মাসকাওয়াথ আহসান
(ডিসক্লেইমারঃ আমি যখন লেখায় আভিজাত্য শব্দটি ব্যবহার করি; তখন তা মনের বা চিন্তার আভিজাত্য অর্থে ব্যবহার করি। এই আভিজাত্যের সঙ্গে চেহারা-পোশাক-আর্থিক সংগতির কোন সম্পর্ক নেই। )
আগেও বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছি, ফেসবুকে এসেই আমি প্রথম জেনেছি হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা গ্রহ। কারণ শৈশব থেকে আমরা যারা মেলামেশা করেছি; তারা চিন্তার জগতে এগিয়ে যাওয়া পরিবারের ছেলেমেয়ে। ফলে হিন্দু ধর্মের কোন বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে মনে হয়নি; সাংস্কৃতিক কোন পার্থক্য আছে আমাদের।
আড়ানিতে নানা বাড়ির পাশে মৈত্র বাড়িতে গেলে মৈত্র নানী পুজোর সময় বানানো নাড়ু ও অন্যান্য সংরক্ষণযোগ্য মিষ্টান্ন পরিবেশন করে বলতেন, তোর জন্য রেখে দিয়েছি নানা ভাই।
রাজশাহীতে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতেন মৈত্র বাড়ির চন্দনা মাসি। আম্মা ছিলেন তার বড় বোন। রাজশাহীতেই বন্দনা মাসির বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া ছিলো খালা বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ।
আড়ানির ঝন্টু ত্রিবেদী নানার আত্মীয়েরা রাজশাহীতে থাকতেন। তাদের বাড়ির সামনে প্যান্ডেল করে পুজো হতো। পুজোর সময় থাকতো বিশেষ দাওয়াত।
এইকালে ঈশ্বরদীতে স্বপন আংকেল ও অঞ্জনা আন্টি আমার ছেলে মিদ্রাহ’র খুব কাছের জন। পশ্চিমে চলে গিয়েও ছেলে তার দিদার কাছে নিয়মিত উনাদের খোঁজখবর নেয়। শিশুবেলায় কারো কাছে মৌলিক স্নেহ পেলে তা মানুষ ভুলতে পারে না।
ইউনিভার্সিটি জীবনে এসে যে তাপস, জয়দীপ, পার্থ, অরূপ, সুদীপের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো; আজো তা একই জায়গায়। সেদিন অরূপের চলে যাওয়া স্বজন হারানোর বেদনা হয়ে কটাদিন শোকে ঢেকে দিলো। মন খারাপ করে পার্থ এসে বললো, ভাবতে পারছি না অরুপদা নেই। আমি বুঝতে পারছিলাম কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে পার্থের। শুধু একবার বললো, আমাদের কথা হওয়া দরকার। আমাদের কথা হোক বা না হোক; আমরা মনের খুব কাছাকাছি থাকি।
কর্মজীবনে সঞ্জীব বর্মন, সুনন্দা রাও, টুসি; ওদের চেয়ে কাছের আত্মীয় আর কে আছে। মিদ্রাহ’র এলভিস প্রিসলি পারফরমেন্সের ভিডিও সুনন্দা সবার কাছে শেয়ার করেছে। অনেকেই পরে জানালেন, অপেরা গায়িকা সুনন্দা গর্ব করে বলেছে, দ্যাখো আমাদের পরের প্রজন্মেও একজন গায়ক এসে গেছে।
নাইন ইলেভেনের পর “ওয়ার অন টেররে”-র স্টোরি সঞ্জীব আমাকে দিয়ে বলতো, এটা তুমি করলে বেটার। আমার মন সায় দেয়না, কট্টর ইসলামপন্থা নিয়ে তেতো প্রতিবেদন করতে। এই হচ্ছে চিন্তার জগতের আভিজাত্য।
বাংলাদেশে হিন্দু নারীর সম্পত্তিতে ভাগ পাওয়া নিয়ে উত্থাপিত বিতর্কে অংশ নিতে আমার মন সায় দেয়নি। হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে তেতো কথা বলাটা সভ্য আচরণ নয়; এমন মনে হয়েছে। ছোট বেলায় আব্বা বলেছিলেন, সব ধর্মের গোড়ার কথা হচ্ছে সত্য, সুন্দর, মঙ্গল। যা কিছু কুতসিত দেখো তা কুসংস্কার আর দর্শন বুঝতে না পারার ফলাফল।
