মাসকাওয়াথ আহসান
ফেসবুকে থেকে থেকে আক্ষেপ শুনছিলাম, বইমেলার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। বই কেনেনা কেউ শুধু ঘুরে। কেনে শুধু সেলিব্রেটির বই।
আমি বাস্তবিক অর্থেই এর কোন সত্যতা পেলাম না। কারণ জনান্তিকের প্রকাশক সাম্য আহমেদ জানালেন, আমার বই বেশ কিনছে পাঠকেরা। সবার মুখেই নতুন উপন্যাসের অনুরোধ। সাম্য একটু আগে লিখলেন, আপনি না লিখলেও আগামী বই মেলায় জনান্তিক থেকে আপনার একটা উপন্যাস বের হবে!
ইউরোপ ও এমেরিকা থেকে অত্যন্ত সচেতন পাঠকের ক্ষুদে বার্তা পাই, আপনার গ্রন্থ সংগ্রহ করে পার্সেল করতে বলেছি ছোট বোনকে। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ছোট বোন সাহায্য করছে আমার বইগুলো হাতে পেতে।
পরপর দুটি বার্তা পেলাম পলিটিক্যাল স্যাটায়ার গ্রন্থ খাজাঞ্চির খাতা পাওয়া যাচ্ছে না জনান্তিকে। জনান্তিক এই গ্রন্থের পরিবেশক। কলকাতার খসড়া খাতা’র প্রকাশক তন্ময় দাশগুপ্ত বই পাঠালে তবে আবার পাওয়া যাবে আজিজ মার্কেটে জনান্তিকের শো রুমে।
ঢাকা আমার ভালোবাসার শহর; আর আমার বাবার তারুণ্যের ভালোলাগার শহর কলকাতা। সে কারণে তরুণ প্রকাশক তন্ময়ের অনুরোধে সাড়া দিয়ে “খাজাঞ্চির খাতা” কলকাতা থেকে প্রকাশ করতেই সেখানে পাঠকেরা একে গ্রহণ করে। দ্বিতীয় সংস্করণ খুব সম্ভব শেষের পথে।
এ বছর কলকাতার “ইতিকথা পাবলিকেশন্স”-কে “জীবন পাত্র উচ্ছলিয়া ওঠে” নামে একটি উপন্যাস দেবার কথা থাকলেও নিয়মিত পলিটিক্যাল স্যাটায়ার লেখার চাপে তা দেয়া হয়নি।
একবিংশ শতকের ইন্টারনেট অমনোযোগের কালে এতো আগ্রহী পাঠক বাংলাভাষী বিশ্বে ছড়িয়ে আছেন; এ সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিলো না। আর ভেবেছি এতো সেলিব্রেটি গিজ গিজ করছে; কে আর কিনবে আমার বই; আমি হয়তো অনলাইন পোর্টালের “রাইটার অফ ফ্রি কস্ট”।
শৈশব থেকে নিজেকে আন্ডার এস্টিমেট করি বলে আম্মা খুব বিরক্ত হতেন। আব্বা বলতেন, যার আত্মবিশ্বাস এতো কম তাকে দিয়ে কী হবে জীবনে! আপনার পার্টনারও বিস্মিত হয়, মাঝে মাঝে নিজেকে জিরো ভেবে হাল ছেড়ে দেবার বাতিক দেখে। শৈশবের বন্ধু শাহরিয়ার লিন বলে, আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় এমন হোপলেস হয় কী করে রে!
আমাকে সেই বিষণ্ণতার শহর বিচূর্ণীভাবনার কাল থেকে চেনে বলে ই আরকির সম্পাদক সিমু নাসের ও কনটেন্ট এডিটর খালেদ সাইফুল্লাহ আমার “পুঁ” হবার কাল গুলোতে ঘুম ভাঙ্গিয়ে লেখায়। একই কাজ করেছেন “অংশুমালী”-র জোবায়েন সন্ধি ও কবি কাকন রেজা। অগ্রজ প্রতিম আব্দুন নূর তুষার আমার সাড়াশব্দ না পেলেই ফোন করে উদ্দীপিত করেন। বন্ধু সাব্বির খান সুইডেন থেকে ফোন করে আইডিয়া উস্কে দেয়। বিংশ শতকে একইরকম ঠেলা দিয়ে দিয়ে আমাকে দিয়ে “বিষণ্ণতার শহর” লিখিয়ে নিয়েছিলো কবি হুমায়ুন রেজা; আর “তির্যক রচনা” লিখিয়ে নিয়েছিলো কবি ও লেখক মুনির রানা।
আমি যেহেতু লেখক হিসেবে সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো; তাই সাহিত্য বলয়ের বন্ধুদের বেশিরভাগই তাদের সাহিত্যপাতায় আমাকে অনুচ্চারিত রাখেন।
সেই ভোরের কাগজের কালে কথাসাহিত্যিক মইনুল আহসান সাবের আর প্রথম আলো কালে কবি সাজ্জাদ শরিফ সাহিত্য পাতায় লেখাতেন স্নেহের বশে।
আর আছেন কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল। বন্ধুত্বের দাবিতে তিনি ঝাড়ি দিয়ে বলেন, কে পড়বে না পড়বে সেই পাঠক বিচারের দরকার নাই! আপনাকে লিখতে হবে!
কথাসাহিত্যিক ও ফিল্ম মেকার আনোয়ার শাহাদাত ভাই নিউইয়র্ক থেকে ফোন করে রাইটিং কোচের মতো বিশ্বসাহিত্যের আলোচনা করেন; আমার লেখার বিষয়, কনটেন্ট, স্টাইলকে “রম্য ব্র্যাকেটে” আটকে দেবার পক্ষপাতি নন তিনি। তিনি মনে করেন; এটা একটা শক্তিশালী জনরা; এরকম কাজ বিশ্বসাহিত্যে হয়। সুতরাং লিখতে হবে; লিখে যেতে হবে।
এতো সুহৃদের শ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে হয়; যখন ফেসবুকের আদার বক্স ও ইনবক্স ভরে ওঠে পাঠকের বইকেনা ও পাঠ প্রতিক্রিয়ার উচ্ছ্বাসে। হাইসিরিয়াস ডিসকোর্স আলোচনায়।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা আসলে লেখকের জন্য লিটমাস টেস্ট। এই লিটমাস টেস্ট ঘটে নীরবে। কিন্তু যখন ইতিবাচক ফল আসে; তখন লেখক নতুন একটা উপন্যাস লেখার প্রাণপ্রবাহ পেয়ে যায়।
কৃতজ্ঞতা রইলো প্রাজ্ঞ ও সাহিত্যরসিক পাঠক বন্ধুদের প্রতি। আমাদের ভালোবাসার যৌথবাগানে সৃজনশীলতার ফুল ফোটানোর জন্য। পাঠকই সাহিত্যের প্রাণ ভোমরা; এই চিরন্তন সত্য আমার ব্যক্তিগত জীবনে আরেকবার প্রমাণ করে গেলো এই ফেব্রুয়ারির অভিজ্ঞতা।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।