কাছে যদি এ পরিমান বই মানসম্পন্ন হয়, তাহলে সত্যিকার অর্থেই মান খুঁজতে গেলে অবস্থা কী দাঁড়াবে! আর এই মান নিয়ে মেলার দুর্বোধ্য না হয়ে ওঠার সঙ্গত কোনো কারণ নেই, থাকার কথা নয়।