ফেসবুকে এসে দেখলাম প্রথম, ইসলাম ধর্মের চিন্তায় ঘুম আসে না কিছু হিন্দু ফেসবুক ফ্রেন্ডের। সারাদিন লেগে থাকে জঙ্গীবাদ, মেয়েদের হিজাব, পুরুষের দাড়ি-টুপি আর চার বিয়ে নিয়ে বস্তি সুলভ রগড়ে।
এদের পারিবারিক চিন্তার আভিজাত্যের অভাব যে আছে; তা বোঝা যায়। বাবা-মা খুব রক্ষণশীল ধর্ম অনুশীলনের মানুষ হলে, শৈশব থেকে আরেকটি ধর্ম সম্পর্কে কটু কথা শুনতে শুনতে বড় হলে এমনটা হয়।
বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন হওয়ায় হিন্দুদের মন বিষিয়ে গেছে, এটা আমি বিশ্বাস করিনা। আমার আব্বা ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কলকাতা কারমাইকেল হোস্টেলে সারারাত মৃত্যু শংকার মধ্যে কাটিয়েছিলেন। সকালে হিন্দু ছদ্মবেশে বহরমপুর পালিয়েছিলেন; তবু তার মুখে কক্ষণো হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে কোন নেতি শুনিনি। আমাকে বরং কৈশোরে হিন্দু মিথগুলো পড়িয়েছেন। তুলনামূলক ধর্মশাস্ত্রের গ্রন্থ জোগান দিয়েছেন; যাতে কক্ষণো কোন ধর্মের প্রতি কোন বিদ্বেষ না জন্মে।
বাংলাদেশে সেই যুক্তরাষ্ট্রের নাইন ইলেভেন ও আফঘানিস্তান দখলের পর যে কট্টর ইসলাম দানা বেঁধেছে; তার আশপাশ ঘিরে কট্টর চিন্তার একটা প্রজন্ম গড়ে উঠেছে। সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্য যখন একবিংশ শতকের উপযোগী করে শিক্ষা ব্যবস্থা সাজাচ্ছে, মেয়েরা গাড়ি চালাচ্ছে, মহাকাশচারী হচ্ছে; তুরস্ক যখন নারীর ব্যবসা উদ্যোগ আর সামাজিক নেতৃত্বের ওপর ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে, পাকিস্তানের মতো দেশে নারী যখন শিক্ষাক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে বেশি সুকৃতি দেখাচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে যেখানে নারীর অংশগ্রহণ; সেখানে হেফাজতে ইসলামি নারীকে ঘরে আবদ্ধ করার ফতোয়া দিচ্ছে, অনেক ছেলে কো-এডুকেশন সম্পর্কে নোংরা মন্তব্য করছে অবচেতনের বিকৃতি উন্মোচন করে; অনেকে জিদ ধরছে, “গণতন্ত্রকে আমি গুরুত্ব দিইনা, শরিয়া আইন চাই”। ভাবা যায় গোটা মুসলিম বিশ্বের প্রগতি ও উত্তরণের কালে কীসব জিদ নিয়ে বসে আছে একটি গোষ্ঠী। এ হচ্ছে পরিবারে রক্ষণশীল ধর্ম চর্চা ও অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে বিদ্বেষ লালনের ফলাফল।
ভারতে মোদীজীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর হিন্দু ভারতের আত্মঘাতী চিন্তা গেরুয়া উড়িয়ে ঘুরলে, বাংলাদেশে যে হিন্দুদের মাঝে মুসলিম বিদ্বেষ আছে; তারা একমুখে ফেসবুকে ভারতের হিন্দু তা-লি-বা-নকে সমর্থন দিয়ে; সারাদিন মুসলিম তা-লি-বা-ন নিয়ে রগড় করছে। অথচ এরাই আওয়ামী লীগের একই রকম চিন্তার আভিজাত্যে খর্ব লোকেদের সারিন্দা হয়ে “প্রগতিশীল”-এর ভং ধরেছে।
নিজে ফেসবুকে পূজা করার ছবি, জামাই ষষ্ঠীর ছবি দেবে গর্বভরে; অথচ কোন মুসলমান তার নামাজ পড়ার পোশাকে ছবি দিলে তাকে “ছাগু” “রাজাকার” অভিধা দিয়ে খিল্লি খেলে মন্তব্য ঘরের ছ্যাদনাতলায়।
