নাহরীন আই খানের বিতর্ক
হিরো আলম কে নিয়ে আবারও মাতামাতি দেখে অনেক আগের আমার একটা লেখা শেয়ার করলাম। পত্রিকার লিঙ্ক টা খুঁজে পাচ্ছিনা, তাই এখানেই পোস্ট করলাম…“অনন্ত” আর নিতান্ত এক “আই এম হিলারি‘স হাসবেন্ড, অ্যান্ড ইউ?”
পর্যালোচনা জাপানে গেছেন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন । জাপানের প্রেসিডেন্ট কে শিখানো হলো ক্লিনটনের সাথে হাত মিলিয়েই যাতে জিগ্যেস করেনঃ হাউ আর ইউ? মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন বলবেন, আই এম ফাইন, অ্যান্ড ইউ? তাকে তখন বলতে হবে, মি টু। যথারীতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট আসলেন, হাত মেলালেন, জাপানী প্রেসিডেন্ট বলে ফেললেন, হু আর ইউ? মার্কিন প্রেসিডেন্ট হেসে বললেনঃ আই এম হিলারি‘স হাসবেন্ড, অ্যান্ড ইউ? উত্তর এলো মি টু!!! কৌতুকটা বলার কারন, ভিনদেশী ভাষা ঠিক বলা, ঠিক উচ্চারণে বলা আর না বলা প্রসঙ্গে !
কয়েকদিন যাবত বাংলাদেশী সিনেমা পরিচালক ও নায়ক এম এ জলিল অনন্তের উচ্চারন, ব্যাকরন, শব্দচয়ন আমাদের রস-কষহীন বাঙালি জীবনে নিরন্তর রসের সঞ্চার করেছে। ফেইস-বুক, ইউটিউব, এফএম রেডিও কোথায় নেই এই আলোচনা !!!
জাতীয়ভাবে অস্থির থাকা এক জাতি যদি কিছু সময়ের জন্য আনন্দে থাকে ,তাহলে কি বা ক্ষতি! কিন্তু ক্ষতিটা হোল সেখানেই যাকে বলে “নাই কাজ তো খই ভাজ”। অনেকেই বলবেন সমালোচনা জাতিকে সমৃদ্ধ করে, কিন্তু একটা মানুষ যে কিনা বাংলা সিনেমা বানান, অভিনয় করেন, তার শুদ্ধ ইংরেজি বলা আর না বলা তে কি বা আসে যায়। তিনি তো আর মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নন, যদিও এই পদে থেকেও অহরহ ভুল ইংরেজি বলা যায়।
তবুও মানা যেত , যদি সিনেমাটা ইংরেজি হত, নিতান্তই বাংলাভাষার বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা, যেখানে নাচ, গান, আর বারো তালার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে শিহরিত হয় সপ্তাহে ৭ দিনই খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষটা, বিশাল পর্দায় ঝকঝকে জীবনটা যাকে সারাদিনের ঘাম-ঝরা মুহূর্ত ভুলিয়ে চকচকে মানুষগুলোর খুব কাছে নিয়ে যায়, তার কাছে ঘানা, গানা সবই হিব্রু ভাষার মত দুর্বোধ্য । ঠিক এই প্রেক্ষাপটে জাতীয়ভাবে আলোচিত নির্লজ্জ এই কৌতুক আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তথাকথিত “শ্রেণী” কে দেখিয়ে দেয়, যেখানে “আমার বেটার-হাফ বাংলা পারেনা”; “আরে এটা কোন ব্যাপারস না”; “একটা চিঠি রিড আউট করছি”র মত “আরজে” জেনারেশন তৈরি করে, বাংলা মিডিয়াম বা বাংলা ভাষা যাদের কাছে গরিবের ভাষা হয়ে গেছে।
