দেশে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। নগরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রতি বছর গড়ে ৩ শতাংশ এবং দরিদ্র অস্থায়ী বসতিতে প্রতি বছরে তা প্রায় ৭ শতাংশ। যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে; ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি শহরাঞ্চলে বাস করবে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া একা সরকারি হাসপাতালের পক্ষে দুরূহ। ফলে অন্যান্য খাতের ওপরেও নির্ভর করতে হয়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত চারটি প্রধান ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে– সরকারি খাত, বেসরকারি খাত, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও), যা ‘তৃতীয় খাত’ নামে পরিচিত এবং দাতা সংস্থাগুলো। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মূলত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবানির্ভর। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা একজন ব্যক্তির সারাজীবনের বেশিরভাগ স্বাস্থ্য চাহিদা পূরণ করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থসেবা অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সাধারণ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা পরিচালনা করে। শহরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা পরিচালনা করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। উন্নয়ন সংস্থাগুলো ‘তৃতীয় খাত’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে নতুন বিকল্প উদ্ভাবন নিয়ে। জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে চার হাজারের বেশি উন্নয়ন সংস্থা কাজ করে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো– বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় উভয়ভাবেই স্বাস্থ্য খাতের পরিকল্পনা ও অর্থায়নে সক্রিয়ভাবে জড়িত।
নতুন উদ্ভাবনের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় আলো ক্লিনিকের কথা। সুইডিশ সিডা, ইউনিসেফ, সিএমইডি হেলথ লিমিটেডসহ কয়েকটি স্টেকহোল্ডার মিলে সম্প্রতি আরবান ক্লিনিক মডেল চালু করেছে। ‘দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা’ স্লোগান নিয়ে আলো ক্লিনিক নামে পরিচালিত হচ্ছে মডেলটি। এ মডেলের নকশাটি দিল্লির মহল্লা ক্লিনিক, যুক্তরাজ্যের জেনারেল প্র্যাকটিশনার (জিপি) সিস্টেম এবং আরও কিছু দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা থেকে ধারণা নিয়ে তৈরি হয়েছে। এর সম্পূর্ণ কার্যক্রম পরিচালিত হয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে। একমাত্র ডাক্তারের দেওয়া ব্যবস্থাপত্রটি ছাড়া আর কোথাও কাগজের কোনো ব্যবহার হয় না। প্রতিটি রোগীর জন্য ডিজিটাল স্বাস্থ্য অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয় এবং ক্লিনিক থেকে প্রদত্ত সব ধরনের সেবা সেখানে সংরক্ষিত থাকে। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যঝুঁকি মূল্যায়ন এবং সে অনুযায়ী স্বাস্থ্য পরামর্শ দেওয়া হয়। বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে রয়েছে– টিকাদান, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, প্রবীণ, কিশোর ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা। এ ছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে রোগীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে রোগীদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের হাসপাতালগুলোতে রেফার করা হয়।
নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ব্র্যাক অবদান রেখে চলেছে অনেক দিন থেকে। এসব সেবার মধ্যে রয়েছে– কম খরচে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যসেবা, নারী ও কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান, অসংক্রামক রোগ এবং খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে পরামর্শ প্রদান, টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে ডাক্তারি পরামর্শ ইত্যাদি। ব্র্যাকের ৫০ হাজার কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার রয়েছেন। যাঁরা অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পাশাপাশি জনগণকে বিভিন্ন মিথের বিরুদ্ধে সচেতন এবং টিকাদান সম্পর্কে অবহিত করেন। তাদের ৭০০ কর্মী কভিড-১৯ টিকা দেওয়াতে সরকারকে সরাসরি সহায়তা করেছেন। সূর্যের হাসি ক্লিনিক সারাদেশে অনেক ক্লিনিক পরিচালনা করে আসছে, যা প্রাথমিকভাবে নিম্ন আয় ও অতি দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা দিয়ে থাকে। ইউএসএআইডির অর্থায়নে ১৯৯৭ সাল থেকে যাত্রা শুরু হয় সূর্যের হাসি ক্লিনিকের। প্রায় দুই দশক ধরে বেশ কয়েকটি এনজিওর মাধ্যমে ক্লিনিকগুলো চলছিল। ২০১৮ সালে ক্লিনিকগুলোকে একত্র করে নিবন্ধন করা হয়। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র বাংলাদেশের প্রাচীনতম বেসরকারি, অলাভজনক এবং জাতীয় পর্যায়ের সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি। এটি প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বাংলাদেশের গ্রাম ও নগরে স্বল্প খরচে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছে।
গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র তার ৪৩টি গ্রামীণ উপকেন্দ্র এবং ৬টি একাডেমিক হাসপাতালের মাধ্যমে বেশিরভাগ দুর্বল ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে সেবাদান করে। অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবায় সিআরপি দেশের বিভিন্ন স্থানে সেবাকেন্দ্র গড়ে তুলেছে, যেখানে প্রতিবন্ধিতার ওপর পরামর্শ দেওয়া এবং প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষমতায়নকে প্রচার করা হয়। বাংলাদেশে নারী ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা এবং মৃত্যুহার হ্রাসে নারীবিষয়ক চিকিৎসকদের সংগঠন ওজিএসবি কাজ করে যাচ্ছে অনেক দিন থেকে। ওজিএসবির তত্ত্বাবধানে ঢাকার মিরপুরে দুটি হাসপাতাল আছে। সেখানে বহির্বিভাগে স্বল্পমূল্যে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। আন্তঃবিভাগও আছে, যেখানে অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় কম খরচে রোগী ভর্তি হতে পারে। সঙ্গে রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থাও রেখেছে তারা। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মাতৃ ও শিশু চিকিৎসায় দক্ষ জনবল বৃদ্ধিতেও অবদান রাখছে ওজিএসবি। উন্নয়ন সংস্থাগুলোর স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে শুধু প্রতিরোধ ও নিরাময়মূলক পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং অ্যাডভোকেসি, গবেষণা, স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, পুষ্টি, পরিবেশগত স্বাস্থ্যসহ অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত।
উন্নয়নের একটা বড় শক্তি হলো এনজিও খাত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের অবদানের অনেক দৃষ্টান্ত আছে। কভিড মোকাবিলায় সফলতার পেছনেও এনজিওগুলোর ভূমিকা রয়েছে। এখানে অনেক নিবেদিতপ্রাণ মানুষ কাজ করছেন। সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতা থেকেই অনেকে কাজ করছেন। উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তাদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। সরকারের সক্ষমতা-সামর্থ্য আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। অনেক বেশি অর্থায়ন হচ্ছে উন্নয়ন কাজে। শুধু অর্থায়নটা ভালোভাবে হচ্ছে কিনা, সুফলটা সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছাচ্ছে কিনা, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার।
ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট
সূত্র:সমকাল, প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২৩