মাসকাওয়াথ আহসান
গৌড়রাজ শশাংকের মৃত্যুর পর দীর্ঘ বিশৃংখলার পথ ধরে নবগণতন্ত্রের নবসূচনা হয়। গৌড়ের সুশীল সমাজ দয়িতবিষ্ণু নামের এক পণ্ডিতের নাতি গোপালকে অনুরোধ করে, হে গোপাল আপনি ক্ষমতাগ্রহণ করুন। আপনি বপ্যটের পুত্র, আপনি জানেন কীভাবে গৌড়ের স্বাধীনতার শত্রুদের বিনাশ করতে হবে।
গোপাল বলেন, আমি রাজা হতে আসিনি; অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া রাজ্যশাসনের দায়িত্ব নিতে পারি না। প্রয়োজনবোধে তিব্বত থেকে গোটাকয় পর্যবেক্ষক আনুন। তারা নির্বাচন শেষে জানাবে এর সুষ্ঠুতা।
সুশীল সমাজ লেগে পড়ে কাজে। গোপালের সুকৃতি নিয়ে প্রশংসামূলক কাব্য শুরু করে কবিরা। নির্বাচনের আগেই কে রাজন্যক হবে, কে রণক (অধীনস্থ গোষ্ঠীপতি) হবে কে সামন্ত ও মহাসামন্ত (সামন্ত রাজা) হবে, কে মহাসন্ধি-বিগ্রহিক (পররাষ্ট্র মন্ত্রী) হবে, কে দূত (প্রধান রাষ্ট্রদূত) হবে কিংবা কে রাজস্থানীয় (উপপ্রধান) হবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। গোপাল বলেন, কে কোন পদ পাবেন তা নিশ্চিত হবে নির্বাচনের পরে। আসুন আগে সুষ্ঠু ভোট করি।
গোপাল একটি নবগণতন্ত্রসূত্র হাজির করেন, আমার বিরুদ্ধে একজন প্রার্থীকে নির্বাচন করতে হবে। আমি একা একা নির্বাচিত হতে পারিনা। আমার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী নিয়ে আসুন।
‘খোল (গোপন বাহিনী)’র লোকেরা বেরিয়ে পড়ে গোপালের নির্বাচনী প্রতিপক্ষের খোঁজে। দণ্ডশক্তি (পুলিশ বাহিনী)-র প্রধান তার দপ্তরে শাকান্ন পরিবেশন করে গোপালের প্রতিপক্ষের খোঁজে। অবশেষে গবাধ্যক্ষ (গো-খামারের প্রধান)কে প্রস্তাব দেয়া হয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য। কারণ লোকে তাকে সাক্ষী গোপাল নামেই চেনে।
শশাংকের এক অনুসারী গোপালের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ নেবার কথা জানালে খোল বা গোপন বাহিনী গভীর রাতে তাকে তুলে নিয়ে যায়। ভোরবেলা তাকে আদালতে উপস্থাপন করলে মহাদণ্ডনায়ক বা ধর্মাধিকার (প্রধান বিচারপতি) তার জামিন আবেদন নাকচ করেন।
গৌড় রাজ্য ভোটানন্দে দুলে দুলে ওঠে। চারিদিকে সাজ সাজ রব। গোপাল বনাম সাক্ষী গোপাল নির্বাচনী দ্বৈরথ নিয়ে সুধীমহলে আলাপ আলোচনা শুরু হয়। গোপালের নির্বাচনী চিহ্ন “তরী” যেহেতু তারা সমুদ্রকূলোদ্ভূত বলে পরিচিত। আর সাক্ষী গোপালের নির্বাচনী চিহ্ন “তরকারি”; যেহেতু গোখাদ্যের প্রয়োজনে তাকে তরকারি ক্ষেত পরিভ্রমণ করতে হয়।
ছাগাধ্যক্ষ (ছাগ-খামারের প্রধান), মেষাধ্যক্ষ (মেষ-খামারের প্রধান) ও
মহিষাধ্যক্ষ (মহিষ-খামারের প্রধান) ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করে। বরেন্দ্র এলাকার আদিবাসীরা বলে, গোপালই রাজা হবে; সাক্ষী গোপালকে অযথা টেনে আনা হয়েছে নির্বাচনে। আর শশাংকের অনুসারীকে কারাগারে রেখে এ কোন নির্বাচন!
বিক্রমশীলা ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকেরা তখন বিবৃতি দেন, শশাংকের মৃত্যুর পর তার অনুসারী বড় মাছেরা ছোট মাছ খেয়ে ফেলছিলো; এমন সময় গোপাল না এলে গৌড় রাজ্য রসাতলে যেতো।
গোপালের নির্বাচনী ইশতেহারে লেখা হয়, দেশে বহুদিন যাবৎ অরাজকতার ফলে দুঃখকষ্টের সীমা ছিল না। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা মিলিত হয়ে সুশৃঙ্খল শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একজন রাজা নির্বাচন করেন।রাত্রে রাজাকে এক কুৎসিত নাগরাক্ষসী হত্যা করে। এভাবে প্রত্যেক রাতেই নতুন নতুন নির্বাচিত রাজাগণ নিহত হতে থাকেন। এভাবে কিছু বছর অতিবাহিত হয়। অবশেষে একদিন সকালে এক বাড়িতে সবাই বিষণ্ণ বসে ছিল। কারণ ঐ বাড়িরই এক ছেলে সকালে রাজা নির্বাচিত হয়েছে। আজ রাতে নাগরাক্ষসী তাকে হত্যা করবে ভেবে সবাই বিষণ্ণ ছিল। কিন্তু সেখানে এক আগন্তুক আসে। সে ঐ ছেলের পরিবর্তে রাজা হতে সম্মত হয়। সেই রাতে লাঠির আঘাতে নাগরাক্ষসীকে সে হত্যা করে। সকালবেলা আগন্তুককে জীবিত দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। তিনি গোপাল। সুতরাং তাকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করা আমাদের কর্তব্য। বলাবাহুল্য তিব্বতের সমর্থন তিনি লাভ করেছেন।
সাক্ষী গোপালকে নিয়ে খোল বা গোপন বাহিনী কিছু ছোট ছোট জনসভা করায়। সাক্ষী গোপাল বীরদর্পে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে থাকে। লোকজন তার তরকারি চিহ্ন নিয়ে হাসাহাসি করলেও সে গম্ভীর থাকে। তিব্বতের পর্যবেক্ষকরা তাকে জিজ্ঞেস করে, নির্বাচনের পরিবেশ কেমন! লেভেল প্লেইং গ্রাউন্ড পাচ্ছেন কী!
–আজকাল অসমান বরেন্দ্র এলাকাকেও মনে হয় প্রকৃষ্ট সমতল। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে প্রতিপক্ষের সঙ্গে। এর চেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রতীচ্যেও কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না।
(কাল্পনিক গল্প। ইতিহাস ও ভূগোলের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া নেহাত ঘটনাচক্রের সংঘটন)
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।