কি ভয়ঙ্কর সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা, ক্রমান্বয়ে স্বকীয়তা হারিয়ে এ যেন “বাংলিশ” ভাষার দিকেই ধাবিত হওয়া। আমার এক সহপাঠী যে কিনা “ঘানা” থেকে এসেছেন, “গানা” আলোচনার পর খুব মন দিইয়ে শুনলাম; উনি বলছেন”গানা”। আর আমার প্রফেসরের কাছে আমি হয়েছি “নারিন কান, ফ্রম ব্যাংলাডেস”। তাতে আমার জাতীয়তাবোধ, আমার আত্মপরিচয়ের বিন্দুপরিমান কোন পরিবর্তন হয়নি। আর “আই এম পম গানা” হেডলাইনে ঘানার উলঙ্গ কয়েকটি শিশুর ছবি দিয়ে সমগ্র ঘানার যে চালচিত্র , দারিদ্র, ক্ষুধা আমাদের হাস্যরস যোগাল , তা কি ঘানার সংগ্রামী মানুষগুলোকেই অপমান করে না, যারা কিনা এই কৌতুকের আগে-পিছে নেই।
এই অধিকার আমাদের দিলোটা কে? আমাদের কি শিষ্টাচার শেখাটা, উচ্চারন শেখার থেকে বেশি জরুরি নয়? আসলে শুদ্ধ ইংরেজি বলার প্রয়োজনীয়তা আছে বইকি কিন্তু তা কতটা আবশ্যিক , তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আবার প্রশ্ন হোল, ঠিক বা শুদ্ধু , ভাল বা মন্দ নিতান্তই আপেক্ষিক। আপনি বা আমি কেউই কি ঠিক-ভুল এর পেটেন্ট পেয়েছি? ইংরেজি যাদের মায়ের ভাষা তারাও উচ্চারণে বহুরূপী । টিভিতে বহু শুদ্ধ উচ্চারণবাদী কে দেখেছি, যারা অসম্ভব সুন্দর কথায় সবাই কে মুগ্ধ করে আর নিয়ম করে বউ পিটায়। কর্মক্ষেত্রে দেখেছি, মুখে আমেরিকান ইংলিশের ফুলঝুরি, আর পরীক্ষার খাতায় no আর know এর পার্থক্য বোঝেনা। আবার মুখে এক ফোটা ইংরেজি বলতে পারেনা, অথচ খাতায় অসাধারণ। আমি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই , আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কতজন আছেন যারা শুদ্ধ উচ্চারণে ইংরেজি বলতে পারেন, অথবা “এবং” কে “অ্যাবং” বলেন না!
আসলে আমার কাছে শুদ্ধ বাংলা বলতে না পারাটাই অমার্জনীয় অপরাধ, যদিও এটিই নাকি হাল যুগের ফ্যাশন ।
আসলে অনন্ত কে সমালোচনা যদি করতেই হয়, করতে হবে তার অভিনয় নিয়ে, কেউ যদি বলতেন উনি ঠিক মত নায়িকাকে কোলে তুলতে পারেননি, অথবা ভিলেন কে চড় মারতে যেয়ে স্বয়ং নায়িকাকেই মেরেছেন, তাহলেও তিনি আলোচনায় আসার মত কাজ করেছেন, মানতাম। কিন্তু তিনি ফাইপ (পাইপ) দিয়ে পানটা (ফানটা) খেলেন, নাকি কি উচ্চারণে কি বললেন তা নিয়ে পুরো জাতির এই “জাতীয়- মাতামাতি” আবারও প্রমাণ করল, আমরা জাতি হিশেবে এখনও পরচর্চায় অপার আনন্দ পাই, appreciation করাটা আজও শিখলাম না। এফডিসির কোন সিনেমায় এত সুন্দর সিনেমাটোগ্রাফি দেখে আমরা একবারও বলতে পারলাম না, বাহ, চমৎকার !!! আজও ঠিক জায়গায় ঠিক সমালোচনা করতে পারিনি আমরা।
আমরা আজও বুঝিনি, ছোট একটা প্রশংসা মানুষ কে নতুন জন্ম দিতে পারে। জাতিসংঘ বলেঃ শিশুদের জন্য হ্যা বলুন, আর আমি বলি, সবার জন্য হ্যাঁ বলুন, তাহলে দেখবেন, আপনার পাশের মানুষটি আর কষ্টে নেই, না পারার গ্লানি নয় বরং পারার অদম্য আগ্রহে সেও এগিয়ে যাচ্ছে দুর্নিবার । এমনি এক সমালোচনায় মুখর বাংলাদেশ দেখবার প্রতিক্ষায় আছি।