একই ঝাড়ের বাঁশ; একই হাওরের পদ্ম, অথচ ধার্মিক হিন্দু হলে সে প্রগতিশীল; ধার্মিক মুসলমান হলে সে “ছাগু”। কল্পনার জগতে নিজেকে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতো অভিজাত ভাবলে তো হবে না; বাংলাদেশ ছোট্ট দেশ; একটু খবর নিলে বংশের দশ ফিট বাই দশ ফিট থেকে মাছের আঁশটে গন্ধ আসে; নাকে ধক করে লাগে ভ্যাপসা ঘরের দীর্ঘদিনের পাঁচফোড়নের পচাটে গন্ধ। ফেসবুকে নক্সী পাঞ্জাবি পরে রবীন্দ্র সংগীতে মাথা দোলালেই তো আর কাউকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের তনয় ভেবে বসবো না আমরা। তাই কল্পনায় বংকিম না হয়ে বাস্তবতায় পা রাখতে হবে; আয়নায় নিজের মুখমণ্ডল আর হৃদয়ের প্রতিবিম্ব দেখতে হবে; বিদ্বেষ কিন্তু চেহারায় জ্যামিতিক রেখা ফেলে যায়।
ফেসবুকে নিজেকে বড্ড কালচার্ড হিসেবে উপস্থাপন ও কলচরের জ্ঞান দেবার আগে; নিজের বাবা-মা, দাদা-নানার কালচারটা খুঁজে দেখে আসতে হবে। সক্রেটিস এজন্য বলেছেন, নো দাইসেলফ।
আর মুসলমানদের মাঝে যারা সৌদি শেখ সেজে ঘুরছেন, স্ত্রীকে সৌদি শেখের বউ সাজিয়ে বড্ড মুমিন ও মুমিনা সেজেছেন, তাদেরকে নিজের ঐ দশফিট বাই দশফিটে তেলচিটে বালিশের শুকিয়ে যাওয়া লোল, চাদরের ভ্যাপসা গন্ধের কথা ভুলে গেলে চলবে না। এতো বড় জাম্প এতো এক প্রজন্মে করা যায় না যে সম্ভ্রান্ত মুসলমান সেজে ফেসবুকে ধর্মজ্ঞান দেবেন অন্যকে। নিজের চরকায় তেল দিতে দিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে মুখমণ্ডল ও হৃদয় দেখতে হবে। অন্যধর্মের প্রতি বিদ্বেষে চেহারায় পীতেল ছাপ পড়ে। আর যে দাড়ি সৌদি আরবের দীর্ঘ দেহী গৌর বর্ণের পুরুষকে মানায়; তা আমাদের খর্ব দেহের শ্যাম মুখে কতটা মানায়; ধার্মিক নাকি ডাকাত লাগে সেটাও বুঝে দেখতে হবে। এই যে সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপ আমেরিকার এতো নারীর সৌন্দর্য্য ইন্টারনেট জগতে সৌরভ ছড়ায় যে আপনার কষ্ট করে ঢাইকা-ঢুইকা রাখা সম্পদের দিকে কারো তাকানোর বিন্দুমাত্র অবসর বা ইচ্ছা আছে কীনা সেটাও ভেবে দেখা দরকার। রোমের লোকের চেয়ে বেশি রোমান কিংবা সৌদির লোকের চেয়ে বেশি সৌদি হতে চাইলে তো বিপদ।
আমি প্রতিটি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু ফেসবুকে যখন ধর্ম বিদ্বেষে মুখর অথবা কট্টর পোগোতিচিলতা ডিসপ্লে করা হাওরে পদ্ম দেখি; তখন একটু ধাক্কা দিয়ে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করাই। নিজের ক্ষেত্রেও নিরন্তর আত্মজিজ্ঞাসার মাঝ দিয়ে যাই। কিন্তু মনে রাখবেন, যখন আপনার হিন্দু পল্লীতে তস্করেরা হানা দেবে, যখন আপনার মুসলমান পল্লী থেকে “জঙ্গী নাটক” সাজিয়ে আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে চেষ্টা করবে ফ্যাসিজমের নরভোজিরা; আমাকে তখন আপনি আপনার পাশে পাবেন। বন্ধু সেই যে তীব্র সমালোচনা করে; কিন্তু বিপদের মুহূর্তে এসে পাশে দাঁড়ায়।
“All empty souls tend toward extreme opinions. “
— William Butler Yeats
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া